জাপানী নারী নিকিতা খাওলার ইসলাম গ্রহণের প্রেক্ষাপট ও তাঁর হিজাব অভিজ্ঞতা।
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ০৪ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০২:৫৮:২৭ দুপুর
একজন জাপানী নারী নিকিতা যাঁর বর্তমান ইসলামী নাম নিকিতা খাওলা। তাঁর ইসলাম গ্রহনের অভিজ্ঞতা এবং হিজাব পালন সম্পর্কে অনেকদিন আগে পড়া তাঁর ইংরেজীতে লিখা একটি প্রবন্ধের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরলাম। মনে হচ্ছে এটি আমি সোনার বাংলা ব্লগেও শেয়ার করেছিলাম। এটি পাঠের পর আশা করি অনেক অতি আধুনিকা নারীদের ইসলামের পর্দাপ্রথার প্রতি বিদ্বেষ কিংবা পর্দাকে মধ্যযুগীয় প্রথা মনে করার মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে।
"-- অনেক জাপানীর ন্যায় আমিও ইসলাম গ্রহনের পূর্বে কোন ধর্মের অনুসারী ছিলাম না। ফ্রান্সে আমি ফরাসি সাহিত্যের উপরে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর লেখাপড়ার জন্য এসেছিলাম।আমার প্রিয় লেখক ও চিন্তাবিদ ছিলেন সাঁর্তে, নিৎশে ও কামাস, যাদের সবার চিন্তাধারাই ছিল নাস্তিকতাভিত্তিক। ধর্মহীন ও নাস্তিকতা প্রভাবিত হওয়া সত্ত্বেও ধর্মের প্রতি আমার প্রবল আগ্রহ ছিল, তবে তা আমার অভ্যন্তরীণ কোন প্রয়োজনে নয়, শুধুমাত্র সত্যকে জানার আগ্রহেই। মৃত্যুর পরে আমার কী হবে তা নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা ছিল না,বরং কিভাবে দুনিয়ায় জীবন কাটাব এটাই ছিল আমার আগ্রহের বিষয়। দীর্ঘদিন ধরে মনে হচ্ছিল আমি আমার সময় নষ্ট করে চলেছি,যা করার তার কিছুই করছি না । ঈশ্বরের বা স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকা বা না থাকা আমার কাছে সমান ছিল। আমি শুধু সত্যকে জানতে চাইছিলাম। যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব থেকে থাকে তাহলে তাঁর আশীর্বাদে জীবন যাপন করব, আর যদি স্রষ্টার অস্তিত্ব খুঁজে না পাই তাহলে নাস্তিকতার জীবন বেছে নেব, এটাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
এ লক্ষ্যে ইসলাম ছাড়া অন্যান্য ধর্ম নিয়ে আমি পড়াশুনা করতে থাকি। ইসলাম ধর্মকে আমি পড়ার মত মর্যাদাপূর্ণ মনে করি নি। আমি কখনো চিন্তাও করিনি যে এটি পড়াশুনার যোগ্য কোন ধর্ম। আমার বদ্ধমুল ধারণা ছিল যে, ইসলাম ধর্ম হল মূর্খ ও সাধারণ মানুষদের এক ধরনের মূর্তিপূজারীদের মত ধর্ম। কত অজ্ঞই না আমি ছিলাম। আমি কিছু খ্রিষ্টানের সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন করি। তাদের সাথে আমি সময়ে সময়ে বাইবেল অধ্যয়ন করতাম । বেশ কিছুদিন গত হবার পর আমি স্রষ্টার অস্তিত্বের বাস্তবতা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি এক নুতন সমস্যার মধ্যে পড়লাম । আমি কিছুতেই আমার অন্তরে স্রষ্টার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছিলাম না, যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব রয়েছে। আমি গির্জায় গিয়ে প্রার্থনা করার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা-ই চেষ্টা, স্রষ্টার অস্তিত্বহীনতাই চিন্তাচেতনায় জেঁকে রইল । অনেক বিষয় আমি বুঝতে বা গ্রহণ করতে পারলাম না । আমার ধারণা ছিল, ঈশ্বর বা স্রষ্টা যদি থাকেন, তাহলে তিনি হবেন সকল মানুষের জন্য এবং সত্যধর্ম অবশ্যই সবার জন্য সহজ ও বোধগম্য হবে। আমি বুঝতে পারলাম না, ঈশ্বরকে পেতে হলে কেন মানুষকে স্বাভাবিক জীবন পরিত্যাগ করতে হবে, সন্যাসীত্ব বরণ করতে হবে। আমি এক অসহায় অবস্থায় নিপতিত হলাম। ঈশ্বরের সন্ধানে আমার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা কোন সমাধানে আসতে পারলো না। ঠিক এমনি সময়ে আমি একজন আলজেরীয় মুসলিম মহিলার সাথে পরিচিত হলাম। তিনি ফ্রান্সেই জন্মেছেন, সেখানেই বড় হয়েছেন। তবে তিনি নামাজ পড়তেও জানতেন না। তার জীবনযাত্রা ছিল একজন সত্যিকার মুসলিমার জীবনযাত্রা থেকে অনেকটাই ভিন্ন। কিন্তু আল্লাহ্র প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল খুবই দৃঢ়। কিন্তু এতে আমার সমস্যার সমাধান তো পেলামই না, বরং তাঁর জ্ঞানহীন বিশ্বাস আমাকে বিরক্ত ও উত্তেজিত করে তোলে। আমি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে নিজে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। শুরুতেই আমি পবিত্র কুরআনের এক কপি ফরাসী অনুবাদ কিনে আনি। কিন্তু আমি দু্ই পৃষ্ঠাও পড়তে পারলাম না, কারন আমার কাছে তা খুবই অদ্ভুত মনে হচ্ছিল ।
আমি একা একা ইসলামকে বোঝার চেষ্টা ছেড়ে দিলাম এবং একদিন প্যারিস মসজিদে গেলাম। আশা করেছিলাম সেখানে কাউকে পাব যিনি আমাকে সাহায্য করবেন। সেদিন ছিল রবিবার এবং মসজিদে মহিলাদের একটি আলোচনা চলছিল । উপস্থিত বোনেরা আমাকে আন্তরিকভাবে গ্রহণ করেছিলেন। আমার জীবনে এই প্রথম আমি ধর্মপালনকারী মুসলিমদের সাথে পরিচিত হলাম। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে নিজেকে তাদের মধ্যে অনেক সহজ ও তাদের আপনজন বলে অনুভব করতে লাগলাম।
এরপর থেকে প্রত্যেক রবিবারে আমি আলোচনায় উপস্থিত হতে লাগলাম, সাথে সাথে মুসলিম বোনদের দেওয়া বইপত্র পড়তে লাগলাম। এসকল আলোচনার প্রতিটি মুহূর্ত এবং বইয়ের পৃষ্ঠা আমার কাছে সৃষ্টিকর্তার প্রত্যাদেশের মত মনে হতে লাগলো। আমার মনে হচ্ছিলো, আমি সত্যের সন্ধান পেয়েছি। সবচাইতে অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সিজদায় রত অবস্থায় স্রষ্টাকে আমার অত্যন্ত নিকটে বলে অনুভব করতাম।
এর ঠিক দু'বছর আগে মুসলিম স্কুলছাত্রীদের ওড়না বা স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকা নিয়ে ফরাসীদের বিতর্ক তুঙ্গে উঠেছিল। অধিকাংশ ফরাসী নাগরিকের ধারণা ছিল, ছাত্রীদের মাথা ঢাকার অনুমতি দান সরকারি স্কুলগুলিকে ধর্মনিরপেক্ষ রাখার বিরোধী। আমি তখনো ইসলাম গ্রহণ করি নি। তবে আমার বুঝতে খুব কষ্ট হত, মুসলিম ছাত্রীদের মাথায় ওড়না বা স্কার্ফ রাখার মত সামান্য একটি বিষয় নিয়ে ফরাসীরা এত অস্থির কেন? মানুষ সাধারণ ভালোমন্দ বিবেচনা না করেই যে কোন নূতন বা অপরিচিত বিষয়ের বিরোধিতা করে। কেউ কেউ মনে করেন যে, হিজাব বা পর্দা হচ্ছে মেয়েদের নিপীড়নের একটি প্রতীক। তাঁরা মনে করেন, যে সকল মহিলা পর্দা মেনে চলে বা চলতে আগ্রহী, তারা মূলতঃ প্রচলিত প্রথার দাসত্ব করেন। তাঁদের বিশ্বাস, এ সকল মহিলাকে যদি তাদের ন্যক্কারজনক অবস্থা সম্পর্কে সচেতন করা যায় এবং তাদের মধ্যে নারীমুক্তির আন্দোলন ও স্বাধীন চিন্তার আহ্বান সঞ্চারিত করা যায় তাহলে তারা পর্দাপ্রথা পরিত্যাগ করবে।
এ ধরনের উদ্ভট ও বাজে চিন্তা শুধু তারাই করেন যাদের ইসলাম সম্পর্কে ধারণা খুবই সীমাবদ্ধ। ধর্মনিরপেক্ষ ও ধর্মবিরোধী চিন্তাধারা তাদের মনমগজকে এমনভাবে অধিকার করে নিয়েছে যে তারা ইসলামের সার্বজনীনতা ও সর্বকালীনতা অনুভবে একেবারেই অক্ষম। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশ্বের অগণিত অমুসলিম মহিলা ইসলাম গ্রহণ করেছেন, যাদের মধ্যে আমিও রয়েছি। এ দ্বারা আমরা ইসলাম ধর্মকে সার্বজনীন বলে বুঝতে পারি।
এতে সন্দেহ নেই যে, ইসলামের হিজাব বা পর্দাপ্রথা অমুসলিমদের জন্য একটি অদ্ভুত ও বিস্ময়কর ব্যাপার। পর্দা শুধু নারীর মাথার চুলকেই ঢেকে রাখে না, উপরন্তু আরো এমন কিছু আবৃত করে রাখে যেখানে তাদের নগ্নদৃষ্টির কোন প্রবেশাধিকার নেই, আর এজন্যই তারা খুব অস্বস্তি বোধ করেন। বস্তুতঃ পর্দার অভ্যন্তরে কি আছে বাইরে থেকে তারা তা কিছুতেই অনুধাবন করতে পারে না।
প্যারিসে অবস্থান কালে ইসলাম গ্রহনের পর থেকেই আমি হিজাব বা পর্দা মেনে চলতাম। আমি একটা স্কার্ফ দিয়ে আমার মাথা ঢেকে নিতাম। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে একই রঙের স্কার্ফ ব্যাবহার করতাম।
যখন ইসলাম গ্রহণ করি তখন পাঁচ ওয়াক্ত সালাত(নামাজ) আদায় করতে পারব কিনা, অথবা পর্দা করতে পারব কিনা তা নিয়ে আমি গভীরভাবে ভেবে দেখিনি। আসলে আমি নিজেকে এ নিয়ে প্রশ্ন করতেও চাইনি; কারন আমার ভয় হতো, হয়তঃ উত্তর হবে না সূচক এবং তাতে আমার ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত বিঘ্নিত হবে। প্যারিসের মসজিদে যাওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আমি এক জগতে বাস করেছি যার সাথে ইসলামের সামান্যতম সম্পর্কও ছিল না। নামাজ, পর্দা কিছুই আমি চিনতাম না। আমার জন্য একথা কল্পনা করাও কষ্টকর ছিল যে, আমি নামাজ আদায় করছি বা পর্দা পালন করে চলছি। তবে ইসলাম গ্রহনের ইচ্ছা আমার এত গভীর ও প্রবল ছিল যে ইসলাম গ্রহনের পরে আমার কি হবে তা নিয়ে আমি ভাবিনি। বস্তুতঃ আমার ইসলাম গ্রহন ছিল মহান আল্লাহ্র অলৌকিক দান। আল্লাহু আকবার !
ইসলামী পোশাক বা হিজাবে আমি নিজেকে নুতনভাবে আবিষ্কার করলাম, আমার ব্যক্তিত্বে যেন এক নয়া দিগন্তের সূচনা হলো। আমি অনুভব করলাম, আমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ হয়েছি,আমি সংরক্ষিত হয়েছি। আমি আরো অনুভব করতে লাগলাম আল্লাহ্ আমার সঙ্গে রয়েছেন।
একজন বিদেশিনী হিসেবে অনেক সময় আমি লোকের দৃষ্টির সামনে বিব্রত বোধ করতাম। হিজাব ব্যাবহারে এ অবস্থা কেটে গেল। পর্দা আমাকে এ ধরনের অভদ্র দৃষ্টি থেকে রক্ষা করল।পর্দার মধ্যে আমি আনন্দ ও গৌরব বোধ করতে লাগলাম, কারন পর্দা শুধু আল্লাহ্র প্রতি আমার অনুগত্যের প্রতীকই নয়, উপরন্তু তা মুসলিম নারীদের মাঝে আন্তরিকতার বাঁধন। পর্দার মাধ্যমে আমরা ইসলাম পালনকারী মহিলারা একে অপরকে চিনতে পারি এবং আন্তরিকতা অনুভব করি। এই চেনা সম্পর্কেই মহান আল্লাহ পবিত্র কোরআনে বলেন, "হে নবী! তোমার স্ত্রীদের, কন্যাদের ও মু’মিনদের নারীদেরকে বলে দাও তারা যেন তাদের চাদরের প্রান্ত তাদের ওপর টেনে নেয়। এটি অধিকতর উপযোগী পদ্ধতি, যাতে তাদেরকে চিনে নেয়া যায় এবং কষ্ট না দেয়া হয়।......." {আল আহযাবঃ ৫৯) সর্বোপরি, পর্দা আমাদের চারপাশের সবাইকে মনে করিয়ে দেয় আল্লাহ্র কথা, আমাকে মনে করিয়ে দেয় যে আল্লাহ আমার সাথে রয়েছেন।
