শৈশবের স্মৃতিঃ স্মৃতিতে অম্লান, নানাবাড়ির উপাখ্যান। (প্রথম অংশ)
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৮:৫০:১১ রাত
শৈশবের স্মৃতিকথা লিখতে গেলেই স্মৃতির দিগন্তজুড়ে যে গল্পগুলো ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, তার মাঝে নানাবাড়ির স্মৃতিগুলোই যেন বেশী উজ্জল, বেশী আবেদনময় হয়ে ধরা দেয়। যদিও শিশুকালে চার বছর বয়সেই বাবার চাকুরীর সুবাদে আমাদের সপরিবারে করাচী শহরে চলে যেতে হয়েছিল, তথাপি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠকালে দেশে বেড়াতে এসে (১৯৬৭) সাড়ে পাঁচ মাসের মতো থাকা আর স্বাধীনের পরপর দেশে এসে বিগত কৈশোরের সন্ধিস্থলে থেকেও মামাদের যতোটুকু আদর স্নেহ কুড়িয়েছি, সেটা মনে হয় খুব কম মানুষের ভাগ্যে জুটে। আজকে আমার ব্লগার ভাই ও আপুদের তাই যে গল্প শোনাবো তার বৃহদাংশ শৈশব ও কৈশোরের প্রান্তিককালীন সময়ে নানাবাড়ীতে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি কথাতেই থাকবে সাজানো।
গল্পের বর্ণনার সুবিধার্থে শুরতেই গল্পে বর্ণিত কতগুলো কেন্দ্রীয় চরিত্ররূপে আসা শব্দগুচ্ছর সমাহার করছি ঃ ইব্রাহিম সওদাগর বাড়ি, ফাজিলপুর, ভূঞা বাড়ি, করইয়া, মুহুরী গাঙ, কাদরী হাই স্কুল, হুরান বাই (পুরান বাড়ি), বাইন হইর (বাইন পুকুর), ছুছুম (শুশুক), খাজুর রস, দই, মুড়ি, পিঠা, রাব-মোয়া, নাইয়ল (নারিকেল), খোলা ঝাঁই হিডা, হুয়া হিডা, ছিতল হিডা, ছাঁইয়া হিডা (পিঠা), ইস্টিশন, কাছারী, ছাম্মান....
জ্বি ভাইজান ও আপুরা। আমার স্বপ্নের নানুবাড়ি হল ফেনী জেলার ফাজিলপুর গ্রামের ইব্রাহিম সওদাগর বাড়ি। আমার নানার অন্য কাজিনরা যখন সংখ্যায় বেশী হয়ে যায় তখন পুরানো বাড়ি ছেড়ে উত্তর দিকে তাঁরা আপন তিন ভাই নূতন করে বাড়ি করেন। নুতন বাড়িটা তাই আয়তনে ছোট হলেও ছিল ছিমছাম এবং আকর্ষনীয়। চারদিকে নারকেল, সুপারী গাছ, আম, জাম, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা সব ধরনের ফলফলাদীর গাছ দিয়ে ছিল সুন্দর করে ঘেরা। আরো ছিল বেতবন, বাঁশঝাড়ে পরিপূর্ণ। আমার আম্মার দাদা ছিলেন ইব্রাহিম সওদাগর, বৃটিশ আমলের একজন সৎ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি। ব্যবসা উপলক্ষ্যে সে সময়ে তিনি বার্মায় ও যাতায়াত করতেন। বাড়ির সোজাসুজি পূর্বদিকে ২৫০ শত গজ দূরত্বে উত্তর দক্ষিণে কুলুকুলু নাদে বহিয়া চলে মুহুরী গাং নামের প্রসিদ্ধ নদী। একসময় বেশ খরস্রোতা হলেও, একুল ভেঙ্গে ওকূল গড়ার খেলায় আজ নিজেরই প্রায় ভগ্নদশা এবং স্থানে স্থানে চর পড়ে চেহারা সূরতে যেন বৈরাগ্যভাব ভর করেছে। এই বাড়ির থেকে আধ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত প্রভাবশালী ভূঞা বাড়ি, যেটা আমার আম্মার নানাবাড়ি। এই বাড়িরই কিছু সদস্য সওদাগর বাড়ির পশ্চিমে প্রায় সিকি মাইল দূরত্বে এসে দ্বিতীয় ভূঞা বাড়ির পত্তন করেন।
আমার মায়েরা ছিলেন দুই বোন চার ভাই, আম্মা সবার বড়। অবশ্য শিশুকালে নাকি উনার আরো দুই ভাই মারা যায়। আমার বড় মামার কপালে মাঝখানে একটা ছোট রিং এর মতো দাগ আছে। ওটা নাকি তাঁর জম্মের পরপর সেকালের তামার কয়েন গরম করে দাগানো হয়েছিল, যাতে উনার উপর কারো কুদৃষ্টি না পড়ে, কারণ মায়ের পরের দুই ভাই-ই ছোটকালে মারা যায়। বাবা ছিলেন এ বাড়ীর সম্মানিত বড় জামাই, আরবী শিক্ষিত জামাই (বাবা মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করে আবার কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন এবং ইন্টার এ পাঠকালীনই বিবাহ কাজ সেরে ফেলেন)। মা, সম্ভবতঃ থ্রি ক্লাশ পর্যন্ত স্কুলে গিয়েছিলেন,বাকীটা ঘরেই পন্ডিত মশাইয়ের নিকট হতে যা শিখেছিলেন। উনার স্মরণ শক্তি খুবই প্রখর ছিল। আমরা যখন থ্রি/ফোর এ পড়ি তখন উনি সুর করে তাঁর বাল্যকালে শিখা ছড়াগুলো আমাদেরকে শুনাতেন। এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন নানাবাড়ি এলাকায় প্রচলিত যুদ্ধসংগীত এর কয়েক লাইনও বলেছিলেন, যার দুটি পংক্তি হলোঃ "লেফট রাইট, লেফট রাইট, কদম ফেলাইছে, আম্রিকানের সৈন্য দেখি জাপান পালাইছে।" এ যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট রোম খাড়া করা অনেক কাহিনী তাঁর নিকট আমরা তম্ময় হয়ে শুনতাম আর ঘন ঘন চোখের পলক ফেলে চলতাম।
করইয়া ছিল আমার মায়ের ছোট ফুফুর বাড়ি। সে বাড়িতে যেতে প্রধান অবলম্বন ছিল ছাম্মান, হয়তবা এটাকেই শুদ্ধ ভাষায় বলা হয় 'সাম্পান'। ঐ বাড়িতে দাওয়াত খেতে যেতে দুটি সাম্পান ভাড়া করা হতো, কারণ সদস্য সংখ্যা ছিল বেশী। দুটো নৌকার দুই মাঝি যখন 'কেঁরত, কেঁরত শব্দ করে তাদের বৈঠা বাইতো, তখন সেই শব্দের যাদুতে অনেক সময় চোখে ঘুম নেমে আসতো। তবে, নৌকায় বসে ঘুমানোর চাইতে যে কাজটিকে বেশী প্রাধান্য দিতাম তা হলো, নিবিষ্ট মনে নদীর শেষ মাথা যেথায় নীল আসমানের দিগন্ত রেখায় গিয়ে মিশেছে সেদিকে তাকিয়ে থাকা। অথবা নদীর ধারে রাখালদের গরু ছাগল চরানোর দৃশ্য উপভোগ করা।
আমার নিজ বাড়ি হলো শর্শাদি ইউনিয়ন। তাই নানাবাড়ি যেতে প্রধান বাহন হলো রেলগাড়ি। ফাজিলপুর ইষ্টিশানে নেমে রেললাইন ক্রস করে উত্তর দিকে গিয়ে ঢালুতে নেমে পায়ে চলা মেঠো পথে কিছুদুর গেলে আসে ফাজিলপুর বাজার। নানাদের পুরান বাড়ির অনেকেরই দোকান রয়েছে এখানে। তাই কারো ভাগ্নে, কারো নাতী এ হিসেবে খাতির যত্ন যা নেবার সব নিয়ে এগিয়ে গেলে আসে বড় মাঠ, এটা হলো কাদরী হাই স্কুলের মাঠ। বহু বছরের পুরানো প্রসিদ্ধ কাদরী হাই স্কুল। এ স্কুলেই আমার নানা, মামা, খালাদের শিক্ষালাভ। স্কুলটিকে ডানে রেখে সোজা পূর্বমূখী হয়ে চলে গেছে মেঠো পথ মুহুরী গাং লক্ষ্য করে। কিছুদূর গেলে আসে ছোট একটা বাঁক। রাত বারোটার দিকে যে ট্রেনটি আপনাকে আনলোড করবে, তখন নানাবাড়ি যেতে এই বাঁকের কাছে এলে বিশাল যেই বটগাছটি তার শাখা বিছিয়ে চারদিক আগলে রেখেছে, এর নীচের অংশটুকু অতিক্রম করার সময় আপনি বেশী সাহসী না হলে ভয়ে মূর্ছাও যাইতে পারেন। তবে আল্লাহ আমাকে গায়ে গতরে তাকত না দিলেও, মনের তাকত দিয়েছিলেন বেশ । তাই একা হলেও কোন ভয় না করে সূরা কালিমা পাঠ করে বুকে ফুঁ দিয়ে মাথা নীচু করে অবলীলায় পার হয়ে যেতাম সেই বটগাছের তল। তারপর হনহন করে হাঁটা যে দিতুম, একেবারে নানাবাড়ির কাছে এসে মনে হয় নিঃশ্বাস ফেলতাম। এটা অবশ্য শৈশব পেরিয়ে কৈশোরের শেষ প্রান্তের কথা। সে যাক।
কাদরী হাই আর ফেনী কলেজ যেন একে অপরের পরিপূরক। মামারা কাদরী হাই থেকে মেট্রিক পাশ দিয়ে অবশ্যই সবাই ফেনী কলেজেই ভর্তি হতেন। গ্রামের নাম 'ফাজিল'পুর হলেও, কাজে কিন্তু এ তল্লাটবাসী অনেক দিক দিয়েই এগিয়ে ছিলেন, যেমন, শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধূলা ইত্যাদি। মনে পড়ে ১৯৬৭ সনে যখন দেশে বেড়াতে এলাম তখন মেঝ মামা আর তার সাথীরা সবে ফেনী কলেজের ছাত্র। কি তাঁদের ঠাটবাট। কলেজে যেন তাঁরাই সব কিছুর নিয়ন্ত্রক। যাক, সেবার মামারা ঠিক করলেন বাজারের মাঠে একটি নাটক মঞ্চস্থ করবেন। নাটকের স্ক্রিপ্ট মামার তৈরী, পরিচালকও তিনি। সে সময়ে নাটকে নায়িকার ভূমিকার জন্য কিন্তু কোন নারী চরিত্র ছিলনা। পুরুষরাই শাড়ী পরে তাদের রোল আদায় করতো। তো, মামার জন্য আমাদের তখন দেশে আসাটা যেন আশীর্বাদই ছিল।কারণ তাঁর নাটকের তিনটি নারী চরিত্র রূপায়নের প্রয়োজনীয় শাড়ির যোগানদাতা হতে পারবেন তাঁর বড় বোন- আমার মা। মামার নিজের পার্ট ছিল রাজকণ্যা, সাথে দুইজন সখী। পরপর তিন রাত্রি নাটকটি মঞ্চায়ন হয়েছিল এবং দর্শকে হাউজফুল ছিল প্রতিটি রাত।
মামাদের সবাই (চার মামা) আমার গর্বের বিষয়। সেজ জন আমার থেকে মাত্র কয়েক মাসের বড় আর ছোটজন তো ছোটই। বড় দুই মামা সরকারী চাকুরীতে থাকাকালেই যুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে মুক্তিবাহিনীতে নাম লিখিয়ে চলে যান যুদ্ধে। ইন্টারের পরে মেঝ মামা করাচী চলে গিয়েছিলেন চাকুরীর খোঁজে (নানা ও বড় মামা আগে থেকেই ছিলেন)। মেঝ মামা আমাদের বাসাতেই উঠেন ও আমাদের গৃহশিক্ষকের ভূমিকা গ্রহন করেন। আগেই বলেছি, যুদ্ধ বাধলে তিনি দেশে চলে যান এবং মুক্তিযু্ধে যোগ দেন। তিনি একাধারে আমার শিক্ষক, প্রশিক্ষক এবং অভিভাবক। পরবর্তীকালে আমার বিদেশে আসার পেছনে তাঁর অবদান অপরিসীম।
আহা! আমার লাল টকটকে, পূণ্যবতী জান্নাতবাসী নানু, যাঁর হাতের রান্নার স্বাদ যেন জিহ্বার আগায় এখনো অনুভব করি।
Click this link শেষ পর্ব এখানে
বিষয়: বিবিধ
১৯৩১ বার পঠিত, ২৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ আপনার নানুকে জান্নাতবাসী করুন! আমীন
ফাজিল পুর ষ্টেশনের সাথে যে বাজার তার ডান দিকে একটু গিয়ে (চট্টগ্রাম থেকে যাওয়ার সময়) আমার এক তালই বাড়ী আছে। বেড়াতে গিয়েছিল অনেক আগে। অসাধারণ মেহমানদারী করেছিরেন ওনারা।
নানাবাড়ির মজা! মামা-নাটক! পোশাক/অলংকরণে শ্রদ্ধেয়া মা! কত্ত কত্ত আনন্দের স্মৃতি! আমার্নানাবাড়ির্গুলোওবলবোকিনাভাবছি...
ধন্যবাদ
সবাইকে ঈদ মোবারক।
মন্তব্য করতে লগইন করুন