রোজনামচা-৭; চাবি বিড়ম্বনা
লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ০১ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ০৭:০২:২০ সকাল
১লা সেপ্টেম্বর, ২০১৩
গতকাল ছিল সাপ্তাহিক ছুটির প্রথমদিন। আজ দ্বিতীয় দিন। আগামীকাল আবার অফিস শুরু। আজকাল অফিসের কাজের চাপ অস্বাভাবিক বেড়ে গেছে। কারণ, আমরা আন্ডার স্টাফড।কেউ গেছেন ম্যাটারনিটি লীভ এ। কারো বাচ্চা হসপিটালাইজড। তাই মা হয়ে সময় দিতে হচেছ বাচ্চাকে। আবার কেউ অন্যত্র বদলী হয়ে গেছেন। সেই শূন্যস্থান পূরণে নেই কর্তৃপক্ষের কোন মাথাব্যথা।
ফলতঃ দাপ্তরিক কাজের এক বিরাট অংশ, গত্যন্তর না দেখে স্বল্পভাষী এবং নীরব কর্মী এই হতভাগার কাঁধে এসে চেপে বসে। সেই চাপ কিছুটা লাঘব করতে সিদ্ধান্ত নেই লাঞ্চের পরে কিছুটা সময় অফিসে গিয়ে কাজ করবো। যেই ভাবা সেই কাজ। লাঞ্চের পরে রেড়ী হলাম। কোথায় যাচ্ছো? গৃহমন্ত্রীর এ প্রশ্নের জবাবে তাকে খোঁচা দিতে বললাম, যাই বাইরে, ঘরে থাকলে তো আবার তোমার কাজের ডিসটার্ব হয়। (এর কিছুক্ষণ আগে উনার সাথে একটু মন কষাকষি হয়েছিল। ব্যাপার ছিল তিনি কিছু শাকসব্জীর জন্য বাজারে পাঠিয়েছিলেন। অনেকদিন পর একটু আঙ্গুরফলের স্বাদ নিতে মন চাইলো, যা ছিল গৃহমন্ত্রীর দেয়া লিস্টের বাইরে। আগপাছ না ভেবে একশত টাকার কিনেই ফেললাম। আর এতেই তিনি বেজায় নাখোশ। বেশ কিছুদিন হলো অর্থমন্ত্রীর পদটিও নিজের অধীনে রাখছেন তিনি, এজন্য একটু বেশী সতর্কতা।) আমি মিতভাষী বলেই হয়তঃ তিনি প্রগলভ। সাথে সাথে জবাব দিলেন, ইউ আর লাইং। হ্যাভ আই টোলড ইউ এনিথিং? মনে মনে প্রমাদ গুনলাম। কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ থাকাটাই সমীচীন মনে করলাম। কারণ, জ্ঞানীদের একটা কথা এসব ক্ষেত্রে সবসময় মনে রাখতে চেষ্টা করি, সেটা হলো "বোবার কোন শত্রু নেই"। কথা না বাড়িয়ে তাই সময়ক্ষেপণ না করে বেরিয়ে গেলাম, তিনি যা বুঝবার বুঝে নিলেন।(মোল্লার দৌড় মসজিদ পর্যন্ত, আর সাহেবের দৌড় অফিস পর্যন্ত)।
অফিসে ঢুকতে দুই রকমের চাবির প্রয়োজন হয়। প্রথমতঃ এনালগ এবং দ্বীতিয়তঃ ডিজিটাল চাবী। নির্দিষ্ট ছিদ্রপথে এনালগ(সাধারণ) চাবি ঘুরিয়ে পরে মাথার উপরে রাখা লাল বিন্দুবৎ বাতির উপর ব্যাংকের এটিএম কার্ড সাইজের একটি চৌকোনা সাদা কার্ড ঘুরিয়ে লাল বিন্দুটিকে সবুজ বিন্দুতে পরিণত করে দরজায় ধাক্কা দিলেই ভেতরে ঢুকবার অনুমতি মিলবে। নতুবা নয়। 'এ প্লাস বি হোল স্কয়ার' এই ফর্মূলাটি তাই মূখস্থ রাখার প্রয়োজন নেই। ক্লাস নাইন টেনে পাঠকালীন ঐ অতটুকু মূখস্থ তো করাই ছিল। তাই সেই অনুসারে ফর্মূলাটি প্রয়োগ করাই এখন যথেষ্ট। ঢুকে গেলাম অফিসে।
অফিসের দিন আর ছুটির দিনের অফিসের পরিবেশে বিশাল পার্থক্য। বিশাল অফিসের ভেতর সব কিছু নীরব, আলো আঁধারীর খেলা... । তাই একাকীত্ব হতে মুক্তির জন্য কম্প্যূটার খুলেই কাজ শুরুর আগে আমার প্রিয় শিল্পীদের হামদ নাত শোনার জন্য কী-বাটনে চাপ দিলাম। নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে প্রিয় নাত-খোঁয়া সাবিহউদ্দীন সাবিহ এবং 'হুরিয়া ফাহিম কাদরী'র গাওয়া একটি নাাত এর প্রথম কয়টি শব্দ (মদীনা আনে ওয়ালা হ্যায়, অথবা 'কা"বে কা রওনাক, কা'বে কা মানযার') টাইপ করে দিলে মূহুর্তের মধ্যে তা পর্দায় হাজির হয়। শুরু হয় কাজ করা আর হামদ না'ত শোনা একই সাথে। হুরিয়া ফাহিম এর অন্য একটি না'ত 'মারহাবা আজ চালেঙ্গে' না'তটি এবং একই মেজাজের কিছু না'ত যতোই এগিয়ে যায়, ততোই শ্রোতাদের অশ্রু ঝরার গতিও বাড়তে থাকে। ভিডিওটি দেখতে গিয়ে ও হৃদয়ঙ্গম করতে গিয়ে আমারও অনেক সময় তাই হয়েছে।
চলছিল আমার টাইপ ও ফাইলিং সমান তালে। এক সময় ঘড়ির দিকে নজর করে দেখি আছরের সময় ক্ষীণ হয়ে আসছে, তাই তাড়াহুড়ো করে উঠে ওয়াশ রুমের দিকে চলি। ওয়াশ রুমের অবস্থান মূল গেটের বাইরে। তাই সেই ফর্মূলা অনুযায়ীই দরজা খুলে যেতে হয়। তবে ভেতর থেকে ফর্মূলা প্রয়োগের একটি বাড়তি সুবিধা আছে। রিসিপশনিস্ট এর টেবিল এর পাশে একটি বাটন আছে, সেটি টিপলেই দরজা খুলে যাবে। আর এই বাড়তি সুবিধাটুকু গ্রহন করতে গিয়েই ঘটলো 'চাবি বিড়ম্বনার' আজকের উপাখ্যানটি। যদি আমার নিজস্ব চৌকোনা কার্ডটি দিয়ে খুলতাম তাহলে এই বিড়ম্বনার শিকার হতে হতোনা।
অযু করে এসে দরজা খুলতে গিয়ে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো। পকেটে চাবির বাক্সটি নেই। তাড়াহুড়ো করে উঠতে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে আর চৌকোনা ডিজিটাল চাবি-কার্ডটি উঠিয়ে নেয়া হয়েছিল না। এখন কি করবো। ঐ কার্ড ছাড়া বাইরে থেকে দরজা খোলার দ্বীতিয় কোন পথ নেই। দ্রুত বিকল্প সম্ভাবনাসমূহ মাথার কম্প্যূটারের খোল হতে উঠিয়ে আনার চেষ্টা করলাম। কোন কিছুই মাথায় ঢুকছে না বা বের হচ্ছেনা। এদিকে দেরী হলে নামাযও ক্বাজা হবে। আছর মাগরিব দুটোর সময়ই ডেঞ্জার বর্ডারে আছে। অন্য কিছু না ভেবে নামাজ পড়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম আগে। হাতের কাছে পাওয়া ছোট্ট একটি ম্যাট নিচে বিছিয়ে তার উপর দাঁড়িয়েই আছর পড়ে নিলাম। স্থান তো পবিত্র আছে, তাই নামায হয়ে যাবে। নামায শেষে আবারো দরজা খোলার চিন্তা।
ডিজিটাল যুগে অনেক সমস্যার সমাধান তাড়াতাড়ি হলেও অনেক সময় ডিজিটাল যন্ত্র হাতের কাছে না থাকলে বিপদ আরো ঘনীভূত হয়। যেমন, মোবাইল ব্যবহার শুরুর পরে, আগে যেমন অনেক ফোন নম্বর মাথার কম্প্যূটারে মেমোরাইজ করে রাখা হতো, এখন আর হয়না। সব সময় অন্যের উপর নির্ভর করলে যা হয়, মোবাইলের কল্যাণে তাই আমাদের মেমোরাইজিং পাওয়ারও শূণ্যের কোঠায় নেমে আসছে। মোবাইলটিও অফিসের ভেতরে। তাই নিকটস্থ কাউকে ফোন দিয়ে ডেকে এনে তার সাহায্য নেব সেই উপায়ও নেই। আজকে এ কঠিন অবস্থার শিকার হয়ে তাই প্রতিজ্ঞা করলাম, এবার থেকে ছোট্ট করে সবার ফোন নম্বর কাগজে লিখে তা মানিব্যাগওে রাখবো। সাহায্য পাবার একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল মনে। নীচে গিয়ে সিকিউরিটি গার্ডের কাছে রাখা ল্যান্ড টেলিফোন ব্যবহার করে দু একটি মূখস্থ থাকা ল্যান্ড নাম্বার এ ফোন করে কারো সাহায্য কামনা। ল্যান্ড নম্বরগুলো আকারে ছোট হয় বলে মূখস্থ রাখা সহজতর। যাহোক নীচে গিয়ে একজনকে ফোন করলাম, বিধি বাম। কেউ ধরছেনা, তার মানে তিনি বাসায় নেই। আর একজনের নম্বর পুরো মূখস্থ নেই। তাই আর করলাম না। নিজের বাসায় ফোন করে গিন্নী থেকে আরো কিছু নম্বর আদায় করা যেতো। সে চেষ্টা আর করলাম না। উনি তখন আমাকে দুপুরের রেশ ধরে পঁচাতে কিছু খাট্টা-মিঠা শোনাতে পারেন ভেবে।
যাক মাগরিবের সময় হয়ে গেছে। তাই উপরে গিয়ে এবার একই কায়দায় নামাজটি আদায় করলাম। নামাজ শেষে পূর্বের নাম্বারে আবার ট্রাই করলাম। এবারেও নীরব। সিদ্ধান্ত নিলাম দশ মিনিটের দূরত্বে থাকা অপর এক কলীগের বাসায় যাবো। আগেই যেতাম। কিন্তু ছুটির দিনে তাঁরা প্রায়ই বিকেলে বাসায় থাকেন না জানি। তাই দেরী করলাম। উনার বাসার নম্বর মূখস্থ থাকলে অবশ্য দীর্ঘ সময়ের মানসিক অস্বস্তি থেকে মুক্ত থাকতে পারতাম। উনার বাসায় গিয়ে তাঁকে পেয়ে গেলাম। এবার যেন হাঁফ ছাড়লাম আমি। যাহোক, সমস্যার সমাধান অতি নিকটে। তাঁর কাছ হতে কার্ড-চাবি সংগ্রহ করে অবশেষে অফিসে গিয়ে বাকি কাজটুকু কিছুটা এগিয়ে নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। ভাগ্যিস বয়স হয়েছে, ডুবে ডুবে জল খাওয়ার অবস্থানে নেই, বিদেশ বিভূঁই বলে সেই পরিবেশ ও নেই। যদি তা না হতো, তাহলে কোন কারণে যদি গিন্নী আমার মোবাইলে ফোন করে জবাব না পেয়ে, মিস কলের পর মিস কল দিতেন, আর ব্যর্থ হতেন, তা হলে কি তিনি মনে মনে অন্য কিছু কল্পনা করতেন না? করলে কি আর তাঁকে দোষ দেয়া যেতো? পাঠক আপনারাই বলুন।
বিষয়: বিবিধ
১৮২৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন