নিভৃতচারী একজন লিখকের সৃষ্টিমাঝে আমার দেখা মর্মভেদী কিছু কঠিন সত্য....
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ১৮ অক্টোবর, ২০১৪, ১০:০২:৩৫ সকাল
অত্যন্ত কাকতালীয়ভাবেই পরিচয় জিয়া ভাইয়ের সাথে। সম্প্রতি আমার শৈশবের স্মৃতিকথা প্রথম পর্ব পাঠের পর তিনি মন্তব্যে তাঁর ই-মেইল দিয়ে যোগাযোগ করতে বললেন। বললেন, তিনিও নাকি শৈশবে করাচীতে কাটিয়েছেন। আগ্রহী হয়ে যোগাযোগ করলাম।প্রাথমিক পরিচয়পর্ব শেষে (তিনি বিলেত প্রবাসী এবং ব্লগে হককথা নিক-এ লিখে থাকেন) আমাকে তাঁর প্রকাশিত কিছু মূল্যবান বই-এর লিংক দিয়ে সময়মতো পাঠ করতে অনুরোধ জানান। বইগুলোর কলেবর বেশী নয়, গড়ে ১০৫-১৫০ পৃষ্ঠার মাঝে সীমিত।
এ পর্যন্ত তিনটি বই তাঁর আমি পাঠ করেছিঃ টাইন নদীর ওপার থেকে, 'ধরনীর পথে পথে' এবং 'অন্তর মম বিকশিত করো।' অবশ্য শেষেরটির পাঠ এখনো চলছে।
প্রতিটি বইতেই তাঁর লিখার বিষয়বস্তু আবর্তিত হয়েছে, ইসলাম, মুসলমান এবং মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ঘিরে। প্রসঙ্গক্রমে কিছু ছোটগল্প এসেছে (বাস্তব ঘটনা সম্বলিত) তাঁর দীর্ঘ প্রবাস যাপনের অভিজ্ঞতা সম্বলিত, ইসলাম আর পাশ্চাত্য সভ্যতার দ্বন্ধ, সভ্যতার বিকাশ, পথ পরিবর্তন ও বিনাশের চিত্র সম্বলিত আগেবগময় কাহিনী, যা পাঠ করতে গিয়ে পাঠককে পথিমধ্যে বার বার হোঁচট খেতে হবে, পকেট থেকে রুমাল বার করে আঁখি হতে অসময়ে ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দু মুছে নিতে হবে। বরাবর তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হলো মুসলিম উম্মাহ - মুসলিম বিশ্বের পশ্চাদপদতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানে, ধন-সম্পদে, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পিছিয়ে পড়ার কারণসমূহ চিহ্নিত করেছেন অতি সযতনে, অতি জোরালোভাবে। এবং এই চিহ্নিত করতে গিয়ে যেই দফার উপর তিনি তাঁর মনোযোগকে ফোকাস করেছেন তা হলো, মুসলিম দেশসমূহের নেতৃবৃন্দের তাদের সম্পদকে জ্ঞান বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ না করে তা শুধু আরাম আয়েশের জন্য গগনচুম্বী দালান, সূরম্য অট্টালিকা, সী রিজর্ট, নাইট ক্লাব নির্মাণে বিনিয়োগ করা। মধ্যপ্রাচ্যের শাসকদের এই আত্মবিনাশী সম্পদের অপচয়ের চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি তাঁর অন্তর মম বিকশিত গ্রন্থের একস্থানে যা লিখেছেন, তার কিঞ্চিৎ পাঠকের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরছি -
(বাংলাদেশের মানুষদের কবর ও মাজারপূজার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা তুলে ধরে তিনি লিখেছেনঃ "মিশরেও এর ব্যতিক্রম কোন চিত্র নেই। সেখানেও জীবিতের চেয়ে মৃতের কদর বেশী। সেখানেও তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার চেয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে ফেরআউনের মূর্তি বানানোকেই প্রাধান্য দিয়েছে। তারা তাদের অর্থ ঢেলেছে পিরামিডকে সুন্দর করে সাজানোর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পেছনে তারা সে অর্থ খরচ করেনি। বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার চেয়ে তারা মৃত মমি দর্শনে ট্যুরিস্ট অানার কাজে অবকাঠামো বানানোর কাজে বেশি মনোযোগ দিয়েছে। বানিয়েছে বিশ্বের নাম করা সব হোটেল রিসর্ট। থিয়েটার বানিয়েছে একরে পর এক সেই সব ট্যুরিস্ট স্পটের কিংবা রিসোর্টের কিংবা আরো একটু পরিষ্কার করে বলি, আলেকজান্দ্রিয়ার সুন্দরীদের সান্নিধ্য পেতে ছুটে আসা ট্যুরিস্টদের মনোরঞ্জনের জন্য। ............একসময় যে মিশর পুরো বিশ্বে জ্ঞান বিজ্ঞানের জন্য রূপকথার মত বিখ্যাত ছিল, সেই মিশর অজ্ঞানতার অতলান্তে তলিযে গেছে। আজ কে বলবে, এই মিশরের মাধ্যমেই পুরো উত্তর আফ্রিকা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে পড়েছে? কে স্বীকার করবে যে, জ্ঞানে বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠতার কারণেই তারা একসময় ফাতেমী খিলাফতের মতো বিখ্যাত একটি খিলাফতই প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। পুরো মুসলিম বিশ্বে নিজেদের এক অনবদ্য অবস্থান নিশ্চিত করে নিতে পেরেছিল?....
বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা বিজ্ঞান গবেষণায় আজকের মিশর এমন একটা অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে যে, জানেন কি শ্রেষ্ঠত্বের বৈশ্বিক মানের তালিকায় তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আল আজহার এর নাম পাবেন না। প্রথম একশতটি বিশ্ববিদ্যালয় নয়, বরং একহাজার শ্রেষ্ঠ ইউনিভার্সিটিও নয়, দুই হাজারটির মধ্যেও নয়, এমনকি তিন বা চার কিংবা শ্রেষ্ঠ পাঁচ হাজারটির মধ্যেও তার নাম নেই।
না, আল আজহারের নাম নেই। সত্যিই বিশ্বাস করা যায় কি বিশ্বের বুকে এখনও শিক্ষাদানে নিয়োজিত সবচেয়ে পুরনো, ১০৩২ বৎসরেরর পুরানো ইউনিভার্সিটির এমন লজ্জাজনক অধঃপতন? বৈশ্বিক শ্রেষ্ঠত্বের মান অনুযায়ী আল আজহারের ক্রমমান হলো ৫৮৯৩! (২০০৬ সালের জরিপ অনুযায়ী)। লজ্জায় মাথা হেঁট হয়ে আসে। এ লজ্জা কেবল একা মিশরের নয়, বরং সমগ্র মুসলিম বিশ্বের। এই একই তথ্য আমাদের বলে দেবার জন্য যথেষ্ট যে, আমরা মুসলিম বিশ্ব জ্ঞান আর বিজ্ঞান চর্চায় আজ কোন স্তরে নেমে এসেছি। ...
অপরদিকে দেখুন আল আজহারের একশত বৎসর পরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়টি। আজ এই বিশ্বের কে না জানে যে, এটি হলো বিশ্বের অন্যতম একটি শ্রেষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়? বিগত ২০০৫ সালেও এটি বিশ্বের তৃত্বীয় শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বিগত এগারজন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ৭ জনই ছিলেন অক্সফোর্ডের ছাত্র। আর অক্সফোর্ড বিশ্বকে ৫৫ জন নোবেল বিজয়ী উপহার দিয়েছে এ পর্যন্ত। ......
শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদন্ড হয়, তবে আমাদের মেরুদন্ড কতটা দূর্বল সে কথা কি আমরা এখনও বুঝে উঠেছি বলে মনে হয়? আমাদের শিক্ষাখাতের বাজেট কত? আর সেই বাজেটের টাকা কোন কোন খাতে ব্যয় হয়? .............জেনে আশ্চর্য্য হবেন যে আমেরিকার একমাত্র হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিশ্বের এক নং) বার্ষিক বাজেট হলো প্রায় ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। (প্রায় ৫ বছর পূর্বেকার হিসাব)। .................. এইতো মাত্র সেদিন ১৯০১ সালে তার নিজের নামে প্রতিষ্ঠিত 'রকফেলার ইউনিভার্সিটি এ পর্যন্ত বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মোট ২৩ টি নোবেল এনেছে। অর্থাৎ একজন ব্যক্তি মাত্র, আমেরিকাকে কেবল বিশ্বসেরা দু'দুটি ইউনিভার্সিটিই দেয় নাই (অন্যটি শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়), বরং তিনি তার দেশটিকে এ পর্যন্ত ১০২টি নোবেল এনে দিয়েছেন। ..........."
লিখকের সাবলীল বাচনভঙ্গি, আন্তরিকতা, মুসলিম উম্মাহর জন্য তাঁর হৃদয়ের ব্যাকুলতা এবং উম্মাহর ক্রম অধঃপতনের কারণে তাঁর মর্মজ্বালা সব মিলিয়ে বইগুলো এক একটি অনবদ্য রচনায় পরিণত হয়েছে, যা পাঠ করলে পাঠকের হৃদয় মন ও মূহুর্তে মুসলমানদের অতীত ইতিহাসের অলিতে গলিতে হারিয়ে যাবে। তিনটি বই-ই পাঠ শুরু করলে শেষ না করা পর্যন্ত আপনি স্বস্তি পাবেন না। বিশ্বাস না হয় একটু ট্রাই দিয়েই দেখুন না। যদি আমি এতটুকু বাড়িয়ে বলে থাকি তো কান টেনে তৌবা করাইয়েন। তাঁর বইগুলো পাবেন নিচের দেয়া লিংক এঃ
http://www.ziaulhaque.co.uk/
বিষয়: বিবিধ
২৫৬১ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে আল-আযহার,আল কারওয়াইন ও যাইতুশ বিশ্ববিদ্যালয় কে অনেক সময়ই বিশ্ববিদ্যালয় এর তালিকায় যুক্ত করা হয়না। এগুলিকে থিওলজিক্যার স্কুল মনে করা হয়। যথেষ্ট উন্নত মানের গবেষনা হওয়ার পর ও তাই এগুলি যুক্ত হয়না সেই তালিকায়।
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ।
ডাউনলোড করলাম।
শেয়ার করার জন্য ধন্যবাদ,জাযাকাল্লাহ
কী যে বলেন
মাইন্ড করার প্রশ্নই ওঠেনা- )
আমি এমনিতেই ভীষণ খুশী যে আপনারা পড়ছেন,
মন্তব্য করা ও জবাব দেয়া যে কতটা কঠিন
তা আমি নিজেও জানি-
তাই আমি মন্তব্যের সংখ্যা ভাবিনা,
কতবার পঠিত সেটাই দেখি!
আবারো ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ, দোয়া চাই-
"আর ধরনীর পথে" সেতো আরেক ঘটনার ছলে দারুন শিক্ষামুলক বই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন