রোজনামচা -৪; ২৮শে আগস্ট, ২০১৩

লিখেছেন লিখেছেন ইবনে হাসেম ২৮ আগস্ট, ২০১৩, ০৪:৫২:২১ রাত

আলহামদুলিল্লাহ, আজ আবার একটু সময় পেলাম, তাই বসে গেলাম ল্যাপিতে।

পরিবেশের উপর একটু আলোকপাত করছিলাম গতকালের পর্বে। আরো কিছু জমে থাকা কথা এ ব্যাপারে বলে নিতে চাই। পরিবেশ যে মানুষের জীবনে কতভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তার বাস্তব নমূনা আমি নিজে। একসময় যা ভাবতাম অসম্ভব, আশ্চর্য্য এখন আমি তা অনায়াসেই করতে পারি। একমাত্র পরিবেশের প্রভাবের কারণেই। যেমন, কৈশোরে ভাবতাম মাথায় টুপি দেয়া ছাড়া নামাজ হবে না। ইটস্ মাস্ট। কিন্তু একটু বয়স হলে, হাদীস ঘেঁটে বুঝলাম, ওটা একটা সুন্নত, দিলে ভালো, না দিলেও নামাজ হবে। আগের বিশ্বাসে উপর একটু চিড় ধরলো। তারপরেও টুপি পরা ছাড়িনি। চাকুরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে ছিলাম সাত বছর। এসময়ে মসজিদে দেখতাম অধিকাংশেরই মাথায় টুপি গর হাজির। ধীরে ধীরে আগের অভ্যাসে আমার পরিবর্তন আসলো। টুপি না নিয়েই দৌড় দিতাম মসজিদে। সময়ের ব্যবধানে ঐ অভ্যাসের আরো অধঃপতন হলো। এখন ম্যানিলায় এসে এমন অবস্থা যে হাতের কাছে টুপি থাকলেও নামাজের সময় তা মাথায় দেবার কথা একবারো মনে আসেনা। একইভাবে থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট কখনো আমার ওয়ারড্রোবে শোভা পাবে ম্যানিলায় আসার আগে তা স্বপ্নেও কখনো ভাবিনি। এখন সেখানে দু, দুটি থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্ট শোভা পাচ্ছে। পরিও মাঝে মাঝে। অথচ আগে দেশীয় কোন লোককে ঐ অবস্থায় দেখলে তার সম্বন্ধে মনে যে ঘৃণা জম্মাতো, সেই কথা ভেবে এখন লজ্জিত হই। সবই পরিবেশ। পরিবেশে কিনা হতে পারে। তবে তা, বৃষ্টির দিনে বাড়ির কাছের বাজারে জরুরী কাজে যেতে লুঙ্গির বদলাবার প্রয়োজনে, অথবা ফ্ল্যাটের নীচে পুলে সাঁতার কাটতে মন চাইলে তখন। মনে পড়ে, যেদিন প্রথম থ্রি-কোয়ার্টার পরে, গায়ে গেঞ্জি চাপিয়ে লিফটে উঠেছি, পুলে যাবো বলে, সেদিন মনে মনে কতোই না জড়তা ভর করেছিল। লিফটে আরো কতো মানুষ। কিন্তু যখন ভাবলাম ধ্যাত ওরা তো আমার চাইতেও বেশী সংক্ষিপ্ত পোশাকে, তো ওদের সামনে কিসের লজ্জা? এভাবে ধীরে ধীরে ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক ভাবে নিয়ে আসি।

পরিবেশের পবিত্রতা ও ঐশীজ্ঞান সমৃদ্ধ নৈতিক শিক্ষা পরস্পর সম্পূরক। ঐশী শিক্ষার বাইরে প্রকৃতিগতভাবে মানুষ কিছু কিছু ভালো গুনের অধিকারী হয় বটে, কিন্তু ঐশী শিক্ষায় শিক্ষিত না হলে, বিরূপ পরিবেশে পড়ে সে ভালো গুনগুলো অনভ্যাসের কারণে বা প্রাকটিসের অভাবে ক্রমে মানুষের জীবন হতে হারিয়ে যায়। আবার ঐশী শিক্ষার প্রভাবে ঐসব ভালো গুনগুলোর উৎকর্ষ সাধিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঐশী শিক্ষায় শিক্ষিত হয়েও (যেমন মাদ্রাসা পড়ুয়া ব্যক্তি) অনেকে আছে বিরূদ্ধ পরিবেশে গিয়ে ক্রমে আমলবিহীন হয়ে পড়ে এবং তখন শয়তান তাকে তার শাগরেদ বানিয়ে নেয়। এজন্যই আমাদের নবী (সাঃ) বলেছেন, হাশরের দিন সব চাইতে কঠিন শাস্তি হবে এসব আমলবিহীন আলেমদের।

পরিবেশের বিষাক্ত ছোবলে আমলদার অনেক মানুষকে অনৈতিকতায় ডুবে হাবুডুবু খেতে দেখেছি। এমনই একজনের কথা এমূহুর্তে মনে পড়ছে।

তখন আমি যৌবনে পা দিয়েছি। বাবার সরকারী বাসা ছিল ধানমন্ডি ১৫ নম্বরে। একই দালানে থাকতেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। আমলের দিক দিয়ে ছিলেন খুবই অগ্রসর। টপ টু বটম সুন্নতী চেহারা। চার সন্তানের জনক। ঘুষ খেতেন না, তাই কোনরকম দিনযাপন করতেন। কিন্তু স্ত্রী তাঁর ছিলেন উচ্চাকাঙ্খী মহিলা। পাড়াপড়শীদের ঘরের চাকচিক্য ইত্যাদি দেখে দেখে স্বামীর সাথে চলতো রাতদিন ঝগড়া, অমুক এত ছোট চাকুরী করে, অথচ দেখ কি শান শওকতে আছে, আর তুমি এতবড় অফিসার হয়েও...... তোমার তো একটা পিয়নের আওকাত ও নাই.....। যা হয়ে থাকে সাধারণতঃ। এভাবে শুনতে শুনতে কাঁহাতক ঠিক থাকবেন তিনি। হঠাৎ একদিন চোখ খুলে আমরা দেখতে/শুনতে পেলাম পড়শী সে চাচা নাকি চিনির লাইসেন্স করেছেন এবং বাসার কাছেই এক চকলেট ফ্যাক্টরীতে চিনি বেচা, চকলেট এর কারখানার অংশীদারিত্ব অনেক কিছুই করে ফেলেছেন। পরিবারের চাল চলনে অনেক উন্নতি হয়েছে। কিন্তু চাচার বংশ কামেল ছিল বলতে হবে। মুরুব্বীদের দোয়া পেয়েছেন অনেক। বেশীদিন এ পেশায় থাকতে হয়নি। বছরখানেক পর সৌদী কোম্পানী 'আরামকো'তে (নাকি ও.আই.সি?)চাকুরী নিয়ে চলে যান। কিন্তু যেই স্ত্রীর কারণে সেই পদঙ্খলন হয়েছিল, আমাদের সেই চাচী (পড়শী চাচী) কিন্তু স্বামীর সে সুখের দিনের সঙ্গী হতে পারেন নি বেশীদিন। সৌদীতে যাবার বছর/দু বছর পরেই ক্যান্সার ধরা পড়ে তাঁর। লন্ডনে উন্নত চিকিৎসা করাতে যান। কিন্তু মরণব্যাধি ক্যান্সারে লন্ডনে চিকিৎসারত অবস্থাতেই তাঁর জীবনাবসান হয়।

আমাদের সেই চাচা (দেশের বাড়িও আমাদের জেলায়) প্রায় পনের বিশ বছর চাকুরী করে পেনশন নিয়ে এখন ঢাকাতেই নিজ ছয়তলা বাড়িতে আছেন, বউ (সেকেন্ড) বাচ্চাদের নিয়ে সুখে আছেন।

আমি কিন্তু জীবনে খুব একটা ভালো পরিবেশে বড় হয়েছি, তা বলা যাবে না। শিশুকালে করাচীতে বড় হয়েছি। সাধারণ স্কুলে পড়েছি। বাবার যৎসামান্য ইসলামী শিক্ষার ব্যাকগ্রাউন্ড ছিল, ঘরে ধর্মচর্চা মোটামুটি হতো, এই-ই ছিল মোটামুটি পরিবেশ। তাতে জীবনের বা মন মানসিকতার যতোটুকু ভীত গড়েছে, তা নিয়ে এ পর্য্যন্ত টিকে আছি, ভালো মন্দয় মিশিয়ে। নিজের দ্বীনি পরিচয়ের ব্যাপারে আমার এতটুকু গর্ব করার কিছু আছে বলে মনে হয় না। চাকুরী ব্যাপদেশে পরিবার নিয়ে বিভিন্ন বিরূপ পরিবেশে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। তাই, যতোটুকু ভালো থাকা মিনিমাম প্রয়োজন, ইসলামী পরিবারের পরিচয় দিতে পরিবারকে ঠিক রাখতে যতোটুকু সতর্ক থাকা প্রয়োজন, ততোটুকু থাকতে চেষ্টা করেছি, এতটুকুই বলতে পারি। আমেরিকা/ইউরোপে চাকুরী নিয়ে যাবার চান্স অনেক ছিল, একমাত্র পরিবেশের কথা চিন্তা করে, সন্তানদের কথা চিন্তা করে, কখনো ওমূখী হবার কথা মনেও আনিনি।

চলবে.....।

বিষয়: বিবিধ

১৩০৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File