জীবনের সৌকর্য কল্পনায় নয়, কর্মস্পৃহায় ।
লিখেছেন লিখেছেন মুজতাহিদ বাপ্পী ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০১:০৭:০২ দুপুর
একজন মানুষের জীবনী পড়ুন । তিনি যশোর সদর উপজেলার বকচর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন । বেঁচে ছিলেন ১৮৭৮ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত । পর্যবেক্ষণমূলক জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার দিক থেকে ভারত উপমহাদেশের সফলতম জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের একজন । যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়েন তখন তাদের পাঠ্যবই ছিল চারুপাঠ । সেখানে একটি প্রবন্ধ ছিল যার নাম "ব্রহ্মাণ্ড কি প্রকাণ্ড" । এই প্রবন্ধ পড়ে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন । ১০ বছর বয়সে যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর ইংরেজি শিক্ষার পাশাপাশি তিনি আকাশের তারা দেখা শুরু করেন । বকচরের একতলা বাড়ির ছাদ থেকে প্রতিদিন সন্ধ্যায় তিনি আকাশ দেখতেন । কিন্তু কোন উপযুক্ত জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক শিক্ষা না থাকায় প্রথমদিকে তাকে বেশ সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় । ১৪ বছর বয়সে তিনি আকাশের তারা চেনার ব্যাপারে সিদ্ধ হয়ে উঠেন । তখন পর্যন্ত তার কোন দূরবীন ছিলোনা । চারবার প্রবেশিকা পরীক্ষায় অংশ নেন এবং অকৃতকার্য হন । বারবার অকৃতকার্য হয়ে তিনি পড়াশোনার পাট চুকিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন । প্রথম দুই বছর তাকে বেকার জীবন কাটাতে হয় । এরপর যশোর কালেকটরেট অফিসে খাজাঞ্চির চাকুরি পান । এসময় তার মাসিক বেতন ছিল মাত্র ১৫ টাকা । এ থেকে পরে তিনি ট্রেজারি ক্লার্ক ও কোষাধ্যক্ষের পদে প্রমোশন পান । অবসর নেবার সময় তার মাসিক বেতন ছিল ১৭৫ টাকা ।
১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু আকাশে আবির্ভূত হয় । প্রথমে খালি চোখে ও পরে একটি বাইনোকুলার দিয়ে তিনি নিজের পর্যবেক্ষণ লিখে রাখলেন । ১৯১২ সালের দিকে বেতনের টাকা ও খানিকটা জমি বিক্রির টাকা দিয়ে একটি দূরবিন সংগ্রহ করেন । এটি ৩ ইঞ্চি ব্যাসের একটি প্রতিসরণ দুরবিন ছিল । ১৯১২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুরবিনটি ইংল্যান্ডের F. Bernard থেকে মেসার্স কক্স সিপিং এজেন্সি লিমিটেড এর মাধ্যমে তার কাছে আসে । তাকে খুব হিসেব করে চলতে হতো । সাংসারিক খরচের দায়িত্ব থেকে আকাশ চর্চায় যা ব্যয় হত তা তিনি লিখে রাখতেন । সম্পূর্ণ দূরবিনটির দাম পড়েছিল ১৬০ টাকা ১০ আনা ৬ পাই । এই হিসেবটি তার খাতায় লেখা ছিল । প্রথমে মূল দূরবিনটির টিউব ছিল কার্ডবোর্ডের তৈরি । পরে তিনি আরও ৯৬ টাকা ১০ আনা খরচ করে ইংল্যান্ডের মেসার্স ক্লার্কসন থেকে পিতলের টিউব আনিয়ে নেন এবং দূরবিনটির উন্নতি সাধন করেন । স্টার অ্যাটলাস দিয়েও তিনি আকাশ পর্যবেক্ষন করেন । জুন ৭, ১৯১৮ সালে তিনি আকাশে একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র দেখতে পেলেন যা তার নক্ষত্রের মানচিত্রে ছিল না । তিনি এই পর্যবেক্ষণের কথা হাভার্ড মানমন্দিরে জানান এবং এভাবেই নোভা অ্যাকুইলা-৩ আবিস্কৃত হয় । পরে তাকে আমেরিকান এসোসিয়েসন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজারভারস ('American Association of Variable Star Observers'- AAVSO) সম্মানসূচক সদস্যপদ প্রদান করে । ১৯১৯ থেকে ১৯৫৪ এর মধ্যে তিনি ৩৭২১৫ টি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন এবং এসব তথ্য আভসো (AAVSO) কে প্রদান করেন । তার এই কার্যক্রমের জন্য তিনি সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেবে ১৯৪৬ সালে প্রকাশিত আভসোর এক তালিকায় স্থান পেয়েছেন । বাংলাদেশে জীবনের অধিকাংশ সময় কাটালেও ১৯৪৭-এ ভারত বিভাগের কিছুকাল পর তিনি ভারতে চলে যান ।
মার্কিন সরকার তাকে একটি দূরবীন উপহার দিয়েছিলো । এছাড়া তিনিও জমি বিক্রি করে দূরবীন কিনেছিলেন । ভারতে যাবার সময় তিনি দূরবীন নিয়ে যান । কিন্তু বেনাপোল বন্দরে কাস্টম্স কর্তৃপক্ষ তার দূরবীন বাজেয়াপ্ত করে । এরপর ভারতে গিয়ে তিনি আমেরিকা ও ফ্রান্স সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন । পরে যশোরের ডিসি বাড়িতে এসে তার দূরবীন ফেরত দিয়ে যান । ১৯২৬ সালে হাভার্ড মানমন্দির থেকে তাকে একটি ছয় ইঞ্চি ব্যাসের দূরবীণ পাঠানো হয় । দূরবীনের সঙ্গে হাভার্ড মানমন্দিরের পরিচালক হ্যারলো শ্যাপলির লেখা চিঠি - “বিদেশ থেকে পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা যে সব পর্যবেক্ষন মূলক তথ্য পেয়ে থাকি তার মধ্যে আপনার দান অন্যতম । আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।” ফরাসি সরকার ১৯২৮ সালে পরিবর্তনশীল নক্ষত্রের ওপর তার কাজের জন্য তাকে OARF (Officer d'Academic Republic Francaise) পদক প্রদান করে । শেষ বয়সে তার বেশ আর্থিক অনটন দেখা দিয়েছিলো । ১৯৭৫ সালের এপ্রিল ৩ তারিখে ৯৭ বছর বয়সে একরকম বিনা চিকিৎসায় ভারতের বারাসাতে ভদ্রলোক মৃত্যুবরণ করেন । তার নাম রাধাগোবিন্দ চন্দ্র ।
“A man can change anything: his face, his family, his girlfriend, his religion, his God. But there’s something a man can’t change. A man can’t change his passion”
বিষয়: বিবিধ
১৫১১ বার পঠিত, ১০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
কর্মস্পৃহার পাশাপাশি ঐশী প্রতিভা না থাকলে কোন সফলতা আশা করা যায় না।
দুনোটার সম্মিলিত রুপই ব্যক্তি কে স্মরণীয় করে রাখে।
রাধাগোবিন্দ চরণ কে পরিচয় করিয়ে দেয়ায় অনেক ধন্যবাদ .....
আপনাকে ধন্যবাদ ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন