প্রিয় বাবা, আপনার জান্নাত কামনা করছি, রাত্রদিন(৫)
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ১৯ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:২১:১৬ দুপুর
শেষ পর্ব
(খ) নামাজ এবং হিজাবে শিথিলতাঃ যতোদিন আমি ছিলাম পরিবারের কাছাকাছি, ততোদিন এ ব্যাপারে শিথিলতাকে কাছে ঘেঁষতে দেইনি। আপনার শিক্ষা এবং আমার সতর্ক দৃষ্টি দুটি মিলেই ভাই বোনদের হিজাব এবং নামাজের প্রতি আগ্রহী করে তুলেছিলাম। নিজ সংসারে গিয়ে বোনদের কাউকে কাউকে দেখি এখন হিজাবের প্রতি তেমন গুরুত্ব দিচ্ছেনা। নামাজ আদায়েও দেখেছি অনেকে গাফেল। এবং তাদের এই গাফলতির কুফল তাদের সন্তানদের প্রতিও ক্রমে ধেয়ে আসছে তীব্র সুনামীয় গতিতে। আমি না হয় চাকুরীর কারণে বিদেশে কাটাতে হয়েছে জীবনের অধিকাংশ সময়। কিন্তু আপনি বাবা হিসেবে এবং নানা হিসেবে ওদের কাছাকাছি থেকেও কি তাদের নামাজ/হিজাবের ব্যাপারে তাদেরকে সতর্ক করতে পারতেন না? সেটা কি আপনার দায়িত্ব ছিল না?
(গ) বিয়ে-শাদীতে ভিডিও কাহিনীঃ অন্যান্য বিয়ে-শাদীর কথা বাদ দিলাম। আপনার ছোট ছেলে (আমার একমাত্র ভাই) আজাদের বিয়েতে যখন আপনার নাতনীরা এলো আমার কাছে বিয়ের ভিডিও করার জন্য লোক ভাড়া করার আব্দার নিয়ে, আমি ওদের সেই অনুমতি দেইনি। ওরা এবার আপনার কাছে গেল একই আব্দার নিয়ে। আমার কাছে যে অনুমতি পায়নি, কথাটি বোধহয় আপনাকে বলেনি। যাক, আপনি কিছু না ভেবেই অনুমতি দিয়ে দিলেন। যখন ভিডিও ম্যান এলো, তা দেখে আমার হয়ে গেল মাথা গরম। তবে অনুষ্ঠানের অঙ্গহানি না হয়, তা ভেবে আমি উচ্চবাচ্চ না করে অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করে মসজিদে আশ্রয় নিলাম। কে কে জানি আমাকে মানাতে গিয়েছিল, আমি সিদ্ধান্তে অটল রইলাম। সেদিন আমাকে উদ্দেশ্য করে আপনার একটি উচ্চারণে আমি এতোই মর্মাহত এবং ব্যাথিত হয়েছিলাম যে (“থাক তোরা তোদের কাজ কর, হেতে তো আজীবনই গোঁয়ার আছিল”), পরবর্তীতে তা নিয়ে বাবা-পূত্রে কিছু মন কষাকষিও হয়েছিল। কর্মস্থলে গিয়ে আপনাকে আমি আমার অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিয়ে বেশ বিরাট একটা চিঠি দিয়েছিলাম, যেটাতে আমি ভারতীয় প্রখ্যাত এক মনস্তত্বঃবিদের লিখা হতে উদ্বৃতি দিয়ে, বাইরের লোক দ্বারা ভিডিও করা ললনাদের ছবি কিভাবে বিকৃতমনাদের হাতে গিয়ে সেটাকে তারা তাদের বিকৃত রুচির দ্বারা চোখের ও মনের যেনার ক্ষুধা মিটায় তা ব্যাখ্যা করে ‘তার ভাষাতেই’ লিখেছিলাম। পত্রটি ছিল একান্ত আপনাকে উদ্দেশ্য করেই লিখা, যা অন্য কেউ দেখার কথা নয়। আর একটি কথা, ইমাম সাহেব যা বলবেন, তাই অন্য সবাই পরবর্তীতে তাদের কথায় ও কাজে উদ্বৃত করবে প্রমাণ হিসাবে, এই প্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম, আমাকে এতগুলো ছেলেপুলের সামনে ‘গোঁয়ার’ আখ্যা দেয়া আপনার উচিত হয়নি।