রোজনামচা-৯ : টাক, স্মরণ, এনার্জি ইত্যাদি
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ০৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১০:০৪:১১ সকাল
বয়স বাড়ার সাথে সাথে তিনটে জিনিষের আধিক্য দেখছি নিজের মাঝে, এক- মাথার পেছনে টাক পড়া, দুই- স্মরণশক্তির দুর্বলতা, তিন-শরীরের এনার্জির নিম্নগামিতা।
পেছনে টাক পড়াটা তেমন একটা ভাবায় না, যতোটা ভাবায় দ্রুত চুলের ঘনত্ব কমে আসায়। পেছনেরটা তো আর নিজ চোখে তেমন দেখা যায় না। কিন্তু সমগ্র এলাকায় চুলের ঘনত্ব যে হারে কমে যাচ্ছে (চুল পড়া), সেই হার যদি এভাবেই চালু থাকে তাহলে আগামী এক বছরে মাথায় চুল খুঁজতে ম্যাগনিফাইং গ্লাস এর সাহায্য নিতে হতে পারে। লক্ষ্য করলাম, এই চুল পড়া রোগটা শুধু আমার নয়, ঘরের সব সদস্যদেরই। কারণ কি? রেড়িমেড জবাব, এদেশের পানির সমস্যা। তাতে কি সমস্যার সমাধান হবে? পানি ছাড়া তো আর জীবন চলে না। সেই শিশুকালেই তো মুখস্থ করেছি 'পানির অপর নাম জীবন।'
তো, এই চুল পড়াটার তাৎক্ষণিক যে প্রতিক্রিয়া সেটার জ্বালাও কম নয়। ঘরের আনাচে কানাচে চুলগুলো কখন, কিভাবে পড়ে যে ফ্লোরটাকে চুলময় করে রাখে, সেটা একাধিকবার পরিষ্কার করতে গিয়ে মোর গিন্নির সেই কি হম্বিতম্বি। সবার চুলই তো পড়ে, জবাব দিলে হাতেকলমে প্রমাণ নিয়ে হাজির হন তিনি, ঝাড়ু দিয়ে কাঁচানো চুল হাতে নিয়ে দেখাতে, চুলের সাইজ দিয়ে প্রমাণ করেন তিনি যে, আমার চুলের পরিমানই বেশী। শুধু কি তাই? সাদা চুল রাঙ্গা করতে দেয়া মেহেন্দীর রং মাখা চুলগুলো তো আর মিথ্যে বলবেনা। হা.হা.হা.। অতএব, সেখানে আর কথা চলেনা।
বাজারে চুল না পড়ার কত রকমের দাওয়াই আছে। কিন্তু কোনটা যে আসল কাজ করবে সেটা জানার উপায় নাই, তাই ওদিকে দৃষ্টি দেবারও তেমন গরজ অনুভব করিনা। এক একটা বোতলের গায়ে দাম দেখলেই তো আক্কেল গুড়ুম হবার জোগাড়। বহু বছর আগে চীনে থাকতে '১০১' নামে একটা চুল না পড়ার তেল এর খুব চর্চা ছিল, এমনকি অনুরোধের ঢেঁকি গিলে নিজেকেও সে দাওয়াই দেশে পাঠাতে হয়েছিল কারো কারো জন্য। তবে যাদের জন্য পাঠানো, তাঁরা এর দ্বারা কতটুকু উপকৃত হয়েছিলেন, সেটা এখন স্মরণে আসছেনা। এদেশে ফার্মেসী বা বড় স্টোরে গেলে মাঝে মাঝে সেই ১০১ বোতলের খোঁজ করি, না দেখিনি আজ পর্যন্ত। কি জানি, যে দেশে এর জম্ম, সেই দেশেই বা সেটার কদর বর্তমানে আছে কিনা।
স্মরণশক্তির বেহাল দশা দেখে মাঝে মাঝে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ি। পূর্বেও অবশ্য স্মরণশক্তির তেমন একটা জোর ছিলনা। এভারেজ মানুষের স্মরণশক্তি দিয়ে, মূখস্থবিদ্যায় ভর করে স্কুল কলেজের চৌকাঠগুলো পার হয়ে এসেছি। তবে পাঠ মূখস্থ করতে যতোনা সময় লাগতো, সেই পাঠ ভূলে যেতে মনে হয় তার চাইতে কম সময় লাগতো। তাই পরীক্ষার খাতায় যা লিখে আসতাম, তার উপর যদি দুইদিন পর আবারো পরীক্ষা নেয়া হতো তাহলে নির্ঘাত ফেল মারা ছাড়া উপায় ছিলনা।
এই ভূলোমন নিয়ে যে কতোবার অফিসে বসদের কাছে নাকাল হতে হয়েছে, কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রিমাইন্ড করা নিয়ে, তার হিসেব দেয়া যাবেনা। অথচ এমন একটি সেক্টরে আমার কাজ, যেখানে স্মরণশক্তির প্রখরতার উপর নিজের ইমেজ রক্ষা এবং চাকরীর যোগ্যতার সার্টিফিকেটটি ঝালিয়ে নেয়া নির্ভর করে অনেক। যতোই দিন যাচ্ছে, ততোই যেন এই স্মরণশক্তি আমাকে দিনদিন ভাবিয়ে তুলছে। এই যে দেখুন না, গতকাল এক কলীগের দেয়া আমন্ত্রণে অফিসে সবার এক ভূরিভোজ হয়ে গেল। বাসায় এসে যখন গিন্নীর