একজন পুলিশ যেমন ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় তাঁর দায়িত্ব সম্পর্কে অধিক সচেতন থাকেন, তেমনি পর্দার মধ্যে আমি একজন মুসলিম মহিলা হিসেবে নিজের মাঝে বেশি সচেতনতা অনুভব করতে লাগলাম। আমি যখনই মসজিদে যেতাম তখনি হিজাব ব্যাবহার করতাম। এটা ছিল আমার সম্পূর্ণ ঐচ্ছিক, কেউ আমাকে পর্দা করতে চাপ দেয় নি।
ইসলাম গ্রহনের দুই সপ্তাহ পরে আমি আমার বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য জাপানে যাই। সেখানে যাওয়ার পর আমি সিদ্ধান্ত নিই, ফ্রান্সে আর ফিরে যাব না। কারন ইসলাম গ্রহনের পর ফরাসী সাহিত্যের প্রতি আমি আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। উপরন্তু আরবি ভাষা শিক্ষার প্রতি আমি আগ্রহ অনুভব করতে লাগলাম।
মুসলিম পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে একাকী জাপানের একটি ছোট্ট শহরে বসবাস করা আমার জন্য বড় ধরনের একটি পরীক্ষা ছিল, তবে এই একাকীত্ব আমার মধ্যে মুসলমানিত্বের অনুভূতি অত্যন্ত প্রখর করে তোলে। ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের জন্য শরীর দেখানো পোশাক পরা নিষিদ্ধ । কাজেই আমার আগের মিনি-স্কার্ট, হাফহাতা ব্লাউজ ইত্যাদি অনেক পোশাকই আমাকে পরিত্যাগ করতে হল। এছাড়া পাশ্চাত্য ফ্যাশন ইসলামী হিজাব বা পর্দার পরিপন্থী। এজন্য আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে নিজের পোশাক নিজেই তৈরি করিয়ে নেব। পোশাকটি ছিল অনেকটা পাকিস্তানি সেলোয়ার-কামিজের মত। আমার এই অচেনা পোশাক দেখে কে কি ভাবল তা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই নি। জাপানে ফেরার পর ছ'মাস এভাবে কেটে গেল। এদিকে কোন মুসলিম দেশে গিয়ে আরবি ভাষা ও ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পড়াশোনা করার আগ্রহ আমার মধ্যে খুবই প্রবল হয়ে উঠল। এ আগ্রহ বাস্তবায়িত করতে আমি সচেষ্ট হলাম। অবশেষে একদিন মালসামানা নিয়ে মিশরের রাজধানী কায়রোতে পাড়ি জমালাম।
মিশরের খিমার বা ওড়না পরা বোনদেরকে সত্যিই অপূর্ব সুন্দর দেখাতো। তাদের চেহারায় এক ধরনের পবিত্রতা ও সাধুতা ফুটে উঠত। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক মুসলিম নারী বা পুরুষ আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্য তাঁর নির্দেশাবলী পালন করে এবং সেজন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে। আমি ঐ সকল মানুষের মানসিকতা মোটেও বুঝতে পারি না, যারা ক্যাথলিক সিস্টারদের ঘোমটা দেখলে কিছু বলেন না, অথচ মুসলিম মহিলাদের ঘোমটা বা পর্দার সমালোচনায় তারা পঞ্চমুখ, কারণ এটা নাকি নিপীড়ন ও সন্ত্রাসের প্রতীক। কি আজব!
আমার এক মিসরীয় বোন আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন জাপানে ফিরে গিয়েও একই পোশাক ব্যাবহার করি। প্রথমে আমি এতে অসম্মতি জানাই। আমার ধারণা ছিল, আমি যদি এ ধরনের পোশাক পরে জাপানের রাস্তায় বেরোই, তাহলে মানুষ আমাকে অভদ্র ও অস্বাভাবিক ভাববে। পোশাকের কারনে তারা আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাবে। আমার কোন কথাই তারা শুনবে না। আমার বাইরের চেহারা দেখেই তারা ইসলামকে প্রত্যাখ্যান করবে। ইসলামের মহান শিক্ষা ও বিধানাবলী জানতে চাইবে না। সেদিন আমার মিসরীয় বোনকে আমি এ যুক্তিই দেখিয়েছিলাম। কিন্তু দু'মাসের মধ্যে আমি আমার নতুন পোশাককে ভালবেসে ফেললাম। তখন আমি ভাবতে লাগলাম, জাপানে গিয়েও আমি এ পোশাকই পরব। এ উদ্দেশ্যে আমি জাপানে ফেরার কয়েকদিন আগে হালকা রঙের ঐ জাতীয় কিছু পোশাক এবং কিছু সাদা খিমার (বড় চাদর জাতীয় ওড়না ) তৈরি করালাম। আমার ধারণা ছিল, কালোর চেয়ে এগুলো বেশি গ্রহণযোগ্য হবে সাধারণ জাপানীদের দৃষ্টিতে। আমার সাদা খিমার বা ওড়নার ব্যাপারে জাপানীদের প্রতিক্রিয়া ছিল আমার ধারনার চেয়েও অনেক ভাল। মূলতঃ আমি কোন রকম প্রত্যাখ্যান বা উপহাসের সম্মুখীন হইনি। মনে হচ্ছিল জাপানীরা আমার পোশাক দেখে আমি কোন ধর্মাবলম্বী তা না বুঝলেও আমার ধর্মানুরাগ বুঝে নিয়েছিল। একবার আমি শুনলাম,আমার পেছনে এক মেয়ে তাঁর বান্ধবীকে আস্তে আস্তে বলছে -'দেখ একজন বৌদ্ধ ধর্মযাজিকা'।
একবার ট্রেনে যেতে আমার পাশে বসলেন এক মধ্যবয়সী ভদ্রলোক। কেন আমি এরকম অদ্ভুত ফ্যাশনের পোশাক পরেছি তা তিনি জানতে চাইলেন। আমি তাকে বললাম, আমি একজন মুসলিম। ইসলাম ধর্মে মেয়েদেরকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তাদের দেহ ও সৌন্দর্য পুরুষের জন্য সমস্যা তৈরি করে। তাই নারীদের উচিত নয় দেহ ও সৌন্দর্য প্রদর্শন করা বা তার পুরুষ সহকর্মীদের সমস্যায় ফেলা। মনে হল আমার ব্যাখ্যায় তিনি অত্যন্ত প্রভাবিত হলেন। ভদ্রলোক সম্ভবতঃ আজকালকার মেয়েদের উত্তেজক ফ্যাশনেবল পোষাককে মেনে নিতে পারছিলেন না। তাঁর নামার সময় হয়েছিল । তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে নেমে গেলেন এবং বলে গেলেন তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছা ছিল ইসলাম সম্পর্কে আরো জানার, কিন্তু সময়ের অভাবে পারলেন না।
গরমকালের রৌদ্রতপ্ত দিনেও আমি পুরো শরীর ঢাকা লম্বা পোশাক পরে এবং খিমার দিয়ে মাথা ঢেকে বাইরে যেতাম ।এতে আমার আব্বা খুব দুঃখ পেতেন, ভাবতেন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু আমি দেখলাম রৌদ্রের মধ্যে আমার এ পোশাক খুবই উপযোগী, কারণ এতে মাথা, ঘাড় ও গলা সরাসরি রোদের তাপ থেকে রক্ষা পেত। উপরন্তু আমার বোনেরা যখন হাফপ্যান্ট পরে চলাফেরা করত, তখন তাদের সাদা ঊরু দেখে আমি অস্বস্তি বোধ করতাম। অনেক মহিলা এমন পোশাক পরেন যাতে তাদের শরীরের আকৃতি বা স্পর্শকাতর বাঁক পরিষ্কাররূপে ফুটে উঠে। ইসলাম গ্রহনের আগেও এ ধরনের পোশাক দেখে আমি অস্বস্তি বোধ করতাম। আমার মনে হত এমন কিছু অঙ্গ প্রদর্শন করা হচ্ছে যা ঢেকে রাখা উচিত, বের করা উচিত নয়। একজন মেয়ের মনে যদি এসকল পোশাকে এ ধরনের অস্বস্তি এনে দেয় তাহলে একজন পুরুষ এ পোশাক পরা মেয়েদেরকে দেখলে কিভাবে প্রভাবিত হবেন বা উত্তেজিত হবেন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
আপনারা হয়তঃ প্রশ্ন করতে পারেন, শরীরের স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক আকৃতি ঢেকে রাখার দরকার কি? এ প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগে আসুন একটু ভেবে দেখি। আজ থেকে ৫০ বৎসর আগে জাপানে মেয়েদের জন্য সুইমিং স্যুট পরে সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা অশ্লীলতা ও অন্যায় বলে মনে করা হত। অথচ আজকাল আমরা বিকিনি পরে সাঁতার কাটতেও লজ্জাবোধ করি না। তবে যদি কোন মহিলা জাপানের কোথাও টপলেস প্যান্ট পরে শরীরের উর্দ্ধভাগ সম্পূর্ণ অনাবৃত রেখে সাঁতার কাটেন তাহলে লোকে তাকে এখনো নির্লজ্জ বলবে। আবার দক্ষিন ফ্রান্সের সমুদ্র সৈকতে দেখতে পাবেন সকল বয়সের মানুষ শরীরের উর্দ্ধভাগ সম্পূর্ণ অনাবৃত করে সানবাথ বা রৌদ্রস্নান করছে। আরেকটু এগিয়ে আমেরিকার পশ্চিম উপকূলে যান, সেখানে অনেক সৈকতে ন্যুডিষ্ট নগ্নবাদীদেরকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে রৌদ্রস্নানরত দেখতে পাবেন। যদি একটু পিছনে তাকান তাহলে দেখতে পাবেন মধ্যযূগের একজন ব্রিটিশ নাইট নারীর জুতার দৃশ্যতে প্রকম্পিত হয়ে উঠতেন। এ থেকে আমরা বুঝতে পারি যে নারীদের গোপন অংশ বা ঢেকে রাখার মত অংশ কি, সে ব্যাপারে আমাদের মানসিকতা সতত পরিবর্তনশীল ।
আমরা মুসলিম নারীরা মুখমন্ডল ও হাত ছাড়া পুরো শরীরকে আবৃত করা অত্যাবশ্যক মনে করি, কারন মহান আল্লাহ্ এভাবেই আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। আর এজন্যই নিকটাত্মীয় (মাহরাম) ছাড়া অন্যান্য পুরুষদের থেকে মুখ ও হাত ছাড়া সম্পূর্ণ শরীর আবৃত করে রাখার বিধান দেয়া হয়েছে।
আপনি যদি কোন কিছু লুকিয়ে রাখেন তাহলে তার মূল্য বেড়ে যাবে। নারীর শরীর আবৃত রাখলে তাঁর মর্যাদা বেড়ে যায়, এমনকি অন্য নারীর চোখেও তা অধিকতর আকর্ষণীয় হয়ে উঠে। যখন কোন মানুষ লজ্জার অনুভূতি হারিয়ে নগ্ন হয়ে রাস্তাঘাটে চলতে থাকে, প্রকাশ্য জনসম্মুখে পয়ঃনিশকাশন করে, প্রেম করে, তখন তিনি পশুর সমান হয়ে যান, তাকে আর কোনভাবেই পশু থেকে আলাদা করা যায় না। আমার ধারণা লজ্জার অনুভূতি থেকেই সভ্যতার যাত্রা শুরু।
কেবলমাত্র পুরুষদের প্রতি মানবিক আবেদন জানিয়ে এবং তাদেরকে আত্মনিয়ন্ত্রণের আহ্বান জানিয়ে আমরা সম্ভ্রমহানী ও অন্যবিধ অত্যাচারের সমস্যার সমাধানের আশা করতে পারি না। ধর্মীয় বিধিবিধানের প্রয়োগ ছাড়া এগুলো রোধের অন্য কোন উপায় নেই।
একজন পুরুষ নারীর পরিধানের মিনিস্কার্টের অর্থ এরূপ করতে পারেনঃ " তুমি চাইলে আমাকে পেতে পার", অপরদিকে নারীর ইসলামী হিজাব পুরুষকে পরিস্কারভাবে জানিয়ে দেয় "আমি তোমার জন্য নিষিদ্ধ " ।
'As a woman in short skirt might be interpreted by men to say: " if you want me, you may have me”, on the other hand a hijab-clad woman give you the message clearly that, “I am forbidden for you. “ ...'
বিষয়: বিবিধ
১৭২৫ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন