প্রিয় বাবা, আপনার জন্য জান্নাত কামনা করছি, রাত্রদিন- (৪)

লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ১৮ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:৪৬:৩৩ দুপুর

Click this link

বাবা, আপনি যেমন অনেক দিক দিয়ে আমার ও আমার অপরাপর ভাই বোনদের আদর্শ কিংবা আইডল, মানুষ হিসেবে আপনার কিছু কিছু ভূলত্রুটিও যে ছিল না এমন নয়, বরং না থাকাটাই হতো অস্বাভাবিক। এগুলোর মধ্যে এমন দু একটি ভূল এমন ছিল যার কথা ভাবলে আমি যেন ভাবনার খেই হারিয়ে ফেলি। মাথায় শুধু একটি প্রশ্ন ঘুরে ফিরে তখন, কেন এমন হলো, এমনটি তো হবার কথা ছিল না। বাবা, আপনি নেই, চলে গেছেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে, এখন আপনার সেসব শর্টকামিংস্ নিয়ে এখানে ওপেন আলোচনা করাটা ঠিক হবে কি হবে না, তা বুঝতে পারছিনা। তবে আমি নিয়্যত বিশুদ্ধ রেখে (যে নিয়্যতের উদ্দেশ্য আপনার গীবত নয়, বরং উম্মাহর বৃহত্তর স্বার্থের কথা বিবেচনায় রেখে)যদি কয়েকটা বিষয় উল্লেখ না করি তাহলে এই লিখাটি যেন অপূর্ণ থেকে যাবে বলে বিশ্বাস করি, তাই সেই বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষার্থে এখানে কয়েকটি বিষয়ের সংক্ষিপ্ত আলোচনা করবো, আল্লাহ তুমি আমায় ক্ষমা করো, আর আমার বাবাকেও ক্ষমা করো।

১) ইসলামী আন্দোলনের সাথে মনদিল দিয়ে জড়িত না হওয়াঃ একথা ঠিক যে সঠিক ইসলামী জীবন ব্যবস্থা বলতে কি বুঝায়, এর প্রাথমিক পাঠ আমি আপনার নিকটেই পেয়েছি। তখন আমরা করাচীর বাসিন্দা। ইসলামী চিন্তা-চেতনায় তখন আপনি ছিলেন বেশ অগ্রসর, মাওলানা মওদূদীর (রহঃ) ভক্ত হিসেবে তাঁর লিখিত বড় বড় সব উর্দূ কিতাবে আপনার ড্রইংরূম ছিল ঠাসা। দেশ স্বাধীনের পর যখন ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরার ব্যাপারটি চূড়ান্ত হলো, তখন সন্তানসম প্রিয় কিতাবগুলোকে অতীব কষ্টে স্থানীয় এক কর্মীর লাইব্রেরীতে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেন। আমিও ছিলাম সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতার নীরব সাক্ষী। তবু কিছু কিছু বই হাতছাড়া করেননি, সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। ১৯৭৩-৭৫ সাল ছিল নূতন দেশে ফিরে নূতন করে সেট্ল হবার এক প্রাণান্তকর যুদ্ধ। যে জীবন সংগ্রামে অবশ্য আমাকেও ১৬/১৭ বছর বয়সেই যুক্ত হতে হয়েছিল।মাওলানা মকবুল আহমদ সাহেব আমাদেরই এলাকার নেতা। তিনি সব সময় খোঁজ খবর নিতেন। স্থানীয় নেতাদের সাথে ভালো পরিচয় ছিল, উঠাবসাও ছিল। মাওলানা আব্দুল লতিফ সাহেব ছিলেন একান্ত বন্ধু মানুষ। তাঁর সাথে বহু মাহফিল একত্রে বক্তৃতাও করেছেন। ভালো লাগতো যে আপনার জ্ঞানের ভান্ডার হতে কিছুটা হলেও জনগনের জন্য উপহার যাচ্ছে, জ্ঞানের হক্ক আদায় হচ্ছে। কিন্তু আপনাকে কখনো আন্দোলনের নিয়মিত কর্মী হিসেবে পাইনি। সময়ের সাথে সাথে যেন আন্দোলনের সাথে একটা দূরত্বও তৈরী হচ্ছিল। কৌতুহলী হয়ে একবার কারণটা জিজ্ঞেস করায় যা জানালেন তা তেমন মনঃপূত হয়নি। বলেছিলেন – জামায়াত ৭১ সনে পাকিস্তানীদের অন্যায় অত্যাচার সত্ত্বেও তাদের সাপোর্ট চালিয়ে গিয়ে ভূল করেছিল, যে জন্য আজ জামায়াত জনগনের সামনে যেতে পারছেনা। জামায়াতের সামাজিক ওয়েলফয়ার বিষয়ক কাজে কর্মে শিথিলতার কথাও আপনার আলোচনায় উঠে আসে। তবে, যা দেখে আমার কষ্ট হতো বেশী তা হলো, আপনি দিন দিন নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছিলেন, আপনার কর্মক্ষেত্র সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে আপনার পাঠাগারের মাঝে। পূর্বে যে ওয়াজ মাহফিলে যোগ দিতেন সেই উৎসাহেও দিন দিন ভাটা পড়ে যায়। এভাবে একটা সম্ভাবনাময় প্রতিভাকে যেন আমি ক্রমে ক্রমে নিঃশষ হয়ে যেতে দেখেছি।

