প্রিয় বাবা, আপনার জান্নাত কামনা করছি, রাত্রদিন (২)
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ১৬ এপ্রিল, ২০১৪, ০২:৪৩:১০ রাত
Click this link
প্রিয় বাবা, বাবা বলায় আবার যেন রাগ করবেন না। অনেকে শ্বশুরকে ঐভাবে ডাকে আর আপনি তো আব্বা ডাক শুনতেই অভ্যস্ত আজীবন। আসলে আমাদের টুডে ব্লগ এবার বাবার উপর রচণা লিখার প্রতিযোগিতা আহবান করার সময় বিষয়বস্তুর টাইটেলটা ঐরকম নির্ধারণ করে দিয়েছে বলেই এভাবে লিখছি, তাঁদের প্রতি সম্মান দেখাতে।
বাবা, এখন আপনাকে একটা খুবই দুঃসংবাদ দিচ্ছি। আপনার দীর্ঘ ষাট বছরের জীবনসাথী, মানে আমার চিরদু:খী মা আপনার অবর্তমানে শারিরীক ও মানসিকভাবে বেশ ভেঙ্গে পড়েছেন। গত ডিসেম্বরে তাঁকে দেখতে গিয়ে দেখলাম, তিনি তাঁর স্মরণশক্তি মোটামুটি হারিয়ে ফেলেছেন। ছেলের নিকট বললেন, ‘বাবা, এখন কিছু মনে রাখতে পারিনা, এখনকার কথা তখন ভূলে যাই, এমনকি নামাজে দাঁড়িয়ে ঠিকমতো সূরা ক্বিরাত পড়লাম কিনা, রুকু সিজদা দিলাম কিনা তাও ভূলে যাই’। আরো জানালেন চোখের দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে যাবার কারণে এখন পবিত্র কোরআনও তেলাওয়াত করতে পারেন না। অনেকের সাথে পরামর্শ করে বুঝতে পারলাম যে এই বয়সে চোখের ছানির অপারেশন করানো রিস্কি, ভূলো মনের কারণে মা হয়তো সব সময় চোখ কচলাতে চাইবেন, তাই হিতে বিপরীত হবার সম্ভাবনা বেশী। তাই বেশ দুশ্চিন্তায় আছি। উনি অপারেশনের কথা বলেছেন। কিন্তু নিজেও আবার ভয় করছেন।
বাবা, জীবনের শেষ প্রান্তে এসে আপনাকে কর্মক্ষেত্রে তেমন সরব না দেখলেও মনে এতটুকু সান্ত্বনা ছিল যে, আমার বিদেশ নির্ভর চাকুরীর কারণে সিলাহে রেহমীর ব্যাপারে আমার কোন গাফলতি হয়ে গেলেও আপনি যেহেতু দেশে আছেন, সব কিছু আপনি সামলিয়ে নিবেন। এবং সেটাই ছিল বাস্তব সত্য। আপনার হঠাৎ করে অন্তর্ধানে তাই এমন মনে হচ্ছে যে আমাদের মাথার উপর থেকে বিশাল একটি বটগাছের ছায়া যেন অকস্মাৎ সরে গিয়েছে। আপনার তিরোধানে আমি, আমার বৃদ্ধা ও অনেকটা চলৎশক্তি রহিত মা, ছোট ভাই বোন তাই যেন চোখে অন্ধকার দেখছি। আবার বড় সন্তান হিসেবে বৃহত্তর সংসারের যাবতীয় সামাজিক ও অন্যান্য দায়িত্ব পালনে বাবার পরে পরিবারের বড় সন্তানের চিরন্তন দায়িত্বের কথা ভেবে তাই আমার মাথার অগ্রভাগ পক্ককেশ ধারণ করছে। কোনটা ছেড়ে কোনটা আগে করবো, এসব সাত পাঁচ ভাবতে গিয়ে অনেক সময় অতি জরুরী কাজটাকে ব্যাকসীটে ঠেলে দেই। দেশে থাকলে হয়তঃ এমন ভূল কদাপি ঘটতো। আবার ঘটতোনা তাও কেমন করে বলি। আর্থিক সচ্ছলতার বিষয়টিও যে এসব দায়িত্বের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর অর্থিক স্বচ্ছলতা বলতে যা বুঝায়, সেটার সাথে যেমন আপনি ছিলেন ভীষন অপরিচিত, তেমনি আপনার আদর্শ ধারণ করে জীবন সংগ্রামের কঠিন অধ্যায়গুলো পাড়ি দিতে গিয়ে আপনার এই সন্তানও যে অন্য আর দশজনের চাইতে অনেক পিছিয়ে, সে ব্যাপারে আপনিও ভালো করেই জানেন।
বাবা, আপনার আদর্শকে বুকে ধারণ করে জীবনযুদ্ধে বহুদূর অগ্রসর হয়ে এসেছি। যখন সমাজের ব্যাপক ঘুষ, দূর্নীতি নিয়ে বন্ধুমহলে আলোচনা হয়, তখন আমি বুক ফুলিয়ে গর্বভরে আপনার লালিত আদর্শের ইতিবৃত্ত তাদের কাছে তুলে ধরি এবং সেই আদর্শের সিড়িঁই যে আমার একমাত্র পথ ও পাথেয় সে কথাটি ওদের ভালো করেই জানান দিয়ে দেই। কি যাদু ছিল সে আদর্শে? চাকুরী জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের ঘুষ নামক দুষ্টচক্র হতে ছুটে বেরিয়ে আসার জন্য আপনি কেমন করে আপনার অডিট ডিপার্টমেন্ট এর ৫/৬ বছর পুরাতন চাকরীকে গুড বাই জানিয়ে অন্য ডিপার্টমেন্ট এ ঢুকে পড়েন, সেই কাহিনীটিই পাঠকের জন্য তুলে ধরতে যাচ্ছি।
ঘটনাটি ছিল : ষাট এর দশকের প্রথমদিককার কোন একসময়ের ঘটনা। আপনি তখন অডিট অফিসের সহকারী। একবার কোন এক ক্লায়েন্ট এর অডিট বিষয়ক কাজটি দ্রুত সম্পাদন করায় খুশী হয়ে তিনি জোরপূর্বক আপনার পাঞ্জাবীর পকেটে ৪০ রুপী ঢুকিয়ে দিয়ে তা দিয়ে ছেলেমেয়েদের জন্য মিষ্টি কিনে নিতে বলেন। আপনি তো তা কিছুতেই নিবেন না, পরে কি মনে করে চুপ করে রইলেন। অফিস ছুটির পর বাসায় ফিরে যেতে যেতে বিষয়টি নিয়ে আপনার বিবেকের সাথে আপনার যেন একটা নীরব যুদ্ধ চলছিল। ঐ টাকা দিয়ে কি করবেন, গরীব দুঃখী কাউকে দিয়ে দিবেন না অন্য কোন ভালো কাজে লাগাবেন, সেসব চিন্তায় সারারাত ঠিকমতো ঘুমোতেও পারেন নি। পরেরদিন আবার একই পাঞ্জাবী গায়ে অফিসে রওয়ানা হলেন, বাসে করে যেতে হয়, তাই বাসেও উঠলেন। যখন কন্ডাক্টর ভাড়া চাইতে এলো, পকেটে হাত দিয়ে তো যেন আপনার মাথায় বজ্রপাত। পকেট তখন যেন গড়ের মাঠের ন্যায় মূখব্যাদান করে আপনাকে ক্ষ্যাপাচ্ছে। কন্ডাক্টর লোকটিকে পকেট কাটা গেছে বলে কোনরকম আত্মসম্মান রক্ষা করলেও আপনার চিন্তা যেন দ্বিগুন বেড়ে গেল। কারণ, পকেটে ঐ ঘুষের ৪০ টাকা ছাড়াও ছিল আপনার নিজস্ব ৪০ টাকা, যা ছিল আপনার সারা মাসের খরচপাতির অংশ। একুনে মোট আশি টাকার সবটিই পকেটমার নিয়ে গেছে। ভাবলেন ঐ ঘুষদাতার ৪০ টাকা নেয়ায় এখন তার সাথে আমার ৪০ ও গেল, ডাবল ক্ষতি!! অতএব কিছুতেই আর এই সর্বনাশা অফিসে থাকা যাবেনা (অডিট অফিসের ভায়েরা রাগ করবেন না, প্লীজ)। মান সম্মান, ইজ্জত সবই যাবে একদিন, এখানে থাকলে। সেই যে পণ করলেন অডিট অফিস ছাড়ার, ঠিক দু’মাসের মাথায় অডিটকে বাই বাই জানিয়ে এবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে প্রবেশ করলেন, এবং এখান থেকেই চাকুরী হতে অবসর গ্রহণ করলেন (১৯৯২ সালে)।
বাবা, ঘুষ খাওয়ার সংস্কৃতিতে না জড়ালেও, নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় দু একবার ঘুষ দিতে হয়েছে, এই বেদনাবোধ আমার হৃদয়কে কতটুকু ছিন্নভিন্ন করে দেয়, তার এক ঝলক আপনি নিজেও দেখেছেন, যখন কোন এক ঘুষপ্রদান শেষে, বাসায় এসে সেই কাহিনী বর্ণনা করে আপনার সামনে এই চল্লিশোর্ধ ছেলেটি হু হু করে কেঁদে দিয়েছিল। সেবারের অমন অনুশোচণার মতো এমনটি আর কখনো হয়নি। মহান আল্লাহ আশা করি আমার সেই অনিচ্ছাকৃত অপরাধ ক্ষমা করবেন এবং ঘুষ নামক এই সামাজিক ব্যাধি থেকে আমাকে সর্বদা হেফাজত করবেন।
বাবা, সৎ থাকার চেষ্টায়, আপনার মতোই আমিও চাকুরী জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি তেমন গড়তে পারিনি। কিন্তু তাই বলে আমার তেমন দুঃখ ও নেই। আলহামদুলিল্লাহ, এ ব্যাপারেও আপনার মতোই ধৈর্য্য ও মহান আল্লাহর প্রতি তাওয়াক্কুল আমাকে পথ চলায় অবিরাম সাহস যুগিয়ে চলছে। সংসারে একটু বাড়তি সচ্ছলতার আশায় সহকর্মী আরো অনেকের মতো অন্যায় পথে গিয়ে দু’ পয়সা বেশী রোজগারের কল্পনা কখনো মাথায় আসেনি, যদিও এ কারণে আমাকে অন্যভাবে মানসিক কষ্ট পেতে হয়েছে। মানুষের রিজিক বিষয়ে একথা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি যে, আল্লাহ আমার জন্য আমার পৃথিবীতে আগমনকালেই যা নির্ধারিত করে দিয়েছেন, মৃত্যু অবধি তার বিন্দু পরিমান বাকি থাকতেও, সেটার সবটুকু আহরণ করার আগে আমার মৃত্যু আসবেনা, আসবেনা। এটাই আমাদের রাসূল (সাঃ) এর শিক্ষা।সুতরাং রিজিক সংক্রান্ত যে অসুবিধার আমরা সম্মূখীন হই, তা মহান আল্লাহর নেয়া আমাদের ধৈর্য্যের পরীক্ষা ছাড়া আর কিছুই নয়। যে সব মানুষ রিজিকের ব্যাপারে ধৈর্য্য ধারণ করেনা তারা তাদের ইহ-পরকাল দুইটাতেই চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কালে কালে তাদের গুনাহের পরিমাণ এতো বেশী হয়ে পড়ে যে, তার ধাক্কা সামলানো এজগতে যেমন সম্ভব হয়না, তেমনি পরকালে তো তার জন্য জাহান্নাম হাঁ করে অপেক্ষা করে আছেই। তা কেমনে, একটু উদাহরণ দিয়ে বলা উচিৎ।
যেসব মানুষ বাড়তি সচ্ছলতা লাভের আশায় ঘুষ বা দূর্নীতির আশ্রয় নেয় এবং আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে পড়ে, তারা একদিকে অন্যায়ভাবে অন্য মানুষের অধিকার হরণ করে, আবার অন্যদিকে তার আশেপাশের অন্যান্যদেরও ঘুষ খাওয়ার প্রতি প্রলুব্ধ করে। আবার, অত্যন্ত অসচেতনভাবে সে নিজেই নিজের আয়ু কমিয়ে নেয়, মানে যেখানে স্বাভাবিক গতিতে হালাল পথে রিজিক গ্রহণ করলে সে ৮০ বছর বাঁচতো, অস্বাভাবিক পথে হারাম উপায়ে দ্রুত রিজিক গ্রহণ করার প্রতিযোগিতায় নেমে ৬০ বছরের মধ্যেই তার জম্মকালীন নির্ধারিত রিজিকটুকু নিয়ে আয়ু তার বিশ বছর কমিয়ে নিল। আর কি দূর্ভাগা সে, মরণকালীন তার অন্যায়ভাবে কামানো সম্পদের কিছুই অবশিষ্ট রাখতে পারেনা, নিজেও ভোগ করতে পারেনা, আর নিজ সন্তান বা পরিবারের জন্যও রেখে যেতে পারেনা। নিজের দূরারোগ্য ক্যান্সার জাতীয় অসুখের পিছেই সমস্ত জমা সম্পদ খরচ করে একেবারে রিক্ত ও নিঃস্ব হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হয়। একটু চিন্তা করলেই বুঝা যাবে কত বড় দূর্ভাগা এই মানুষগুলো যারা সূদ, ঘুষ আর অন্যায়ভাবে সম্পদ আহরণ করাকেই জীবনের লক্ষ্য বানিয়ে ফেলেছে।
বাবা, আপনার গড়া সংসারে সততা, সরল জীবনযাপন আর মহান আল্লাহর উপর সর্বাবস্থায় তাওয়াক্কুল করে থাকার ব্যাপারে যে শিক্ষা পেয়েছি তার তূলনা হয়না। আজ যখন সুযোগ এলোই তখন আমার ব্লগের সাথীদের জন্য আপনার শিক্ষার কিছু নমূণা তুলে ধরার লোভ সংবরণ করতে পারছিনা।
(চলবে...)
বিষয়: Contest_father
১৬১৫ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভাই প্রথমটিও পাঠ করবেন অবশ্যিই। কিভাবে যে পূর্বের পর্ব বর্তমানেরটার সাথে লিংক করে দিব বুঝতে পারছিনা।
তোমার উত্তম দোয়ার মতোই হোক তোমারও আগামী দিনগুলো
সততার জীবন বার্হীক দিক থেকে অনেক কস্টের হলেও এর মজাই আলাদা। আপনি ও আদর্শিক বাবার অনুসারী জেনে খুব ভাল লাগল। ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন