একটি পূর্ণ আযানের বাণী উচ্চারিত হয়েছিলো ২২টি প্রাণের বিনিময়ে

লিখেছেন লিখেছেন যয়নাব আল গাজ্জালী ২৩ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩, ১১:২৭:৫৮ রাত

মোঘল সম্রাট শাজাহান অপূর্ব নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আবরণে ঢাকা কাশ্মিরের রুপে অভিভূত হয়ে বলেছিলেন-

''আগর ফেরদাউস বর রোয়ে জমিন আসত

হামিঁ আসত, ওয়া হামিঁ আসত,ওয়া হামিঁ আসত''

(অর্থাৎ মর্ত্যের কোথাও যদি স্বর্গ বিরাজ করে, তবে তা এখানে, এখানে এবং এখানেই।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়- সন্ধ্যার রাগে ঝিলিমিলি ঝিলামের স্রোত খানি

বাঁকা আঁধারে মলিন হল যেন খাপে ঢাকা তলোয়ার।

এক সময়ে মাহাত্না গান্ধীর ''(আশার) একমাত্র আলোর কিরণ'' আর পাকিস্থানের প্রতিষ্ঠাতা কায়েদে আযম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর ''শাহরগ'' বলে পরিচিত কাশ্মির। পাক ভারত দ্বিপাক্ষিত সম্পর্ক ও সমস্যার জালে আবদ্ধ হয়ে খাবি খাচ্ছে সুদীর্ঘ সময় ধরে। আত্ননিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবীতে রক্তের সয়লাব আর ধর্ষিতা নারীর আহাজারিতেই গুমরে কাঁদছে কাশ্মিরের মুসলিম জনগন বছরের পর বছর।

দিনটি ছিলো ২৯ এপ্রিল ১৯৩১। ঈদের এক সকাল। ইমাম সাহেব ঈদের নামাজের খোতবায় হযরত মুসা (আঃ) ও ফিরাউনের কাহিনী বর্ণনা করছিলেন। এমন সময় ভারতীয় ডোগরা ডি.আই. জি মনে করলেন যে, ফিরাউন বলতে আসলে ডোগরা রাজা হরি সিংকে বোঝানো হচ্ছে। সুতরাং তারা সঙ্গে সঙ্গেই খোতবা বন্ধের নির্দেশ প্রদান করলেন। জাতি হিসেবে হয়তো কাশ্মিরের মুসলমানদের শক্তি অনেক দূর্বল। কিন্তু তাদের বুকের মাঝে লুকিয়ে থাকা মুসলিম চেতনা বোধ ছিলো অফুরন্ত। তাই গোটা কাশ্মির এ ঘটনার প্রতিবাদে ফেটে পড়লো।

এই আন্দোলনের নেতা চৌধুরী গোলাম আব্বাস নিজের জীবন চরিতে বলেন, ''প্রকৃত ব্যাপার হল এই দিনটি মুসলমানদের জন্য নাজাতের নির্দেশ রাখে। শতাব্দির নির্লিপ্ত চেতনা সামুদ্রিক তুফানের মত পুনঃ উথ্থিত হয়।''

আবার ইতিমধ্যে জম্মুর কেন্দ্রীয় কারাগারে একজন হিন্দু কনস্টেবল লভুরাম কর্তৃক পবিত্র কোরআন অবমাননার ঘটনায় গোটা উপত্যাকার জনগণ আবারো বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ইসলাম ধর্মের এই অবমাননায় সেখানকার মুসলিম জনতার চেতনাবোধ তরঙ্গ-বিক্ষুব্ধ উর্মিমুখর সমুদ্রের রুপ নেয়।

এরপর ১৯৩১ সালের ২১ জুন কাশ্মিরি জনগন জমায়েত হয় এক জনসমাবেশে।এই সমাবেশকে কাশ্মির স্বাধীনতা আন্দোলনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও সূচনা বলা যায়। সেই খানকাহ মোয়াল্লার জনসমাবেশ শেষে আবদুল কাদির নামক এক পাঠান যুবক সমবেত জনতার উদ্দেশে আবেগ- আপ্লুত ভাষায় বলেন- ''মুসলিম জনতা! সময় এসে গিয়েছে ,এখন ইটের জবাব পাথর দিয়ে দিতে হবে। স্মারকলিপি আর আবেদন- নিবেদনে জুলুম -অত্যাচার বন্ধ হবে না। হবেনা কোরআন অবমাননার প্রতিকার। তোমরা নিজ পায়ে দাঁড়াও, নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াও।'' যুবক বাজ- প্রাসাদের দিকে আঙ্গুলি নির্দেশ করে আরও বলেন,''এই রাজমহলের 'ইটসে ইট বাজাদো।'''

এই বাক্যকটি ব্যবহারের অপরাধে সেই যুবকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়।

১৩ জুলাই ১৯৩১ -এ শ্রীনগর কেন্দ্রীয় কারাগারে সেই যুবকটির বিরুদ্ধে মামলার শুনানি আরম্ভ হয়। যুবক আবদুল কাদিরের সঙ্গে কাশ্মিরি জনগনের রং,বংশ, ভাষা ও জন্মস্থানের কোন সম্পর্ক ছিল না। একমাত্র ইসলামি আদর্শ ও বিশ্বাসের ঐক্যতানে সমস্ত কাশ্মিরের মুসলিম জনতা তার সমর্থনে এগিয়ে আসে। আদালতের চারপাশ তৌহিদি জনতার ঈমানদীপ্ত পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে। লাখো জনতা মামলার শুনানি শোনার জন্য আদালতের সামনে জড়ো হয়ে ইসলামী ঐক্য ও ভ্রাতৃত্বের এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত পেশ করে।

ইতিমধ্যে নামাজের সময় হয়ে এলো। জনতার মধ্য হতে এক যুবক দাঁড়িয়ে গেলেন দ্ব্যর্থহীন ভাবে আজানের বাণী উচ্চারণে। এমন সময় পুলিশের গুলি এসে তাঁর বক্ষচ্ছেদ করে চলে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই যুবকটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে শাহাদাত বরণ করে।

তখন দ্বিধাহীন চিত্তে এগিয়ে আসে আর এক যুবক। আযানের সুমুধুর বাণীর মধ্য দিয়ে আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্বের ঘোষনা দিতেই পুলিশের গুলি তার ও বুক ভেদ করে যায়। প্রথম যুবকের মত সেও শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করে। কিন্তু উপস্থিত জনতা কি ভয় পেয়েছিলো সেদিন? মৃত্যু ভয়ে থমকে গিয়েছিলো কি তাদের ঈমানী চেতনা? না। বরং সেদিন সেই একটি পূর্ণ আযানের ঘোষণা দিতে গিয়ে এক, দুই, তিন এভাবে সর্বমোট ২২জন মুসলিম যুবক তাদের জীবন দিয়ে শাহাদাতের অমিয় সুধা পান করেছিলো। আর সত্যের সাক্ষ্য প্রদানে, সত্য পথের জন্য জীবন দানের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্তের সংযোজন করে গিয়েছিলো।

ইসলামের অবমাননভ বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে জীবন উৎসর্গকারী এসব যুবকের চেতনা ও অনুভূতি তাদের শেষ কথায় সেদিন ফুটে উঠেছিলো। আহত যুবক উপস্থিত শেখ আবদুল্লাকে লক্ষ্য করে বলেছিলো,-''আমরা আমাদের দায়িত্ব পূর্ণ করেছি। এখন আপনাদের পালা। মুসলিম জাতিকে বলবেন, তারা যেন দায়িত্ব পালনে ভুল না করেন।''

সুবহানাল্লাহ!এরই নাম শাহাদাত। এরই নাম ইসলামের আদর্শিক চেতনাবোধ। এরই নাম জাগ্রত ঈমান।

বাংলাদেশের চলমান প্রেক্ষাপটে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলতে চাই, কোন ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দিয়ে একজন মুসলিম হয়ে ইসলাম, ইসলামী প্রতিষ্ঠানও মুসলমানদের ঈমানী চেতনাবোধের উপর এই খড়গ চালানো আপনি বন্ধ করুন। দেশকে এভাবে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেবেন না। মসজিদ কিংবা মুসল্লিদের উপর হামলা আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের কালচার। কিন্তু পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রে এটা কখনো চলতে পারে না।

আর মুসলিম বাংলাদেশী ভাইবোনদের বলছি-চোখের সামনে হতে অন্ধকারের পর্দাটা সরিয়ে ফেলুন। বাংলাদেশের আজকের অস্থিতিশীল অবস্থা কোন বিশেষ রাজনৈতিক দলকে কোণঠাসা করা নয়। এই ষড়যন্ত্রের বীজ অনেক গভীরে। এই ষড়যন্ত্রের মূল লক্ষ্য ইসলাম। এর লক্ষ্য আমাদের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করা।

আসুন দল,মত নির্বিশেষে আমরা সবাই ঐক্যবদ্ধ হই ইসলামের মর্যাদা রক্ষায়। আমাদের প্রিয় জন্মভূমি রক্ষায়। জন্ম লগ্নে যে আযানের সুমধুর সুরে এই পৃথিবীর আলোয় এসেছিলেন। সেই আযানের ডাকে সূরা সফ এর ৪ নং আয়াতের আহবানে 'বুনিয়ানুম মারসুস' হয়ে সকল বিভেদ ভুলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আমরা কেউ হয়ে যাই যুগের মুয়াজ্জিন। আর কেউ বা হয়ে যাই একটি সুহাসিনী ভোরের নকীব।

( এই লিখায় উল্লেখিত ঘটনাটি ভূ-স্বর্গে বিদ্রোহ ইতিহাস ও প্রেক্ষিত বই হতে সংগৃহীত। বইটির লেখক জনাব মুহাম্মদ ফারুকে আজম)

বিষয়: বিবিধ

১৮৭৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File