প্রিয় বাবা, আপনার জান্নাত কামনা করছি প্রতিনিয়ত (৩)
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ১৮ এপ্রিল, ২০১৪, ০৮:৩৫:৩৫ সকাল
Click this link
টাইমলাইনের পিঠে ভর করে চলুন, চলে যাওয়া যাক সেই সত্তুর দশকের প্রথমার্ধে। ১৯৭৩-৭৫ সালে। নূতন বাংলাদেশ, নূতন সরকার। যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চলছে চরম দূর্ভিক্ষ। আহা! কত হাজার হাজার মানব সন্তান ক্ষুধার জ্বালায় নিজের মান-সম্ভ্রম বিক্রি করে দিয়েও শেষ রক্ষা পায়নি, কাতারে কাতারে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে। ডাস্টবিন থেকে মানবে আর কুকুরে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ির এন্তার দৃশ্য রূপায়িত হয়েছে। শরীরের আব্রু ঢাকতে বঙ্গললনাকে মাছ ধরার জাল ব্যবহার করতে হয়েছে, সে আরো কতো হাজার হাজার করুণ দৃশ্য! বলে তো শেষ করা যাবেনা। সেই কঠিন দুঃসময়েও সরকারী অফিসের সামান্য সহকারী চাকুরীর উপরই নির্ভর ছিল আপনার বৃহৎ পরিবারের ভরণপোষণের ভার। আপনি ঢাকায়, আর আমরা অবস্থান করছিলাম গ্রামের বাড়িতে। প্রতি মাসের শেষভাগে ট্রেনে করে এসে রেশন হতে পাওয়া ডাল-চাল-গম-চিনি দিয়ে যেতেন আমাদের জন্য। সেই যুবক বয়সে আপনার এই হাড়ভাঙ্গা খাটুনী আর ফুলের টোকা দেয়া শরীরের বেহাল দশা দেখে আমার যে কি কষ্ট হতো, তা কোনদিন কাউকে বলতে পারিনি। সামান্য কৃষক পরিবারের সন্তান হয়েও, পরিবারের সবার ছোট ছেলে হিসেবে আপনাকে কোনদিন জমির ধারে যেতে হয়নি, বরং মেধাবী ছাত্র হিসেবে মাদ্রাসা/কলেজের চৌকাঠগুলো নিজের স্কলারশীপের টাকায় সহজে ডিঙ্গোতে পারার সুবাদে সবারই ছিলেন চোখের মণি, জাহানপুর মোল্লা বাড়ির আপনিই ছিলেন জ্ঞানের প্রথম আলোকবর্তিকা। জ্ঞানসাধনার প্রচেষ্টায় একে একে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবোর্চ্চ ডিগ্রিও নিয়ে ফেলেছেন তিন তিনবার (টৃপল এম.এ.)। তাই কায়িক পরিশ্রমের সাথে কখনো পরিচয়ই ছিলনা আপনার। আর নূতন এই পরিস্থিতিতে? গায়ের রং ফরসা, শান্ত, সৌম্য চেহারার মানুষটি- কায়িক পরিশ্রমে পরিশ্রান্ত বাবা যখন বাড়ির দহলিজে রিক্সা থেকে টেনে টেনে আটা, চালের বস্তা নামাতেন তখন আপনার বিধ্বস্ত চেহারা দর্শনে অন্তরটা কষ্টে মোচড় দিয়ে উঠতো। কিন্তু আপনাকে দেখতাম অবিচল, আবেগহীন এবং প্রভূর প্রতি কোন অভিযোগহীন এক নিষ্ঠাবান মানুষ। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির যখন আরো অবনতি হচ্ছিল, আট ভাই-বোনের (নয়জনের মাঝে বড় বোনের অনেক আগেই বিবাহ হয়ে যায়) আমাদের বৃহৎ সংসারে ও সেই দূর্ভিক্ষের ছোবল বার বার হানা দিচ্ছিল। ছোট ভাই-বোনরা স্কুলে যেতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছিল। অবশ্য মোল্লা বাড়ির ঐতিহ্য অনুযায়ী মেয়েরা ফোর পাশ করার পর আর স্কুলে যেতে পারতোনা। এ পরিস্থিতিতে অথোর্পার্জনে আপনাকে সাহায্য করতে এবং ছোটদের শিক্ষা প্রদানের তাগিদে অবশেষে ঢাকায় বাসা ভাড়া করে আমাদের সবাইকে নিয়ে যান। অর্থোপার্জনে আপনাকে সাহায্য করতে ইন্টার পরীক্ষা না দিয়েই ঢাকায় এক পণ্যের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে যোগদান করি।
সেই কঠিন দিনগুলোতেও আমার পিঠাপিঠী বোনটিকে দয়াময়ের রহমতে সুপাত্রে পাত্রস্থ করেছিলেন, একপ্রকার কোন বাড়তি খরচ ছাড়াই। আল্লাহর কি অপার মহিমা, আমার অপরাপর শিক্ষিতা ছয় বোনের স্বামীরাও কিন্তু যোগ্যতায় কেউই কারো চাইতে কম নয়, হয়তঃ বা ১৮/২০ এর তফাৎ হতে পারে। কিন্তু স্কুলের গন্ডী পেরুতে না পারা এ বোনটির ভাগ্য এমনই ছিল যে, তখনো ছাত্র তার মাদ্রাসা পড়ুয়া স্বামী, কালে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলার, কিং আব্দুল আজিজ বিশ্ববিদ্যালয়সহ পাশ্চাত্যের একটি বিশ্ববিদ্যালয়েও স্কলারশীপ নিয়ে ভাষার উপর ডক্টরেট করেছিলো, এবং লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে অকালে ঝরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত দেশের মাদ্রাসা ও আধুনিক শিক্ষাংগনে নিজের পান্ডিত্যের ছাপ রেখে যেতে সমর্থ হয়েছিল।
বাবা, সরল ও চাকচিক্যবিহীন নির্ভেজাল জীবন যাপনে অভ্যস্ত আপনার জীবন থেকে আমি ও আমার অপরাপর ভাই বোনেরা অনেক কিছুই নিজেদের জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে সমর্থ হয়েছিলাম, এ কথা স্বীকার করতে কোন দ্বিধা নেই। ১৯৭৩ সালে যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আপনার ১৫ বছরের করাচীর জীবনের সমাপ্তি ঘটিয়ে যখন বাংলাদেশে ফিরলেন, তখন তো আপনি তিন তিনটি বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি হোল্ডার। স্বভাবতঃই তাই মনে বাসনা জাগলো সরকারী অফিসের সহকারীর পদ ছেড়ে কলেজ/বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন। যেমন ভাবা তেমন কাজ। একদিন সরকারী কলেজে প্রভাষকের পদ খালির বিজ্ঞাপন দেখে দরখাস্ত পাঠিয়ে দিলেন ভাগ্য পরীক্ষায়। যথাসময়ে ইন্টারভিউ হলো এবং নির্দিষ্ট দিনে কর্মসংস্থান অফিসের বোর্ডে কৃতকার্যদের তালিকায় আপনার নাম দ্বিতীয় নম্বরে দেখে আনন্দে আহলাদিত হলেন। মূহুর্তে আপনজনদের মাঝে সংবাদটি প্রচারিত হয়ে গেলো, মাওলানা হাসেম সাহেব কলেজ শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে যাচ্ছেন। সালা সম্বন্ধীরা ইতোমধ্যে নামের আগে প্রফেসর লক্বব জুড়ে দিয়ে ডাকা শুরু করলো। কিন্তু হায়!! তখন যে এদেশের সব কিছুতেই ব্যাকডোর দিয়ে মামার জোর খাটিয়ে চাকুরীতে নিয়োগ পাওয়ার রেওয়াজ চালু হয়ে গেছে, সরলমনা মানুষটির সেই সংবাদটি জানা ছিলনা। তাই চোখ বুঁজে অপেক্ষা করতে থাকলেন কখন এ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটারটি হাতে আসবে। দিন যায়, সপ্তাহ যায়, মাস যায়, দেড় মাস পরে বন্ধু বান্ধবের পরামর্শে আবার গেলেন সরকারী কর্ম কমিশন অফিসে, নিয়োগপত্র পেতে দেরী কেন জানতে। কিন্তু গিয়ে যা শুনলেন, তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না মোটেই। জানানো হলো, প্রার্থীর কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে (আসলে তারাই প্রার্থীকে চিঠি দিয়ে জানানোর কথা) তারা ওয়েটিং লিস্ট থেকে একজনকে অলরেডী আপনার পরিবর্তে নিয়োগ দিয়ে দিয়েছে। সেই যে ভাঙ্গা মন নিয়ে গৃহে ফিরলেন, আর কখনো দেশে বড় কোন পদের জন্য চেষ্টাই করেন নি। ভেবে নিয়েছিলেন, এটাই আপনার অদৃষ্টের লিখন।
এর অল্প কিছুদিন পরে অন্য আর একটি ঘটনায় আপনি আপনার সাদামাটা নিয়তির লিখনের কাছে পুরোপুরী আত্মসমর্পণ করেছিলেন। সৌদী আরবে তাদের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে লাইব্রেরীয়ানের একটি সরকারী পদে নিয়োগের জন্য দরখাস্ত আহবান করা হয়। পদটির সাথে আপনার তখনকার চাকুরীর সাজুয্যতা থাকায় নুতন উদ্দীপনা নিয়ে সেখানে দরখাস্ত পাঠিয়ে দেন। আরবী ভাষায় দক্ষতার বাড়তি যোগ্যতাটুকু থাকায় এবার দ্বিগুন আশায় বুক বাঁধলেন, পবিত্র ভূমিতে যাবার সুযোগটি বুঝি এবার হাতের মুঠোয়। এখন শুধু প্রতীক্ষার প্রহর গুনছেন, এক, দুই, তিন….। প্রতীক্ষার যেন আর শেষ হয় না। অবশেষে মাস দুয়েক পরে সব প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে স্বপ্নের দেশ থেকে এলো সুদৃশ্য ডোরাকাটা নীল খাম। গভীর আগ্রহভরে নিমিষে খাম চিরে বের করে নিলেন সৌদী সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সেই বহুল প্রতিক্ষীত চিঠিটি, যে চিঠিতে লেখা ছিল অন্য কিছু। সালাম কালাম জানিয়ে তারা যা লিখে পাঠালো তার সারমর্ম হলো: জনাব, আমরা আপনার দরখাস্ত পেয়ে খুশী হলাম। তবে আমাদের প্রার্থীর যোগ্যতা হিসেবে শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল মাত্র বি এ পাশ। কিন্তু আপনি তিন বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রীধারী। আপনার যোগ্য কোন পদ এখনো আমাদের মন্ত্রণালয়ে তৈরী হয়নি বিধায়, আপনাকে আমরা এ মূহুর্তে কোন নিয়োগপত্র দিতে পারছিনা বলে ক্ষমাপ্রার্থী। আপনার দরখাস্তটি আমরা ফাইলে সযত্নে রেখেছি। ভবিষ্যতে উক্ত যোগ্যতার কোন পদ সৃষ্টি হলে অবশ্যই আপনাকে আমরা আমন্ত্রণ পাঠাবো, ইনশাআল্লাহ…।আপনার বৈষয়িক বুদ্ধিহীনতায় তখন নিকটজনদের অনেকেই আড়ালে আবড়ালে আপনাকে মন্দ/বোকা বললেও, আপনি তা নিয়ে কখনো কোন আফসোস করেছেন বলে মনে পড়ে না।
সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীন আর্কাইভস এন্ড লাইব্রেরীতে সামান্য বেতনে চাকুরী করে রিটায়ারমেন্টে যাবার পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত (১৯৯২ সালে) কিভাবে ১০/১২ জনের বিরাট পরিবারকে শতভাগ সৎ উপার্জন দিয়ে দুনিয়াবী হিসেব কিতাব মতে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন সফলতার দ্বার প্রান্তে, তা আমার নিকট একটি মিরাক্যাল এর মতোই।ছোট চাকুরী করলেও আপনার উচ্চশিক্ষার কারণে ঘরে বাইরে সবার কাছে ছিলেন আলাদা মর্যাদার অধিকারী, অফিসে আপনার নিক নেম ছিল মাওলানা সাহেব। ছোট বড় সবাই এমনকি বিগ বস্ ও এই নামেই আপনাকে সম্বোধন করতো। আপনার মেয়েদের বিয়ে দিতেও আপনাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি, বেগ পেতে হয়নি। খুব অল্প খরচে (গড়ে এক মেয়ের বিয়েতে দেড় লাখের বেশী খরচ হয়নি)সাত সাতটি মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কাউকে কোন যৌতুক দিতে হয়নি।(এখানে অবশ্য আমার প্রিয় মামাদের সহযোগিতার কথা না বললে আমি আল্লাহর কাছে দায়ী থাকবো) বরং আপনার বন্ধুমহলে আপনার এমন ইমেজ ছিল যে, কেউ আমার বোনদের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসলে, যারা যৌতুকের প্রত্যাশী বলে আঁচ করা যেতো, তাদেরকে আমাদের বাসার সীমানায় ঘেঁষার পূর্বেই বলে দেয়া হতো যে, যৌতুক প্রত্যাশী কেউ থাকলে দয়া করে যাবেন না, কারণ হাসেম মাওলানার মেয়েদের বিয়েতে কখনো কোন যৌতুকের দাবীদাররা গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। এতে, পাত্র পক্ষও অপমান হতে বাঁচতো, আমাদেরও সময়ের সাশ্রয় হতো বেশ। আলহামদুলিল্লাহ, সবচাইতে ছোট বোনটি ছাড়া অন্য সবাই মোটামুটি ভালো ঘর-বর পেয়েছে(দুইজন ডক্টর-প্রফেসর, দুইজন বড় ব্যবসায়ী, দুইজন চাকুরে হলেও সম্পদশালী, ছোটজনও যে কম যোগ্য তা নয়, তবে তূলনামূলকভাবে সম্পদ একটু কম, এই যা।
বাবা, আপনি যখন গত বছরের এমন দিনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন, দেশে বিদেশে আপনার ৯ সন্তানের ঘরে ২৩ নাতি নাতনী এবং আরো ১৭ জন পুতি (গ্রেট গ্রান্ড সান/ডটার) সহ মোট ৪৯ জনের বংশধর রেখে যান। এটাও তো এক হিসেবে আপনার বিশাল একটি কৃতিত্ব। এরা সবাই তাদের দাদা/নানা/বাবার জন্য দোয়া করলে আপনার পুলসিরাত পার হতে কি বেশী কষ্ট হবে? আপনার এই ছেলে চাকুরী জীবনের বেশীর ভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েও দুইজনের বেশী সন্তান নিতে সাহস করেনি, নানাবিধ কারণে। এই একটি স্থানে এই হতভাগা সন্তান আপনাকে সঠিকভাবে অনুসরণ করতে পারিনি, তাই আমি বেশ লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী।
(চলবে.....)
বিষয়: বিবিধ
১৪০১ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাই
||
অনেক বড় পরিবার। আপনার বাবার শিক্ষা সম্পর্কে জেনে খুব ভাল লাগল। ঐ সময়ে এ ধরনের শিক্ষিত খুবই কম ছিল। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন