রোজনামচা-১০ : বাবার হঠাৎ অন্তর্ধান

লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ০৭ অক্টোবর, ২০১৩, ০৬:১৫:০৯ সকাল

বাবাকে হারিয়েছে বেশীদিন হয়নি। যতোদিন তিনি জীবিত ছিলেন, একপ্রকার নিশ্চিন্তে ছিলাম। মা বাতের ব্যাথায় বয়সের আগেই বুড়িয়ে গেলেও বাবার প্রায় অসুখবিহীন সুন্দর স্বাস্থ্য দেখে কেউই ভাবেনি যে তিনি মায়ের আগে এ দুনিয়া ত্যাগ করবেন। কিন্তু বাস্তব বড়ই কঠিন। তিনি কয়েকদিনের সর্দি, কাশিতে ভূগে কাউকে কোন খেদমতের সুযোগ না দিয়ে হঠাৎ একদিন মধ্যরাতে হাসপাতালে নিয়ে যাবার পথে তাঁর প্রভূর সান্নিধ্যে গিয়ে হাজির হন। তাঁর জীবিত আট সন্তানের মধ্যে একমাত্র আমি (বড়) ছাড়া সবাই তাঁকে কাছে গিয়ে শেষ বিদায় জানিয়ে আসে। বিদেশে থাকায় এবং দেশে যাবার কোন সুযোগ না থাকায় আমি সেই সুবিধাটুকু পাইনি। ফোনের মাধ্যমেই বড় ছেলের যাবতীয় দায়িত্ব সারতে হয়েছে। অথচ বড় ছেলে হিসেবে আয় রোজগারের দিক দিয়ে কমতি থাকলেও বাবা-মা আমার উপরই সব সময় ডিপেন্ডেন্ট ছিলেন।

বাবাকে তাই বিদায়বেলায় না দেখতে পারার বেদনা সব সময় তাড়িয়ে ফিরে। আল্লাহর দরবারে সেই তখন থেকে ফরিয়াদ করে চলেছি, অন্ততঃ অসুস্থ মাতাকে যাতে গিয়ে কাছ থেকে কিছু সান্ত্বনা দিয়ে আসতে পারি। আমরা তো তাঁর গুনাহগার বান্দা। তাই সেই আর্জি পূরণে সময় লাগবে, বোঝা যাচ্ছে। আমরা তো আর মহাকবি ইকবালের বিখ্যাত সেই কবিতার ছত্র মোতাবেক বান্দা হতে পারিনি, যে বান্দাকে আল্লাহ তার প্রতিটি তাকদির ঘটানোর পূর্বে জিজ্ঞেস করে যে, 'বল বান্দা তোমার কি ইচ্ছা?' (খুদি কো কার বুলান্দ ইতনা কে, হর তাকদির সে প্যাহলে খোদা বান্দা সে ইয়ে পুছে, বাতা তেরী রাযা কেয়া হ্যায়)।

বাবার জ্ঞান গরিমার ধারে কাছে না ঘেঁষতে পারলেও খুব ছোট সময়ে বাবার যে একটি গুনকে এই অন্তরে ধারণ করেছিলাম তা সর্বদা বাতিঘর হয়ে আমাকে এখনো সঠিক পথে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। বাবা তখন অডিট ডিপার্টমেন্টের কর্মচারী ছিলেন, বয়স আমার ছিল ৭/৮ বছর। একদিন কোন এক ক্লায়েন্টের কাজ দ্রুত করে দেয়ায়, তিনি খুশী হয়ে বাবাকে ৪০ টাকা জোর করে তাঁর পাঞ্জাবীর পকেটে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন এটা দিয়ে ছেলেমেয়েদেরকে মিষ্টি খাওয়াবেন। বাবা চিন্তাক্লিষ্ট মনে বাসায় আসলেন। কাউকে এই ব্যাপারে কিছু বলেন নি। পরদিন সেই পাঞ্জাবী পরেই আবার অফিসে রওয়ানা দিলেন। অফিসে পৌঁছে (নাকি বাসের ভাড়া মিটাতে গিয়ে) টের পেলেন জনৈক সুযোগ্য পকেটমার, তাঁর পকেট মেরে পুরো আশি টাকা নিয়ে উধাও হয়েছেন। সেই যে বাবার মনে অডিট ডিপার্টমেন্ট এ চাকুরী সম্পর্কে ভয় ঢুকলো, তিনি ঐ ডিপার্টমেন্ট ছাড়ার চেষ্টা শুরু করলেন এবং পরবর্তী তিন চার মাসের মাথায় সেই চাকুরীকে লাথি দিয়ে অন্য মন্ত্রণালয়ে ইন করলেন। তাঁর মনে ভয় ঢুকলো, ঘুষ যা নেয়া হয়, তার দ্বিগুন গুনাগারী দিতে হয়, এজন্যই ৪০ এর স্থলে তাাঁর আশি টাকা হারিয়ে যায়। তাই ঘুষ দেয়া-নেয়ার প্রতি এ অধম ও অতি বেশী সচেতন থাকি। আর তার ফলে আমার সাথের কলীগরা তর তর করে দুনিয়াবী সাফল্যের শিখরে উঠে গেলেও, আমার দ্বারা তা আর হয়ে উঠেনা। এ ব্যাপারে বাবার আর আমার মাঝে রয়েছে দারুন মিল। বাবা যেমন সারাজীবন হাত টানাটানিতে ছিলেন, আমারও অবস্থা তথৈবচ। এজন্য প্রাণের সখীর কাছে কত যে .... শুনতে হয়, তা আর নাই বলি, আজকের এই দুঃখের আসরে।

বাবার অন্তর্ধানের পর মায়ের চিন্তায় বেশী কাতর হয়ে পড়ি। অসুস্থ মা-কে কাছে থেকে সেবা শশ্রুষার ভরসা তো ছিলেন বাবাই। তবে সেই ঘটনাবহুল দিনগুলোতে একটা জিনিষ লক্ষ্য করে বেশ আশ্চর্য্য হয়েছিলাম। যখনই মায়ের সাথে ফোনে কথা বলেছি, তাঁকে সান্ত্বনা দেবার ভাষা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছি, দেখতাম উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই আমার সাথে কথা বলছেন, এমন কি উল্টা আমাকেই সান্ত্বনার বানী শোনাতে থাকেন। বাবা যে কি সুন্দর ভাবে এ ধরাধাম ত্যাগ করেছেন, কাউকে কোন কষ্ট না দিয়ে, হাসি হাসি চেহারা নিয়ে, যেন ঐতো এখনো নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছেন - এমন কথা বলে আমাদের সবাইকে তিনি সান্ত্বনা দিয়েছেন। ভাই বোনদের কথায়ও তার সমর্থন পাই। তবে সেটা যে তিনি ঘোরের মাঝে করছিলেন, তা বড় সন্তান হিসেবে আমার কাছে স্পষ্ট ছিল। একদিন তাই ছোট বোনকে বলেছিলাম,

তোমরা যখন চলে যাবে, ঘর যখন ফাঁকা হয়ে পড়বে, তখন ঠিকই বাবাকে হারানোর কষ্ট মাকে কুটে কুটে খাবে। তাকে পরামর্শও দিয়েছেলাম, বাবার ব্যবহৃত কাপড়চোপড় গুলো যাতে কোথায়ও লুকিয়ে রাখে।

স্নেহময়ী, মমতাময়ী মা আমার, নয় সন্তানের জননী। বড় সন্তান (আমার বড়) বেশ আগেই ক্যান্সারের শিকার হয়ে চলে যান প্রভূর কাছে। বর্তমানে নিজেদের বাসায় দেখা শোনার কেউ না থাকায় এক বোন, তাঁকে কাছে নিয়ে রেখেছে। এখন প্রায়ই বাবার কথা স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন দেন। ফোন করলেও প্রায়ই সেভাবেই আবিষ্কার করি। আমি কেন এখনো মাকে দেখতে যাইনি সেই অনুযোগ করেন। কিন্তু উপরওয়ালার হুকুম ছাড়া যে আমার এক পা নড়ারও শক্তি নেই। সেই বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করি আর দোয়া চাই যাতে শীঘ্রই মা-ছেলের মিলন ঘটে। যখন দিনশেষে প্রভূর দরবারে নীরবে হাজির হই, তখনো চোখের অশ্রু ফেলে দয়াময়ের সাহায্য কামনা করি।

আগামী ডিসেম্বরে প্ল্যান করেছি সবাই মিলে দেশে যাবো। দেশের পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক অস্থিরতার মাঝে এই ভ্রমন কেমন হবে, সেই ভয়ও শঙ্কা মনকে ভাবায়। কিন্তু যাই হোক, এবার আর মায়ের আহ্বানকে উপেক্ষা করে অন্য কিছু ভাবার অবকাশ নেই। ব্লগার ভাই বোনদের নিকট দোয়াপ্রার্থী যাতে এই ফরজ সফরটি নির্বিঘ্নে করে আসতে পারি, আল্লাহ সেই তৌফিক আমাদের দিন।

বিষয়: বিবিধ

১৯২৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File