আপনি আপনার জ্ঞান ও ডিগ্রি অনুযায়ী আন্দোলনের মাঝে কোন বড় পদবী পাবার আগ্রহী ছিলেন কিনা, অবশ্য সে ব্যাপারে আমার কোন ধারণা নেই। বিষয়টির অবতারণা এজন্যই করলাম যে, অতীতে অনেক সম্ভাবনাময় দ্বীনের দায়ীকে ক্যাডার সিসটেম এর বাইরে গিয়ে পদবী না দেয়ায় ক্রমে তাদেরকে আন্দোলন হতে ছিটকে যেতে দেখেছি। এতে আন্দোলনের কোন ক্ষতি তো হয়নি, বরং তাঁদেরকেই ক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে দেখেছি। আমার একথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে জামায়াতের এই ক্যাডার সিসটেম এর কারণেই আন্দোলন আজ তার চলার পথের শত বাধা বিপত্তি ডিঙ্গিয়ে এতোদূর অগ্রসর হতে পেরেছে। সাধারণ মানুষের মনের মণিকোঠায় স্থান করে নিতে পেরেছে। এই ক্যাডার সিসটেম এর ছাঁকনির মাধ্যমে বের হয়ে আসতে হয় বলেই, মাওঃ দেলোয়ার হোসেন সাঈদী-র মতো বিশ্ববরেণ্য আলেমগন ও দীর্ঘদিন আন্দোলনের সাথে যুক্ত থেকেও সামনের কাতারে যেতে তাঁদের অনেক দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে, অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে। ক্যাডার এ অবিশ্বাসীদের অনেকে তো তাকেঁ দলপ্রধানের ভূমিকায় দেখতে অনেক আগে থেকেই মানসিকভাবে তড়পাচ্ছিলেন। বিদেশ সফরে গেলে নানা বৈঠকে তাঁকে এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি দৃঢ়ভাবে ক্যাডার সিস্টেম এর পক্ষেই সব সময় তাঁর মতামত দিয়েছেন। আমি এও বিশ্বাস করি, ক্যাডার সিস্টেম এর ছাঁকনি দিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন বলেই আজ ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের অন্যায় অবিচারের মূখে মৃত্যুদন্ড মাথায় নিয়েও তিনি ওদের সাথে কোন আপোষরফা করেন নি, আপোষ করেন নি ছাত্রনেতা যুবক দেলোয়ার হোসেনও। ক্যাডার ও নন্ ক্যাডার সিস্টেম এর মধ্যকার বিরাট পার্থক্য সমকালীন দুটি ইসলামী আন্দোলনের গতিপথকে কিভাবে প্রভাবিত করে এবং কিভাবে একটিকে অপরটির থেকে ভিন্ন ও উজ্জলতর অবস্থানে নিয়ে উন্নীত করে, তার প্রমাণ আমরা দেশবাসী সবাই এই দুয়েক সপ্তাহ আগেও প্রত্যক্ষ করেছি। অথচ আজ যদি সাঈদী সাহেব ক্যাডারভিত্তিক আন্দোলনের সাথী না হয়ে ব্যক্তিগত ভাবে ওয়াজ নসীহতই করে যেতেন, তাহলে তাঁকে সরকারের রোষানলে পড়তে হতোনা। তিনিও মাঝে মাঝে বাধা পেলে, সরকারকে ‘বন্ধু’ সম্বোধন করেই হয়তঃ তাঁর ওয়াজ করার অনুমতি নিয়ে নিতে চেষ্টিত হতেন।

প্রিয় আব্বা, তাই পূত্র হিসেবে আমার মনে আপনার সম্পর্কে এই শংকা রয়েই গেল যে, মহান আল্লাহ আপনাকে যেই জ্ঞান গরিমা দিয়েছিলেন, আপনি সেই জ্ঞানের হক্ব পুরো আদায় করতে পেরেছিলেন কিনা! এই ব্যাপারে হাশরের মাঠে প্রভূর করা প্রশ্নের কি জবাব আপনি দিবেন সেই চিন্তায় আমি কাতর। আপনার ব্যক্তিত্বের এই দিকটি সম্পর্কে আমি আমার মনোভাব কিন্তু আপনাকে একটি কবিতার মাধ্যমে সেই নব্বইয়ের দশকে চীন থাকতে পাঠিয়েছিলাম, যা কিনা আপনার এক নাতি ফ্রেমে বাঁধাই করে আমাদের বাসার ড্রইং রূমে টাঙ্গিয়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ বুঝা গেল, আপনি নিজেও স্বীকৃতি দিয়েছেন আপনার সেই নিষ্ক্রিয়তার।

(২) শরীয়তি ব্যাপারগুলোতে পরবর্তীতে প্রশ্রয় দেয়ার প্রবণতাঃ বাবা, আন্দোলনী জীবনে আপনার দুঃখজনক নিষ্ক্রিয়তার পথ ধরেই চলে আসে পরবর্তীতে আপনার ব্যক্তিজীবনেও কিছু নির্লিপ্ততা, কিছু নিষ্ক্রিয়তা এবং কিছু আপোষকামিতা। যার দু একটি উদাহরণ এজন্য এই পর্বে দিতে চাইছি, যাতে পাঠক পাঠিকাগন এ থেকে উপকৃত হতে পারেন:

(ক) শৈশবে দেখেছি টিভি-র প্রতি আপনার বেশ বৈরীতা, যা পরবর্তীতে মানে আপনার জীবনের শেষভাগে আর দেখা যায়নি। মনে পড়ে শৈশবে সাদাকালো টিভি-র যুগে আমরা ভালো কোন জনপ্রিয় অনুষ্ঠান দেখার জন্য কতোই না কাকুতি মিনতি করেছি, পারমিশন তেমন একটা পেতাম না। পরবর্তীতে, আলাদা বেডরুম থাকার সুবাদে, সেটাকে কাজে লাগিয়ে রাত্রি গভীরে দেয়াল টপকে বন্ধুদের বাসায় গিয়ে প্রোগ্রাম দেখে আবার দেয়াল টপকে ঘরে ফিরতাম, আপনাকে ফাঁকি দিয়ে। অথচ আপনার জীবনে একটি সময় এলো, যখন টিভি প্রোগ্রাম নিয়ন্ত্রণে আপনাকে ভূমিকা নিতে খুব একটা চোখে পড়েনি। ৪/৫ বছরের শিশুটিও দিব্বি টিভি খুলে ভারতীয় সিনেমার গান দেখছে আপনার ড্রইং রূমে বসেই। হতে পারে তা আমার বাড়িতে স্বল্পকালীন অবস্থানের দৃষ্টিভ্রম কিংবা বুঝার কমতি, কিন্তু যা দেখেছি তাতে মনে কষ্টও কম পাইনি।

(চলবে........)

বিষয়: Contest_father

১৫১৭ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

209513
১৮ এপ্রিল ২০১৪ দুপুর ০৩:৫৪
গেরিলা লিখেছেন : ভালো লাগলো ধন্যবাদ
১৮ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:১৬
158007
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ধন্যবাদ, প্রথম মন্তব্যকারী হবার সুবাদে। অন্য পর্বগুলোও পাঠের আমন্ত্রণ রইল।
209531
১৮ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:১৬
শিশির ভেজা ভোর লিখেছেন : প্রতিটা মানুষের জীবনেই এই ঘটনাগুলি ঘটে থাকে। অনেক সুন্দর হয়েছে ... চালিয়ে যান। আরো বেশী বেশী লিখুন
১৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০২:২৭
158248
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ধন্যবাদ ভাই সুন্দর মন্তব্য এবং উৎসাহ প্রদানের জন্য। আশা করি সব পর্বের সাথে থাকবেন।
209552
১৮ এপ্রিল ২০১৪ বিকাল ০৫:৫৮
সুমাইয়া হাবীবা লিখেছেন : বাবা নিয়ে সিরিজ! ইউনিক আইডিয়া! Applause Applause
১৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০২:২৯
158249
ইবনে হাসেম লিখেছেন : মডু মামাদের সেজন্য ধন্যবাদ জানাতে হয়, উনারাই ৫ টি পর্যন্ত দেয়া যাবে বলে কথা দিয়েছেন।
209602
১৮ এপ্রিল ২০১৪ সন্ধ্যা ০৭:৩৪
শেখের পোলা লিখেছেন : ইবনে হাশেম ভাই, সবার মন মেধা, বিবেচনা আল্লাহ এক রকম দেননি, যার কারনে আমরা আপনজনেরাও কোন বিষয়ে এক মত হতে পারিনা৷ সব কিছুর মূলে আছে ইমান, যা এক মাত্র আল্লাহই দেখেন৷ ধন্যবাদ৷
১৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০২:৩২
158250
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর মন্তব্যের জন্য। জ্বি, সব কিছুর মূলেই রয়েছে ঈমান, ঈমানের কম বেশী হয় বলেই আমরা এক এক মানুষ এক এক দৃষ্টিকোন থেকে কোন বস্তু বা বিষয়কে বিচার করে থাকি। আর যার সংযোগ কোরআন হাদিস ও ইসলামী সাহিত্যের সাথে যত বেশী থাকবে তার ঈমান ও ততো পাকা হবে, সাথে অবশ্য জ্ঞান অনুযায়ী তা বিতরণের/কার্যক্ষেত্রে প্রয়োগের কাজটিও করে যেতে হবে, যাতে জ্ঞানে জঙ বা মরিচা না ধরে.....
209717
১৮ এপ্রিল ২০১৪ রাত ১০:৪৩
প্যারিস থেকে আমি লিখেছেন : ভালো লাগতেছে।
১৯ এপ্রিল ২০১৪ রাত ০২:৩৩
158251
ইবনে হাসেম লিখেছেন : ধন্যবাদ সাথে থাকার জন্য।
১৯ এপ্রিল ২০১৪ সকাল ১০:২১
158413
মুহছিনা খাঁন লিখেছেন : এই যেটা আমার পোষ্টে লেখেছি বাবাকে নিয়ে লিখা যেনো মহাকাব্য রচনা করলেও থেকে যাবে। ঠিক আপনার সরিজ লিখা পড়ে খুব ভালো লাগলো যেখানে আদর্শ আছে ভালোবাসা আছে পছন্দ অপছন্দ আছে। আরো সুন্দর হোক লিখার গতি দোয়া রহিলো।
223181
১৮ মে ২০১৪ রাত ০৯:৪৯
প্রবাসী মজুমদার লিখেছেন : মাওলানা মওদূদীর (রহঃ) ভক্ত হিসেবে তাঁর লিখিত বড় বড় সব উর্দূ কিতাবে আপনার ড্রইংরূম ছিল ঠাসা। দেশ স্বাধীনের পর যখন ১৯৭৩ সালের শেষের দিকে বাংলাদেশে ফিরার ব্যাপারটি চূড়ান্ত হলো, তখন সন্তানসম প্রিয় কিতাবগুলোকে অতীব কষ্টে স্থানীয় এক কর্মীর লাইব্রেরীতে নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেন। আমিও ছিলাম সেই কষ্টকর অভিজ্ঞতার নীরব সাক্ষী। তবু কিছু কিছু বই হাতছাড়া করেননি, সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন।

জ্ঞানের পাদদেশে দাড়িয়ে থাকা এসব মানুষগুলোই অন্যরকম। কোরআন হাদিসের সে্ বিশাল লাইব্রেরী রেখে আসার কি যাতনা তা বুঝি বলেই কষ্ট পেলাম। ধন্যবাদ। আপনার পিতাকে আল্লাহ অবশ্যই জান্নাতের উচ্চ স্থানে আসীন করবেন।
১৯ মে ২০১৪ দুপুর ১২:৪২
170696
ইবনে হাসেম লিখেছেন : সব সময় সেই দোয়াই করে যাচ্ছি রহমানুর রহীমের দরবারে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File