জানার আগ্রহে ভূরিভোজের বর্ণনা দিতে গিয়ে বললাম, আর বলোনা, মজার মজার সব খাবার ছিল, উনার শ্বাশুড়ীর(শ্বাশুড়ী এখানে বেড়াতে এসেছেন) হাতের রান্না তো, এই প্রথম খেলাম। ব্যস আর যায় কোথায়, গিন্নী দিলেন এক খামচি, স্যরি, দিলেন এক ভেংচী, তোমাদের এই-ই হলো স্বভাব, খাও দাও আর ভূলে যাও। কেন এর আগেও তো একবার খেয়েছিলে উনার রান্না। তুমিই খেয়েছ, অথচ ভূলে গেছ, আর আমি না খেয়েও মনে রেখেছি। বহু চেষ্টা করেও এর আগে কখন খেয়েছি তা আর মনে আনতে পারছিলাম না। শেষে উনি নিজেই যখন দিন তারিখ বর্ণনা করে কখন ঐ কলীগের বাসাতেই তার শ্বাশুড়ীর হাতের রান্না প্রথম খেয়েছি বললেন, তখন আমার সাথে এই হতভাগা স্মরণশক্তির অবহেলা আর অসহযোগিতার কথা ভেবে নিজেকে খুব অসহায় মনে হলো।
হতভাগা স্মরণশক্তির এই অসহযোগিতা কি নিজ ঘরেই আমাকে কম জ্বালাতন করে? পারিবারিক কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আলোচনাকালে যখন কোন পয়েন্টে এসে এই রোগটি আমাকে অপ্রস্তুত করে গিন্নীর কাছে, তখন উনাকে পায় কে? খুব রসিয়ে রসিয়ে বলবেন, 'হ্যাঁ, এই কথা তো ভূলবেই কারণ, এটাতো আমার ব্যাপার, নিজের ব্যাপার হলে কি আর ভূলতে? এমনই ভূলা রোগ যে আমার, তখন যে, উপরের ঘটনাটির মতো কোন ঘটনার উদাহরণ টেনে এনে প্রমাণ করবো যে, না তুমি ভূল বলছো, ঐযে সেদিনের ঘটনাটির কথা মনে কর, তুমি যতক্ষণ না বলেছ, ততক্ষণ কি আমি সেই ব্যাপারটা মনে করতে পেরেছি, সেটা কি আমার স্বার্থের কোন ব্যাপার ছিল, সেই যোগ্যতাও থাকেনা। কি আর করা, চুপচাপ গিন্নীর মেরে দেয়া তীরের ঘায়ে যখমটির উপর মলম লাগাতে মনে মনে প্রভূকে স্মরণ করা ছাড়া দ্বিতীয় কোন উপায় আর দেখিনা।
এনার্জি বা শারিরীক শক্তিও যেন দিন দিন কমতির দিকে। বুঝতে পারিনা, গিন্নীর পাকানো এতো এতো সব মজাদার খাবার গ্রহণের পরেও কেন এতো তাড়াতাড়ি শক্তির এ নিম্নগামিতা? আমার মতো বয়সের অনেকেই তো দিব্বি হেভী সব কাজ করে যাচ্ছেন দিন রাত। বাজার করতে গিয়ে আগে যদি দুই হাতে পনের বিশ কেজি সামগ্রী উঠাতে পারতাম অনায়াসে, সেখানে বর্তমানে দশ কেজি বস্তু নিয়ে হাফ কিলো দূরত্ব হেঁটে আসতেই দুই বাহুর বিদ্রোহ বেশ অনুভব করতে পারি। ঘটনাচক্রে দুই একবার এমন কাজ ক্রমাগত হয়ে গেলে বাহু, কাঁধ ও কোমরের ব্যাথার উপশমে আবার গরম পানির ছ্যাঁক, ভোল্টারেন অয়েনমেন্টসহ উনার সেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অবশ্য, এ নিয়ে প্রভূর কাছে তেমন কোন নালিশ নেই। সেই জম্মের পর থেকেই নাকি ছিলাম আমি কৃশকায়, রোগা এবং পাতলা। পেটরোগা মানে কোন খাবার হজম করায় দুর্বলতাতেও বেশ সুনাম ছিল। সে অনুপাতে বর্তমানে তো খাওয়া দাওয়ায় বেশ এগিয়ে আছি। হজমশক্তি ও আগের চাইতে বেশী। অবশ্য সেজন্য পুরো ক্রেডিট তো আমার উনিই দাবী করেন। তা তিনি দাবী করুন, আমার কোন আপত্তি নেই। তবে যিনি জম্ম দিয়ে, রোগ-জ্বরা আর টানাটানির সংসারে নিজের সমস্ত চাওয়া পাওয়াকে তাকে তুলে রেখে সন্তানকে পরম স্নেহ মমতায় লালন পালন করে, লিখিয়ে পড়িয়ে এত বড় করেছেন, তাঁর ত্যাগ ও অবদানকে কি আমি জীবন দিয়েও পূর্ণ করতে পারবো? তা কি কখনো সম্ভব? বাবার হঠাৎ অন্তর্ধানের পর সেই দুঃখিনী মা আমার বড়ই একাকীত্ব অনুভব করছেন জীবনে, তার বড় সন্তানকে বিদেশের মাটিতে ফেলে রেখে। আল্লাহ, তোমার কাছে প্রার্থনা, তুমি তাঁর হতভাগা এই সন্তানকে তার মায়ের খেদমতের পুরো হক্ক আদায়ের তওফিক দাও, আমিন।
বিষয়: বিবিধ
১৫০৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন