আদমশুমারির ৪০ বছরের র-ডাটা বিদেশে পাচারের অভিযোগ
লিখেছেন লিখেছেন সচেতন_ নাগরিক ১৬ এপ্রিল, ২০১৩, ১০:৫৯:০২ রাত
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশে সম্পন্ন হওয়া পাঁচটি আদমশুমারির মাঠপর্যায়ে সংগৃহীত অশোধিত তথ্য (র-ডাটা) বিদেশে পাচার করার অভিযোগ উঠেছে। বিপুল পরিমাণ অর্থের বিনিময়ে গোপনীয় র-ডাটা একাধিক প্রভাবশালী দেশের কাছে সরবরাহ করা হয়। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায় বা গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে অন্ধকারে রেখে ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা পরিচালক অসীম কুমার দে র-ডাটা পাচার করেছেন বলে সরকারের একটি তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এ পাচার থেকে প্রাপ্ত অবৈধ অর্থে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে একাধিক সম্পদ ক্রয়ের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। অসীম কুমার দে বর্তমানে সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাষ্ট্রীয় স্বার্থ জড়িত থাকায় আরো অধিকতর তদন্তের সুপারিশ করেছে এ ব্যাপারে গঠিত পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তদন্ত কমিটি। গত ৩১ মার্চ এ-সংক্রান্ত তদন্ত প্রতিবেদন পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের সচিবের কাছে জমা দেয়া হয়। তবে বিষয়টি অতি সংবেদনশীল হওয়ায় সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে ঘটনাটি গোপন রাখার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) মহাপরিচালক গোলাম মোস্তফা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তথ্য পাচারের বিষয়টি আমি জানি না। আদমশুমারির র-ডাটায় দেশের সব পর্যায়ের মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য রয়েছে। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনে শুমারির ব্যক্তিগত তথ্য অন্য কোনো ব্যক্তিকে জানানোর ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এজন্য এ তথ্য কাউকে সরবরাহ করা যাবে না।’
পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭৪ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত সম্পন্ন পাঁচটি শুমারির র-ডাটা বিদেশী কয়েকটি সংস্থার কাছে গোপনে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। র-ডাটা পাচারে উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয়। প্রকল্প পরিচালক এ ডাটা সরবরাহের ক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থা কিংবা সরকারের উচ্চপর্যায়ের ছাড়পত্র কিংবা অনুমতি নেননি।
জানা গেছে, আদমশুমারিতে কারিগরি সহায়তার নাম করে পশ্চিমা একটি প্রভাবশালী দেশের পরিসংখ্যান ব্যুরো এ ঘটনার সময় বিবিএসে সম্পৃক্ত ছিল। তত্কালীন মহাপরিচালক শাহজাহান আলী মোল্লা ও প্রকল্প পরিচালক অসীম কুমার দে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে সেই প্রভাবশালী দেশ ভ্রমণ করেন।
র-ডাটা পাচার বিষয়ে তত্কালীন মহাপরিচালক শাহজাহান আলী মোল্লা বলেন, ‘সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিদেশীরা বিবিএসে কাজ করেছে। এ সুযোগে কেউ তথ্য নিয়ে গেছে কিনা তা আমার জানা নেই।’
পরিবারের সদস্যসহ বিদেশ সফর প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছিলাম। এজন্য প্রধানমন্ত্রীসহ সব পর্যায়ের অনুমতি নেয়া হয়। আর আমার পরিবারের সদস্যরা সেখানে আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল নিজের খরচে।’
তদন্ত প্রতিবেদনে আদমশুমারি প্রকল্পের দুর্নীতির নানা ঘটনা উল্লেখ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, অর্থ আত্মসাত্ ও আদমশুমারির তথ্য পাচার করেই আমেরিকার মেরিল্যান্ড, ভারত ও ধানমন্ডিতে একাধিক ফ্ল্যাট এবং বাড়ির মালিক হয়েছেন অসীম কুমার দে। এ বিষয়ে প্রাথমিক প্রমাণও মিলেছে। এক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালককে সহযোগিতা করেছেন প্রকল্পের পরামর্শক ভারতীয় নাগরিক সুবোধ কুমার। তিনি মূলত ইন্টিগ্রেশন কনসালট্যান্ট ফার্মের কর্মকর্তা। এছাড়া ইউএনএফপিএর ক্রয়-সংক্রান্ত কর্মকর্তা জহরলাল দাশও প্রকল্প পরিচালককে সহযোগিতা করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, আদমশুমারি প্রকল্পের পরিচালক অসীম কুমার দের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ভারতীয় নাগরিক সুবোধ কুমার। তার প্রতিষ্ঠান ইন্টিগ্রেশন সব ধরনের কেনাকাটায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করে। তার ও জহরলাল দাশের মধ্যস্থতায় সব টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। অসীম কুমার দের অবৈধ অর্থ বিদেশে পাচার ও লেনদেনে সহযোগিতা করেন সুবোধ কুমার। তিনিই অসীম কুমার দের ভারতে সম্পত্তি ক্রয়ে সহযোগিতা করেন, এমন অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এছাড়া অবৈধভাবে উপার্জিত অর্থে ঢাকার লালমাটিয়া ও ধানমন্ডিতে স্ত্রী এবং সন্তানের নামে দুটি ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
এ প্রসঙ্গে আদমশুমারি ও গৃহগণনা প্রকল্প পরিচালক অসীম কুমার দে বলেন, ‘কোনো ধরনের অশোধিত তথ্য পাচার করা হয়নি। তবে শুমারি দ্রুত শেষ করার জন্য বিদেশীদের কারিগরি সহযোগিতা নেয়া হয়েছে। পুরো তথ্য তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। তখন তথ্য নিয়ে গেছে কিনা তা আমি জানি না। এ ধরনের তথ্য দৃশ্যমান বস্তু নয় যে, হাতে বহন করে নিয়ে যাওয়ার সময় চোখে পড়বে।’ তবে একটি নির্দিষ্ট দেশে এক মাস অবস্থান করার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি দাবি করেন, সে সফর ছিল সরকারি প্রয়োজনে।
ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদের মালিক হওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘প্রতিবেদনে যেসব জায়গায় ফ্ল্যাট ও বাড়ির কথা বলা হয়েছে, সেখানে আমার কোনো সম্পদ নেই। এ ধরনের তথ্য সঠিক নয়। তদন্তের নামে কিছু ব্যক্তি আমাকে হেয় করেছে। আমাকে এ বিষয়ে কোনো কিছু জিজ্ঞাসা করা হয়নি। দুর্নীতিসহ যেসব অভিযোগ করা হয়েছে তা সঠিক নয়।’
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কমিটির সদস্য ও বিবিএসের উপমহাপরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. মিজানুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে অপারগতা প্রকাশ করে বলেন, ‘আমাদের সব কথা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছি।’
দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান বিভাগের কমিশনার মো. বদিউজ্জামান এ প্রসঙ্গে বলেন, এ-জাতীয় নথি এখনো দুদকের হাতে এসে পৌঁছেনি। নথি আসার পর পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বিষয়: রাজনীতি
১৩৯২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন