রমজান আলোচনাঃ অল্পে তুষ্টি বা সরল জীবন বনাম ত্যাগের উচ্চতম আদর্শ
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ০৮ জুলাই, ২০১৪, ০৫:৫৫:২৭ সকাল
অল্পে তুষ্টি বা সরল জীবন বনাম ত্যাগের উচ্চতম আদর্শ।
অল্পে তুষ্টি মানবের একটি বিশেষ গুন। যে বা যাঁরা এ গুনে গুনান্বিত, তাঁরা যেমন একদিকে আল্লাহর প্রিয় বান্দা, তেমনি তাঁরা সমাজের অন্য দশজনের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। এ গুনটি অর্জনে মানুষকে অনেক চেষ্টা সাধনা করতে হয়। এটি মানব চরিত্রের এমন একটি বিশেষ প্রবণতা, যা তার সাধারণ অভ্যাস বা ফিতরাতের বিপরীত। মহান আল্লাহ মানুষের এ ফিতরাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কালামে পাকে সুরা আত তাকাছুর-এ (প্রতিযোগিতা) কি সুন্দর করেই না বলেছেনঃ ‘অগাধ সম্পদ লাভের বাসনা তোমাদেরকে সদা ব্যস্ত রাখে; যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও’।
হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ) কে বলতে শুনেছি, “বৃদ্ধ লোকের অন্তর দুটি ব্যাপারে সর্বদা যুবক থাকে। এর একটি হলো দুনিয়ার মহব্বত আর অন্যটি হলো উচ্চাকাঙ্খা।”(বুখারী শরীফ)।
নবী-রাসূলদের জীবনী এবং তাঁদের সহচরদের তথা সাহাবীদের জীবনী পাঠ করলে আমরা অল্পে তুষ্টি বা সরল জীবন যাপন এবং সাথে সাথে ত্যাগের অনুপম সব দৃষ্টান্ত দেখতে পাই।তাঁদের ইসলামপূর্ব জীবন এবং ইসলাম পরবর্তী জীবনের আলেখ্য পাঠ করলে তাঁদের জীবনাচারে পরবর্তীকালে যে আমূল পরিবর্তন সাধিত হযেছিল তম্মধ্যে সরল জীবন যাপনের এ গুনটি ধ্রুবতারার মতো জ্বলজ্বল করে ইসলামের এ মহান শিক্ষার প্রতি আমাদের দৃষ্টিকে সহজেই আকৃষ্ট করে। ইসলামের অনূপম শিক্ষা কিভাবে তাঁদের জীবনধারাকে ১৮০ ডিগ্রিতে পাল্টে দিয়েছিল তা ভাবলেও চিন্তাশক্তি শুধু হোঁচট খেয়ে ফিরে আসে। আল্লাহর নবীর হাতে বাইয়াত হবার দেরী, তৎপরবর্তী মূহুর্তে নিজেদের ধনসম্পদ, নবীর কদম মোবারকে এনে হাজির করে দিতেন এবং নিজে আক্ষরিক অর্থে সরল জীবন যাপনের নিয়্যত করে ফেলতেন। শুরু হতো তাঁদের কঠোর সংযমী জীবন। এমনো দিন যেতো যে, ঘরে খাদ্যের অভাবে ক্ষুধার তাড়নায় পেটে পাথর বেঁধে ক্ষুধার কষ্টকে ভূলে থাকার চেষ্টা করতেন। মনে পড়ে রাসূলের (সাঃ) ঘনিষ্ট সহচর হযরত আবু বকরের (রাঃ) সেই দানের কথা? তবুকের যুদ্ধের প্রয়োজনে রাসূল (সাঃ) এর আহবানে সাহাবাগন একে একে নিজ নিজ সামর্থ অনুযায়ী ধন-সম্পদ এনে হাজির করছেন রাসূলের চরণতলে। হজরত আবু বকর ছিলেন ধনের দিক দিয়ে খুবই গরীব। তিনি তাঁর লোটা কম্বল সব হাজির করলেন। রাসূলে পাক (সাঃ) তাঁকে প্রশ্ন করলেন, নিজ পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ?জবাব এলো, ওদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই যথেষ্ট।
নবীজীর এক কথায় মক্কা হতে মদীনায় হিজরতকারী নিঃসম্বল মুহাজির ভাইদের কি অবলীলায় মদীনার আনসার সাহাবীগন নিজেদের ঘরবাড়ী, জায়গাজমি সমান ভাগে ভাগ করে দিয়েছিলেন এ ইতিহাস ও আমাদের সামনে আছে, যা পৃথিবীর আর কোন জাতির ইতিহাসে নেই। আমাদের নবীজী (সাঃ) তালি দেয়া কাপড় পরিধানে কখনো লজ্জাবোধ করেন নি। তেমনি তাঁর সুযোগ্য সাহাবাদের অনেকেই এ ব্যাপারে বেশ অগ্রসর ছিলেন। ইসলামের দ্বীতিয় খলিফা হজরত ওমরের (রাঃ) এর সময়কার ঘটনাটিতো সবারই মনে আছে্। সেবার ছিল দূর্ভিক্ষের সময়। এমনকি পরনের কাপড়ও রেশনে বন্টন করতে হয়েছিল। সাধারণ প্রজা থেকে নিয়ে ইসলামী রাষ্ট্রের মহান খলিফা সবারই ভরসা ছিল এই রেশনিং ব্যবস্থা। তো সবার মতো খলিফাতুল মুসলিমিনও এক খন্ড কাপড় পেলেন রেশনে। যা দিয়ে খলিফার জন্য তাঁর উপযোগী একটি লম্বা জামা তৈরী করা ছিল কষ্টকর। কিন্তু পরবর্তী শুক্রবারে যখন নুতন জামা পরিধান করে খলিফাতুল মুসলিমিন জুম্মার খুতবা প্রদানের জন্য মিম্বরে উঠে দাঁড়ালেন তখন মুসল্লীদের সারি থেকে একজন দাঁড়িয়ে প্রতিবাদী কন্ঠে বলেন, ‘আমীরুল মোমেনীন, যে কাপড় আমরা পেলাম তা দিয়ে তো এতো বড় জামা হয় না, আপনি কি করে তা বানালেন; প্রশ্নটির সমাধান যতক্ষণ না পাচ্ছি ততক্ষণ আমরা খুতবা শুনবো না’… খলিফাপূত্র আব্দুল্লাহ তখন দাঁড়িয়ে জবাবে বললেন, ‘আসলে আমার ভাগে যে কাপড়টুকু পড়েছিল সেটার সাথে তাঁরটা জুড়ে ঐ জামা তৈরী হয়েছে’ তখন মুসল্লীগণ আশ্বস্ত হয়ে নামাজের জন্য প্রস্তুত হলেন।সুবহানাল্লাহ।
তাঁর সময়কার আর একটি ঘটনা। একদিন স্কুল থেকে ফিরে তাঁর ছোট ছেলে খলিফাকে বলছেন, “আমি আর স্কুলে যাবোনা, সবাই শুধু আমাকে নিয়ে টিটকারী দেয়, বলে: ‘দেখো খলিফার ছেলে তালি দেয়া জামা পরেছে….”। খলিফা ওমর (রাঃ) পূত্রের অভিযোগ শুনে কিছুক্ষণ চিন্তা করে বায়তুল মাল সম্পাদককে খবর পাঠালেন, তাঁকে যেন আগামী মাসের ভাতা থেকে কয়েক দিরহাম ধার দেয়া হয় এবং তা যেন সেই মাসের বেতন থেকে কেটে রাখা হয়। বায়তুল মাল সম্পাদক খলিফার অনেুরোধের জবাবে লিখে পাঠালেন, ‘ঠিক আছে আপনাকে আমি ধার দিচ্ছি, কিন্তু তার আগে আপনি আমাকে এই গ্যারান্টি দিন যে আপনি সে সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন’। খলিফা লজ্জিত হলেন, এবং ছেলেকে সান্ত্বনা দিয়ে বললেন, যাও বাবা, এভাবেই স্কুলে যাও, আমি মুসলিম জাহানের খলিফা, কিন্তু আমি তো জনগণের সম্পদের রক্ষক মাত্র। সেটাতে আমার কোন অধিকার নেই। সুবহানাল্লাহ। এরকম শত শত উদাহরণ দেয়া যায়, কিন্তু স্থানাভাবে সম্ভব হচ্ছেনা।
এবার দু চোখ বন্ধ করে আমরা এই ব্যাপারে আমাদের নিজস্ব অবস্থানটুকু একবার চিন্তা করে দেখে নেই। উনাদের ঐ অবস্থানের সাথে আমাদের অবস্থানের তূলনা করে দেখি। কি দেখতে পাই? আমার তো মনে হয় ছেলেবেলার বাংলা টেক্সস্টবুক এর পাঠ্য কবিতা সেই মাঝি আর বাবুর কবিতার ‘ষোল আনাই মিছে’-র সারিতে আমরা। আপনারা আপনাদের হিসেব কষেন, আমি আমার হিসেব কষতে গিয়ে যা পেলুম সেটাই সংক্ষেপে বলছিঃ
১) বাবার হোটেলে যখন ছিলাম তখন যদি এক তরকারী আর এক ডাল দিয়ে ভাত খেয়েছি, তো এখন মাশাআল্লাহ কোন বেলাতেই কয়েক প্রকার তরকারী ছাড়া খাবার টেবিল সাজেনা।
২) ছাত্রজীবনে এক কি দুই জোড়া কাপড়ে বছর পার করেছি তো বর্তমানে নিজ সংসারে স্ত্রী সন্তান নিয়ে যখন বিদেশ করছি তখন কম করে হলেও ৮/১০ জোড়া কাপড় তো আছেই, সাথে ফতুয়া, কোর্তা, স্যুট টাই আরো কত কি! বিদেশে অবস্থানের ব্যাপারটি তো বোনাস।
৩) ছাত্র জীবনে রাতে শোবার জন্য কাঠের চৌকিতে শক্ত ম্যাটের উপর শুয়ে বড়জোর ফ্যানের বাতাসে রাত কাবার তো বর্তমানে এ/সি রূমে রাজসিক পালং এ শুয়ে রাত কাটাবার সুযোগ দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা।
৪) বাবার হোটেলে যখন ছিলাম সরকারী বাসা/ভাড়া বাসায় দিন গুজরান করেছি, বর্তমানে নিজের পারিবারিক একটা পাকা দালান (গ্রামে) থাকার পরেও শহরে আর একটা বড় বাড়ি বুনার স্বপ্ন দেখছি।
নিজেকে মুসলমান ভাবি অথচ, ইসলামের যে কঠিন দুর্দিন যাচ্ছে দেশে, সে সময়ে ইনফাক ফি সাবিলিল্লাহর যে উচ্চতম ত্যাগের আদর্শ সৃষ্টির প্রয়োজন, এ ব্যাপারে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে যে পরিবর্তণ করা প্রয়োজন, পারিবারিক ঈদের বাজেট কমিয়ে সেই টাকা যে জরুরী ফান্ডে আহত নিহতদের পরিবারের জন্য বরাদ্দ করা প্রয়োজন এ দিকটা আমরা কয়জনে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছি?
মহান আল্লাহর বাণী, “হে ঈমানদারগন! আমি কি তোমাদের এমন এক ব্যবসার কথা বলবনা যা তোমাদের ভয়াবহ শাস্তি থেকে রেহাই দিতে পারে? তোমরা আল্লাহর রাসুলের উপর ঈমান আনবে এবং আল্লাহর রাহে তোমাদের জানমাল কুরবান করে জিহাদ করবে। এটাই তোমাদের জন্য সর্বোত্তম যদি তোমরা অনুধাবন করতে পার।”(সুরা সফ-১০-১১)।এই বাণীর নিরিখে যখন নিজের অবস্থানের কথা বিচার করি তখন নিজেকে মুসলিমদের তালিকায ভাবা কষ্টকর ঠেকে বৈকি।
আমরা অনেকে এই ভেবে গর্বিত হই যে আল্লাহ আমাকে ইসলামী আন্দোলনের একজন কর্মী হবার সৗভাগ্য দিযেছেন। কিন্তু সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের জন্য যে ত্যাগ, তিতিক্ষা ও কোরবানীর প্রয়োজন, বিশেষ করে বর্তমানের কঠিন সময়ের প্রেক্ষাপটে, তার কত ভাগ আমরা ফলো করছি, সবাইকে এদিকটা একটু ভেবে দেখতে হবে। এখন সময়টা এমন যে প্রয়োজনে এক বেলা রুটির খরচ কমিয়ে, অফিসের টিফিন খরচ হতে বাঁচিযে হলেও আন্দোলনের সাহায্যার্থে আমাদের এগিয়ে আসা মানবিক প্রয়োজন তো বটেই, সাথে সাথে তা আমাদের ঈমানের দাবীকে সত্য প্রমাণের হাতিয়ার। আসুন, পবিত্র রমজান মাসের এই মহিমাময় দিনগুলোতে দেশে-বিদেশে অবস্থানরত আমরা সবাই আমাদের জীবনযাত্রাকে নবীর (সাঃ) সুন্নাহ মোতাবেক সাজিয়ে নিতে এবং দ্বীনের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের মন-মানসিকতা গড়ার লক্ষ্যে মাসটিকে কাজে লাগাতে সচেষ্ট হই। আল্লাহ আমাদের সবাইকে বুঝার তৌফিক দিন, আমিন।
(পুনশ্চঃ যখন আমি এ প্রবন্ধটি লিখা শুরু করেছিলাম, তখন আমার নিজের ব্যাপারে অবস্থান এবং লিখাটি শেষ করে আমার যে অবস্থান তার মাঝে ফারাকটুকু আমি বেশ হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারছি। পূর্বে আমি ভাবতাম, সরল জীবন যাপন বা ত্যাগের ক্ষেত্রে আমি বেশ অগ্রসর। কিন্তু যখন এ ব্যাপারে লিখতে গিয়ে কিছু গভীর দৃষ্টিপাতের প্রয়োজন হলো তখন বুঝতে পারলাম, না, আমাদের আদর্শ মানবদের তূলনায় আমাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, সরল জীবনযাপন ইত্যাদির পার্থক্য এখনো আকাশ-পাতাল সম। আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করো, আর আমাদের ভিশু ভাইয়াকে তুমি তার এই সুন্দর আয়োজন, যার মাধ্যমে আমাদেরকে দ্বীনের হুকুম আহকাম গুলোকে ঝালিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন, তার উত্তম প্রতিদান দাও, আমিন।)
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৯ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রিযকের জন্য প্রত্যেক মুসলমানের উচিত আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন করা এবং হালাল রিযকের উপায় অবলম্বন করা ও হারাম থেকে বিরত থাকা। আপনার নিজের জীবনের উদাহরন টেনে অনেক সুন্দর লিখেছেন ভাইয়া এর বাইরে আর কিছু বলতে পারলাম না। জাযাকাল্লাহ। আল্লাহ্ আমাদের সবাইকে এভাবে আমল করার তৌফিক দিন
"সত্যি সত্যি মানুষ সীমালংঘন করে, এ কারণে যে, সে নিজেকে অভাবমুক্ত মনে করে।" (আল-কুরআন-৯৬, আয়াতঃ ৬-৭)
"প্রাচুর্যের লালসা তোমাদেরকে মোহগ্রস্থ করে রাখে, যতক্ষণ না তোমরা কবরে পৌঁছে যাও।" (আল-কুরআন-১০২, আয়াতঃ ১-২)
আল্লাহ্ আমাদের হেফাজত করুন।
এমন মানসিকতার আর কি ফল হবে?
মন্তব্য করতে লগইন করুন