আপনিতো জ্ঞানে গুনে সবার ইমাম।
আমার সেদিনের সেই আশংকা কতো সত্য হয়ে প্রকাশ পেয়েছে আমার জীবনে, তার অনেক ঘটনা আপনার জানা নেই। আমি গোঁয়ার, কথাটাতো আমার শ্রদ্ধেয় বাবাই সীল মেরে দিয়েছেন আমার পিঠে। তাই ছোটরা এখন কথায় কথায় সেই উদ্বৃতি দিয়ে সামাজিক নানা উচ্ছৃংখল আর বে’শরা কাজে কতো বাধাহীনভাবে অংশ নেয়, সেটা দেখে আমার কলিজা টুকরা টুকরা হয়ে পড়ে। ওদের কথা হলো, আপনিতো আলেম মানুষ, আর আমি আলেম না হয়েও কি আপনার চাইতে বেশী বুঝি?এমন কি আমি ঐ ধরণের পত্র পাঠায়ে আপনার সাথে বেয়াদবী করেছি এমন কথাও শুনতে হয় এখন তাদের মূখে। যদিও আপনার জীবনকালে আপনি কখনো ঐ পত্র নিয়ে আমার সাথে কোন আলোচনা করেন নি।
আপনার মূখেই তো গল্প শুনেছিলাম সেই আপনার মাদ্রাসায় পাঠকালীন একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের কথা। ইসলামের নামে অর্জিত সদ্য স্বাধীন ‘পাকিস্তান’ এর তখন শৈশবকাল চলছে। ঢাকায় সফরে এলো পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব লিয়াকত আলী খান। সাথে তাঁর পত্নী। ইসলামী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পত্নীর মাথায় কাপড় নেই, হিজাববিহীন তিনি ঢাকার মাটিতে নামলেন বিমান থেকে, এ কেমন কথা? ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসা প্রাঙ্গনে অনুষ্ঠিত ইসলামী জলসায় বক্তাদের বক্তব্যে এই প্রশ্নটি তখন উঠে আসছিল বারবার। ছাত্রদের মাঝে তুখোড় বক্তা হিসেবে আপনার পরিচিতি থাকায় আপনাকেও দু এক কথা বলার সুযোগ দেয়া হলে আপনি আরবীতে প্রধানমন্ত্রী পত্নীর ঐ বেশরা কাজের জন্য মন্ত্রীকে তূলোধূনো করে ছাড়লেন। সভায় তুমুল হর্ষধ্বনি আর হাততালি পড়েছিল। সেই ১৯৫০ সন আর একবিংশ শতাব্দীর শুরু। মাঝখানে বেশ সময় গড়িয়ে গেছে, সাথে সাথে আমার বাবার চিন্তা চেতনায় ও এসে গেছে বেশ পরিবর্তন। কেন এমন হলো? চিন্তা করলে সেই একই উত্তর উঠে আসে আমার মাথায় – জ্ঞানের হক্ব আদায়ে অলসতা, আন্দোলনী জীবন থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখা, ক্যাডার সিস্টেমকে দায়ী ইলাল্লাহর কর্তব্য পালনে অন্তরায় মনে করা(?)
বাবা, আমি এসব কথা এখানে উল্লেখ করলাম, যাতে ইসলামী আন্দোলনের জিন্দাদিল কর্মীরা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণে এ থেকে কোন পজিটিভ শিক্ষা পেতে পারে। যাতে আপনার মতো সম্ভাবনাময় একটি কর্মী বা নেতাকে ভালো করে প্রষ্ফুটিত হবার আগেই আন্দোলনের মেজাজকে নিজের মাঝে ধারণ করতে না পারার কারণে, মাঝপথে হারিয়ে যেতে না হয়, অপশক্তির নিকট মাথা নত করতে না হয়। যাতে আন্দোলনের পথের শত বাধা বিপত্তি, উত্তাল ঝড়-ঝঞ্চা আর পাহাড়সম বাধাকে ডিঙ্গিয়ে বরাবর সম্মূখপানে যাত্রা অব্যাহত রাখতে সমর্থ হয়, দিকহারা না হয়ে পড়ে। তাই আশা করবো, আমার পত্রের এই পর্বে এসে আপনি আপনার এই সহজ, সরল সন্তানটিকে ভূল বুঝবেন না, বা কোন প্রকার পক্ষপাতদুষ্টতায় অভিযুক্ত করবেন না। বেজার হবেন না।
আচ্ছা বাবা, আপনি খুব অসন্তুষ্ট হলেন কি? শুনুন তাহলে একটি মজার গল্প, আশা করি আপনার মনঃকষ্ট দূর হবে এতে। এটা আপনার নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যাসাধণার সেই দিনগুলোর মধ্যকার একটা সময়। আপনি আপনার মাস্টার্স এর পর্বের কোন একটি পরীক্ষার জন্য তৈরী হচ্ছেন, বিষয় ইসলামের ইতিহাস। করাচী ভার্সিটির প্রাইভেট পরীক্ষার্থী। আমার বয়স তখন আর কতো, এই ১১/১২ বছর! আমার পরপর ছোট দুই বোন। একেবারে ছোটজনের বয়স হবে এক/দেড় বছর। সে বেশ কান্নাকাটি করছিল। আপনি তাকে সামলাতে কোলে তুলে বাম বুকের সাথে লাগিয়ে নিলেন। আপনার ডান হাতে পাঠ্যবই। আপনি ড্রইংরুমের একমাথা হতে অন্য মাথা পর্যন্ত হাঁটছেন সাথে সাথে পাঠক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। আপনি সরবে পড়ছিলেন একটি বাক্য যার দুটি শব্দ আমার কানে এখনো যেন জীবন্ত হয়ে বাজছে –“Abbaside Khilafat”. ঐ শব্দ দুটো আমাকে বেশ মজা দিচ্ছিল। আপনিতো আপন মনে আপনার প্রিয় ইতিহাস চর্চা করে যাচ্ছেন, আর আপনার এই সন্তান তখন সেটির যে অর্থ করেছিল, সেটি বোধহয় আপনাকে কখনো বলা হয়নি। তাই এখন শুনুন এবং মনের বেজার ভাবটি দূর করে নিন। জানেন আব্বা, তখন আমি ভাবতাম আপনি আমার কান্নারত বোনের কান্না থামাতে তাকে একটা খেলার খবরের সাথে নিজের সংযুক্তিতার কথা বলছেন। আপনি তাকে বলছেন, ‘(শুন মামনি), পথে খেলা চলছে (খেলা--ফত) আর আব্বা পথের পাশে দাঁড়িয়ে (আব্বা-সাইড) খেলা দেখছে’, হা. হা. হা. হা. হা………। (প্রসঙ্গতঃ এখানে বলে রাখা ভালো, করাচীতে আমাদের বাসার পাশের বিরাট মাঠে তখন নিয়মিত ফুটবল খেলা হতো।খেলা দেখতে পথের পার্শ্বে অনেক দর্শক জুটতো)।
প্রিয় বাবা, মানুষ ভূলের উর্ধ্বে নয়। তাই, আমাদের সবসময় সতর্ক থাকা দরকার, কখন মরদূদ শয়তান আমাদেরকে বিপথে নিয়ে না চলে যায়। আপনি সর্বদা সৎপথে থেকে আমাদেরকে পরিচালিত করেছেন, এইজন্য আমি দয়াময়ের নিকট সদাসর্বদা আমার মরহুম বাবার জন্য জান্নাত কামনা করছি, এই বলে ‘রাব্বির হাম হুমা কামা রাব্বাইয়ানি সাগিরা’।
(সমাপ্ত)
(বি: দ্র: প্রিয় ব্লগারগন, আপনাদের সবার কাছে আমার চির সহজ, সরল, জাঁকঝমকহীন ও নিরহংকার জান্নাতবাসী বাবার জন্য দোয়ার অনুরোধ রইল)।
বিষয়: Contest_father
১৬৬৮ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এত্তো মিল কেমন করে হয়!!
যেন নিজের কাহিনী অন্যের বর্ণনায় শুনছি(পড়ছি)- এমনটাই মনে হলো!!
*************
স্থান-কাল-পাত্র এবং ঘটনা ও তথ্যের পার্থক্য থাকলেও জীবনযুদ্ধের পারিবারিক ও পারিপার্শিক চিত্র ও ঘটনাপজ্ঞী, আপনার বর্ণিত বিভিন্ন ঘটনা, -শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের কয়েকদিন পূর্ব থেকেই... সবার খোঁজখবর.. বাবা/আব্বা বলা, বড় সন্তান হিসেবে সেই ১৬/১৭ বছর বয়স হতেই সাংসারিক দায়িত্ব পালন, আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টিও... সেলায়ে রেহেমী.. আজকে এই ৫৬ বছর বয়সে, এমনকি দীর্ঘদিন কোন পত্র না পেয়ে অভিমান করে কোন একটি চিঠিতে দুঃখ প্রকাশ এবং তার জবাবে আপনাকে লেখা আপনার আব্বার চিঠি... এবং আরো অনেক কিছুই আমার ও আব্বার সাথে মিলে যায়!!
*************
তফাতের জায়গাগুলো- আমার আব্বার শিক্ষা ও পেশা, আব্বার ইন্তেকালের চার বছর পর আম্মার ইন্তেকাল, ভাই-বোনেরা মনে করতো- আমার মতামতই আব্বার ইচ্ছা, তিনিই সে সুযোগ করে দিয়েছিলেন, বিচ্ছিন্ন দু-একটা ঘটনা ছাড়া!
*************
সকল মুমিন পিতা-মাতার জন্য দোয়া করি-
আল্লাহুম্মাগফিরলানা ওয়া লি ওয়ালিদীনা ওয়া লিল মুমিনীনা ইয়াওমা ইয়াকুমুল হিসাব(আমীন)
ভালো থাকুন, সুস্থা থাকুন এ কামনা।
যাক, ব্লগে লিখার অনুমতির হক্ক ঠিক ভাবেই আদায় করছেন।
বাবার জানাজা কাঁধে নিতে পারিনি বলে মনে অনেক কষ্ট রয়ে গেছে। আপনাদের সবার দুয়া সামিল করে সেই কষ্টকে লাঘবের প্রচেষ্টায় ভাই এই প্রয়াস।
পাচ পর্বে লিখা বাবার অসমাপ্ত জীবনের মুল অংশগুলো পড়ে খুবই ভাল লেগেছে। সাথে ভাবছি, বাপরে বাপ! ফাস্ট হওয়ার জন্য প্রতিযোগীতায় আমাকে হারিয়ে দিলেন। ভাল লাগল, একজন সন্তান আর পিতার মাঝে গড়ে উঠা অব্যস্ত ভালবাসার কথাগুলো সঠিক ভাবে উপস্থাপন করার ঢং দেখে। ধন্যবাদ। আপনার বাবাকে আল্লাহ জান্নাতের্ উচ্চস্থান দান করুন। অামীন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন