প্রিয় বাবা, আপনার জান্নাত কামনা করছি, রাত্রদিন
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ১৫ এপ্রিল, ২০১৪, ০৩:০৮:৪৩ রাত
প্রিয় বাবা
বিগত ২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল তারিখে সপ্তাহান্তের সামান্য জ্বর আর কষ্টদায়ক কাশিতে ভূগে, স্ত্রী-পূত্র-কন্যা কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আপনি ফজরের ঠিক পূর্বক্ষণে আপনার পরম প্রভূ, মহান আল্লাহর সান্নিধ্যে হাজির হয়ে যান।(আজ এক বছর পূর্ণ হলো)। বিদায়বেলার শারিরীক ঐটুকুন অসঙ্গতি ছাড়া মাশাআল্লাহ আপনার আর কোন অসুখ বিসুখ তখনো ছিলনা, আর আগেও কোনদিন বড় কোন রোগে ভূগেছেন বলে আমাদের মনে পড়ে না। তাই হাজার হাজার মাইল দূরে অবস্থানরত আপনার এ বড় সন্তানসহ পরিবারের অন্য সবাই এমনকি আশেপাশের সবারই আপনার এমন করে বিনা নোটিশে প্রস্থান করাকে মেনে নিতে যেন কষ্ট হচ্ছিল। রীতিমত অভিমানিও হয়ে গিয়েছিলাম। যদিও আমরা জানি মহান প্রভূর ডাক এলে যে কাউকে, যখন যেখানে যে অবস্থায় থাকে না কেন, সেই ডাকে সাড়া দেয়া ছাড়া তার আর কোন বিকল্প থাকেনা।
মৃত্যুর মাত্র দুই দিন আগেও ফোনে যখন আপনার সাথে কথা হচ্ছিল, আপনি পূত্রের নিকট আপনার কষ্টদায়ক কাশির কথা জানিয়ে ডাক্তার দেখাবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন। তখনো তো ঘুনাক্ষরেও জানতে দেন নি আসলে আপনি মনে মনে অন্য কি রকম পরিকল্পনা এঁটেছেন। পরবর্তীতে অবশ্য আরো জেনেছিলাম, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের বেশ কয়েকদিন পূর্ব থেকেই আপনি ফোন করে করে পূত্র কন্যা ও নিকটাত্বীয়দের সাথে আলাপ করেছেন, সবার খোঁজখবর নিয়েছেন। কেউ অন্ততঃ দীর্ঘশ্বাস ফেলে একথা বলেনি যে হায়, শেষ বেলায় বাবার/(উনার)সাথে একটু কথা হলোনা বা দেখা হলোনা। অবশ্য আপনার চতূর্থ কন্যা শেলী বলেছে, ঐ ঘটনাবহুল রাতে যখন আপনাকে আপনার কনিষ্ঠ পূত্র আজাদ হাসপাতালে নিয়ে গেছে, সেও নাকি হাসপাতালের দোতালাতেই ছিল, তার পূত্রবধুর ডেলিভারী কেসের পরিচর্যারত ছিল সে। তার একটু আফসোস তো রয়েই গেল, যে শেষ মূহুর্তে এতো কাছে এসেও বাবার সাথে কুশল বিনিময় বা বাকবিনিময় হতে বঞ্চিত রয়ে গেল, যেখানে আর মাত্র ঘন্টাখানেক পরেই আপনার অন্তিম যাত্রার সূচনা হয়েছিল। সেই রাতের আর একটি ব্যাপারও আমাদেরকে ভাবিয়েছে, তবে কোন সমাধানে পৌঁছাতে পারিনি আমরা। কাশির প্রকোপ বাড়াতে যখন আজাদ আপনাকে তার এক বন্ধুসহ রাত তিনটার দিকে সিএনজি যোগে ফেনীর সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যায়, তার বর্ণনা অনুযায়ী আপনি নিজেই হাসপাতালের সিঁডি ভেঙ্গে উপরে ডাক্তারের চেম্বারে চলে যান কোন সাহায্য ছাড়াই। অথচ কর্তব্যরত ডাক্তার আপনাকে চেক করার পর কেন যে তারা আপনাকে চিকিৎসায় নিজেদের অপারগতার কথা বলে অন্য হাসপাতালে নিয়ে যেতে বললো, আর কেনই বা পরবর্তী এক ঘন্টার মধ্যে ফিরতি পথে সিএনজিতেই আপনার প্রভূর সাথে গিয়ে মিলিত হলেন, এ এক বড় রহস্য, যে রহস্যের কোন কিনারা আমরা করতে পারিনি।
আরো একটা আশ্চর্য্যজনক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল সবাই আপনার শেষ যাত্রার পর। আপনার দীর্ঘদিনের সুখে দুঃখের সাথী, আমার স্নেহময়ী জননী, যিনি বিগত প্রায় দেড়যুগেরও অধিক সময় ধরে, বাতের ব্যাথা, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য সমস্যায় ভূগে দূর্বলতার কারণে আপনার পরিচর্য্যার উপরই মোটামুটি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলেন, এবং যার কারণে উনার কোন দৈব দূর্বিপাকের ঘটনা প্রত্যাশায় আমরা সব সময় চিন্তিত থাকতাম, সেই তাঁকে দেখলাম, আপনার অন্তর্ধানের পর সম্পূর্ণ স্বাভাবিক এবং এক শক্ত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে। আপনার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আগত অতিথিদের এবং পুত্র-কন্যা, জামাতাসহ সবার দেখাশোনা, সান্ত্বনা দান এবং ধৈর্য্য ধারণের উপদেশ দানের এই অচিন্তনীয় ভূমিকায় তাঁকে দেখে উপস্থিত সবাই সেদিন চোখ বড় বড় করে তাকাচ্ছিল। আমার সাথে ফোনে যখন কথা হচ্ছিল, তখন আমিও অনুভব করলাম আম্মার সেই শক্ত মন আর অনুপম ধৈর্য্য ধারণের অকল্পনীয় দৃশ্যের ছটা।
আল্লাহর দরবারে শুকরিয়ায় বার বার মাথা নত হয়ে আসছিল যে, স্বামীর প্রস্থানে এবং বড় ছেলের অবর্তমানে আমার দুঃখিনী মা কেমন করে কোথা হতে অতো শক্তি, সাহস আর ধৈর্য্য ধরে পরিস্থিতির মোকাবিলা করার সাথে সাথে অন্যদেরকেও সাহস যোগানোর মন্ত্রণা পাচ্ছিলেন, যেখানে আগামীর অসহায় দিনগুলোর কথা ভেবে উনার নিজেরই ভেঙ্গে পড়ার কথা ছিল। সবার ছোট্ট বোনটি যখন ফোনে কান্না করে তাদের অসহায়ত্বের প্রকাশ করার সাথে সাথে আম্মার সেই অপূর্ব অবস্থার বর্ণনা তুলে ধরছিল, তখন তাকে আমি একটি পরামর্শ দিয়েছিলাম; বলেছিলাম, আম্মার এই অবস্থা সাময়িক, যখন সবাই তোমরা চলে যাবে, যখন সব কোলাহল থেমে যাবে, তখন কিন্তু আম্মার রূপ সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যাবে। এটা হলো সাময়িক একটা ব্যবস্থা, মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে। তোমরা যাবার আগে বাবার ব্যবহৃত জামাকাপড় সবগুলো গুছিয়ে কোন আলাদা স্থানে রেখে দিও যা সহজে আম্মার দৃষ্টিতে না পড়ে। যখন একলা হয়ে যাবেন, তখন ঐগুলো নিয়ে যাতে শোক বা বিলাপের সুযোগ না হয়। ওরা তাই করেছিল।
বাবা, আপনার বড় সন্তান হিসেবে এবং সেই ১৬/১৭ বছর বয়স হতেই সাংসারিক বিষয়ে আপনার সহকারীরূপে দায়িত্ব পালনের সুবাদে, আমি ছিলাম আপনার নিকটতমদের মাঝে একজন। তবে, কতটুকু আপনার প্রিয় ছিলাম, তা তেমন করে কখনো অনুভব করতে পারি নি। হয়তঃ আপনার সেটা প্রকাশের ব্যাপারে নিজস্ব কোন স্টাইল ছিল, যেটা আমি বুঝতে পারতাম না, কিংবা আপনি ইচ্ছে করেই আপনার অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপারে নিজের উপর কোন সেংশান দিয়ে রেখেছিলেন। তবে, কন্যাদের প্রতি আদর প্রকাশে আপনাকে কখনো কিপটামী করতে দেখিনি। এ ব্যাপারে আপনি সম্ভবতঃ আমাদের প্রিয় নবী করীম (সাঃ) এর নীতির অনুসারী ছিলেন। সে সময়ের আমার পরবর্তী চারজন বোনদের প্রতি আপনার আপত্য স্নেহের আধিক্য দেখে এবং তখনকার একমাত্র ছেলের (নিজ) প্রতি নানা বিষয়ে কঠোরতার প্রকাশ দেখে অনেকে তো বলেই ফেলতো, ‘হাসেম সাহেবকে দেখি একমাত্র ছেলের চাইতে মেয়েদের প্রতি বেশী আদর দেখাতে….’ তখন আপনার জবাব হতো, ‘আমার ছেলেকে কিভাবে মানুষ করতে হবে, তা আমি ভালো জানি, মেয়েরা তো এখানে মাত্র কয়দিনের মেহমান….”। বাবা, আজ কেন জানি ছোটবেলায় আপনার হাতের বেদম মার খাওয়ার কথা স্মরণে এসে বুকের ভেতর হতে হু হু করে একটা উদাসী বাতাস বেরিয়ে এলো, সাথে চোখ দুটোকেও ভিজিয়ে দিয়ে গেল। অথচ তখন সেই অবুঝ বেলায় এমনো মনে হতো, বাবা আমাকে আদর করেনা, মার খেয়ে খাটের নীচে গিয়ে কান্না করতে করতে মনে মনে ভাবতাম, ‘সালা, কোন দরকার নেই এমন মাইর খাওয়ার, কোনদিন জানি রাস্তায় গিয়ে গাড়ির নীচে গিয়ে মরে যাবো, তখন বুঝবেন মজাটা’।
বাবা, আজকে এই ৫৬ বছর বয়সে, সেইদিনের সেই ছেলেমানুষী ভাবনার কথা মনে পড়লে মনে মনে নিজেই লজ্জিত হই। আমার দুষ্টামীর মাঝে একটা তো ছিল, কারণে অকারণে ছোট বোনদেরকে মাইর দেয়া। ওদের কান্না করা আব্বা আপনি সইতে পারতেন না, তখনো শাস্তি পেতাম আপনার কাছে। একবার তো পিঠাপিঠি ছোট বোনটি (সম্ভবতঃ তখন তার বয়স ছিল তিন বছর) আমার মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলেছিল,‘আম্মু, আমি মলে(মারা) গেলে তোমরা আল(আর) একটা নীলু এনো’। এই কথাটি যখন আপনার কানে যায় তখন সেকি আপনার অগ্নিমূর্তি। সেদিনের মাইর খাওনের পর নাকি অন্য আর একদিন অন্য কোন দুষ্টামির জন্য আপনার বেতের বাড়িতে এমন আঘাত মূখে খেয়েছিলাম যে, মূখের আঘাতের দাগটি প্রায় ১০/১২ দিন স্পষ্ট ছিল। মায়ের কাছে পরে শুনেছিলাম আপনি নাকি সেদিন নিজেও কেঁদেছিলেন এবং দুপুরে খাবারও স্পর্শ করেন নি।
প্রিয় বাবা, আপনাকে হারিয়ে, হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে ছুটে গিয়ে আপনাকে শেষ দেখার কোন সুযোগ ছিল না। সেই দুঃখ মনে পুষে অপেক্ষা করতে থাকলাম কখন দেশে গিয়ে আপনার কবর জেয়ারতের সুযোগটি পাবো, আর সেটি পেতে পেতে আরো প্রায় আট মাস গড়িয়ে গেল। দেরী করে যাওয়ার কারণে মনে কষ্ট নিয়ে থাকলে ক্ষমা চাইছি, কিন্তু অন্যরা না বুঝুক, আপনি নিশ্চয়ই বুঝবেন আমি কি কঠিন অবস্থার শিকার ছিলাম ঐ কয়টা মাস। মমতাময়ী, অসুস্থ মা, যিনি আপনার উপরই নির্ভরশীল থাকতেন, তাঁর দেখভালের বিষয়ে যাতে কোন ত্রুটি না হয়, সে ব্যাপারে ভাই বোনদের নির্দেশনা দিতে কোন কার্পণ্য কিন্তু করিনি, আর মায়ের সাথে প্রতিদিন না হলেও সপ্তাহে তিনদিন কথা বলার চেষ্টা করেছি। দেশে যখন গেলাম, প্রথমেই ছুটে গেলাম আপনার বেডরুম আর সে সংলগ্ন আপনার পাঠগৃহে, যেখানে স্তুপীকৃত ছিল আপনার রেখে যাওয়া ইসলামী সাহিত্যের বিরাট বিরাট গ্রন্থ। ছিল কিছু ডায়রী, সংসারের ইতি উতি খরচের হিসাব। ডায়রী ঘাটতে গিয়ে হঠাৎ হাতে পেলাম একখানি চিরকুট, যেটা আপনি আপনার এই সন্তানকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন বলে মনে হলো। তাই গভীর আগ্রহ সহকারে সেটাতে চোখ বুলালাম। চিরকুটের একস্থানে এমন ক’টি কথা লিখা দেখলাম যা পাঠে, আপনার হৃদয়ে আমার স্থান যে কতটুকু ছিল, তা আর একবার অনুভব করলাম এবং ঐটি পাঠ শেষ করতে আমাকে বার বার চোখ মুছতে হয়েছিল। আপনি লিখেছেন, “বাবা …….., তুমি আমার অনেক গর্বের সন্তান। তুমি পরিবারের প্রতি দায়িত্ব পালনে যে পরম যত্নশীলতার পরিচয় দিয়ে আসছ, তা আমি তোমার বয়সের অন্য কারো মাঝে এখনো দেখিনি। আমার অফিসের বড় বস, একবার চীন সফর হতে ফিরে তোমার বাসায় দাওয়াত খাওয়া প্রসঙ্গে তোমার ও বৌমার প্রশংসায় পঞ্চমূখ হয়েছিল। বলেছিল, হাসেম সাহেব, আপনি একজন অতি সৌভাগ্যবান পিতা….”। মনে পড়ে ইন্ডিয়ায় অবস্থান কালে দীর্ঘদিন আপনার কোন পত্র না পেয়ে অভিমান করে কোন একটি চিঠিতে দুঃখ প্রকাশ করেছিলাম, আর তার প্রেক্ষিতে আপনি আমাকে অমোন একখানা চিঠি দিয়েছিলেন। সেদিন আবার সেই পত্রেরই জেরক্স কপি দেখে আবেগে বার বার চোখজোড়া প্লাবিত হচ্ছিল। আপনার হৃদয়ে আমার অবস্থানের পরিমাপ আবার করে নিতে পেরেছিলাম। আম্মা আবার আপনার মতো অতো রিজার্ভ নন বলে তাঁর মূখে আমার জন্য ভালোবাসার উপমা বেশ কয়েকবারই শুনেছি, শুনে আশ্বস্ত হয়েছি যে, আমি সন্তান হিসেবে পিতামাতা ও ভাই বোনের প্রতি দায়িত্ব পালনে কখনো অবহেলা করিনি।
(চলবে...)
বিষয়: Contest_father
১৭০৪ বার পঠিত, ২৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রব্বির হাম হুমা কামা রব্বাইয়ানি সাগীরা...
আমি আপনাকে চিনি, আপনি আমার স্বল্পকালীন প্রতিবেশী ছিলেন, আপনার মত অমায়িক, ধার্মিক ও উদার ব্যক্তিকে নিয়ে যে কোন বাবা গর্ববোধ করবে। আপনার পরিবারে সবাই শিক্ষিত, মার্জিত ও রুচি সম্মত। কেউ আপনাদের বন্ধুত্ব হারাতে চাইবে না। আল্লাহ আপনার বাবাকে জান্নাত দান করুন।
সংসারের বড় ছেলে হওয়ার কারনে আপনার সাথে বাবার সম্পর্কটা ছিল বেশী। অভিভাবকসুলভ। পিতা পুত্রের গাম্ভীর্যপুর্ন সম্পর্ক সত্যিই ভাল লাগল। আজ বাবা নেই। কিন্তু একজন বাবার জন্য সন্তানের ভালবাসা যে কত প্রখর তা লিখা থেকেই বুঝা যায়।
ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন