বিশদলীয় ঐক্যজোট কি তাহলে ভেঙ্গেই যাচ্ছে ?
লিখেছেন লিখেছেন মুজতাহিদ বাপ্পী ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৪, ০৯:৪৭:২৩ সকাল
আফ্রিকায় একটা প্রবাদ আছে- "বহুদূর যেতে চাও ? সবাই মিলেমিশে যাও । দ্রুত যদি যেতে চাও, একাকী যাও ।" রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে জোট গঠনের ক্ষেত্রে বোধহয় এটা ভালো একটা সূত্র । বিশেষ করে গত কয়েকদিনে দেশীয় রাজনীতিতে বেশ কয়েকটি নাটকীয় বিষয় লক্ষ্য করা গিয়েছে । আওয়ামী-শাহবাগী-জাতিয়তাবাদী-জামায়াতী- প্রায় সবাই শিরোনাম দখল করেছিলো । তবে বিশদলীয় ঐক্যজোটে ভাঙ্গন সৃষ্টির প্রয়াস এবং জোটভুক্ত দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাস্তবতা এড়িয়ে যাবার প্রচেষ্টা- আমার কাছে বেশি দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে । নিজের কিছু উপলব্ধি এখানে শেয়ার করলাম । কাউকে হেয় করা আমার উদ্দেশ্য নয় । রাজনীতি শেখার জন্য প্রতিটা মুহূর্তে চোখ-কান খোলা রাখতে হয় । প্রতিটা ইভেন্ট গুরুত্ব দিয়ে উপলব্ধি করতে হয় । রাজনীতির ছাত্র হিসেবেই আমি এটা করে থাকি ।
ইদানীং জামায়াত নেতাদের নামে মানবতা বিরোধী অপরাধের রায় একে একে দেয়া হচ্ছে । আদালত যখন ঘোষণা করে- "যেকোন দিন রায় হবে" তখন বোঝার বাকি থাকেনা প্রতিটা রায় হবে সরকারের এক একটা দাবার চাল । দাবা খেলায় যেমন আপনি সকল নিয়ম কানুন জানা থাকার পরেও চাল দিতে দেরি করেন, আপনার বেস্ট মুভ কোনটা হবে সেটা বাছাই করতে সময় লাগে, ঠিক তেমনি আদালতের রায় তৈরি থাকার পরেও সরকার বেস্ট টাইমিং এবং ম্যাক্সিমাম ইমপেক্ট তৈরির সুযোগ নেয় । তবে এটা বিরোধী পলিটিশিয়ানরা জানেন না এমন নয় । তারপরেও সরকারের চালগুলো সফলতা পায় । কেনো ? সেটাই আমাদের আলোচ্য বিষয় ।
আমরা বিশদলীয় জোটের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে যতটুকু জানি- এটি নিছক ক্ষমতায় যাবার একটা সোপান । এখানে সাম্যবাদী পার্টির মূলনীতি একজন ছাত্রদল কর্মী জানেনা, কল্যানপার্টির ভবিষ্যৎ নিয়ে একজন শিবিরকর্মী ভাবেনা । আন্দালিব রহমান পার্থ যে আশায় জোটে এসেছেন, শফিউল আলম প্রধান একই চাহিদা থেকে এসেছেন । জোট খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী হবে এমন আশাও কেউ করেনা । যতোদিন নিজ নিজ দলীয় স্বার্থ রক্ষা হয়, ততদিন জোট রক্ষার আগ্রহ থাকবে । মুখে যতোই বড়ো কথা বলা হোক, দলীয় স্বার্থের বাইরে এখানে কিছু নেই । সবাই চেষ্টা করবে তার দলের জন্যে সর্বোচ্চ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে, এটাই স্বাভাবিক । তারপরেও জোটের রাজনীতি করতে হলে দলের কিছু নিয়ম নীতি উপেক্ষা করতেই হয় । কিছু ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, কিছু পরাজয় মেনে নিতে হয় । বিশদলীয় জোটে বর্তমানে যারা আছেন সবার মধ্যেই কমবেশী ত্যাগের মানসিকতা এবং ঔদার্য রয়েছে মেনে নিচ্ছি । অন্তত আওয়ামী লীগের চাইতে এই দলগুলো দেশের জন্য কম ক্ষতিকর । এমন নিরীহ দলের জোটে তাহলে ফাটল হয় কেনো ? উত্তর খুব একটা সহজ নয় । আমার কাছে যে তিনটি কারণ জোটে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য দায়ী বলে মনে হয়েছে তা হলো-
১। বিশদলীয় জোটের সূচনা হয়েছিলো চারদলীয় জোট থেকে । যতদিন চারদলীয় জোট ছিলো, তখনো আওয়ামী লীগ এবং মহাজোট চেয়েছে চারদল ভেঙ্গে আলাদা করে দিতে । তখনো জামায়াতকে রাজাকার আখ্যা দিয়ে বিচার দাবি করা হয়েছে, তারেক-কোকোর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ছিলো, জোটের ভেতরে সন্দেহভাজন কিছুু লোক তখনো ছিলো । তবু জোটে ভাঙ্গন ধরাতে কেউ সক্ষম হয়নি । কিন্তু জোট বড় করার সিদ্ধান্ত যখন নেয়া হয়, তখন আর জোটের মূল উদ্দেশ্যটুকু নতুন দল গুলোর কাছে এতোটা পরিস্কার করা হয়নি । জোটের সমন্বয়ক কে হবে, আহবায়ক কে হবে, কি ধরনের কর্মকান্ডে জোটকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত হবে, কি ধরনের কর্মকান্ডে দলীয় সীমারেখা বজায় রেখে চলা যাবে, তার স্পষ্ট নির্দেশনা ছিলোনা । ফলাফল যা হয়েছে- বৃহত্তম শরীক হবার কারণে বিএনপি নিজেরাই জোটের সকল সিদ্ধান্ত নেয়া শুরু করে দিয়েছে । বিএনপির স্থায়ী কমিটি আগের দিন সভা ডেকে যে সিদ্ধান্ত নেয়, পরের দিন জোটের মহাসচিবগণ একই সিদ্ধান্ত কেবল মাথা নেড়ে সম্মতি দেন । শরিক দলগুলো মানসম্মানের খাতিরে কর্মসূচি বাস্তবায়নে বাধ্য হয় । কিন্তু বিএনপির দলীয় অঙ্গসংগঠনগুলো যখন বুঝতে পারে- জোটের কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে আঘাত এলে দল থেকে খুব একটা সুবিধা নেয়া যাবেনা- তখন বিএনপির প্রতিটি অঙ্গসংগঠন দুর্বল হতে শুরু করে । এভাবে নিছক জোটনির্ভর দলে পরিনত হয় বিএনপি । রাজধানীতে পথসভার মতো নিরামিষ কর্মসূচি করতে গেলেও ফ্লপ হয় । বিএনপির প্রতি জোটের শরীকেরা হতাশ হতে থাকে ।
২। সবচেয়ে বড় শরীক বিএনপিকে ধ্বংস করার জন্যে সরকার দুর্দান্ত সব পরিকল্পনা করতে থাকে । প্রথম আলো-ডেইলী স্টার মার্কা সুশীল সমাজকে দিয়ে বিএনপির নীতিনির্ধারণী একটা অংশকে হোটেলে-রেস্টুরেন্টে খাইয়ে, আওয়ামী চ্যানেলের টকশোতে কথা বলার সুযোগ দিয়ে, সংলাপের নামে সম্পর্ক তৈরি করে, ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় করে ফেলা হয় । কুশলী এবং চৌকষ কিছু মানুষকে কারারুদ্ধ করা হয় । অপরদিকে সরকারের চরম রোষানলে পড়ে জামায়াতে ইসলামী বাঁচা-মরার লড়াই শুরু করতে বাধ্য হয় । কিন্তু অন্য শরীকদের উপর আওয়ামী আক্রোশ এতোটা হয়নি । এভাবে জোটের শরীক দলগুলোর মধ্যে বিভিন্ন মাত্রার আক্রমন হবার কারণে তাদের সরকারবিরোধিতা বিভিন্ন মাত্রার হয়ে পড়ে । কেউ কেউ চুড়ান্ত পর্যায়ের আন্দোলন করতে চাইলেও বাকিরা নিয়মরক্ষার বিরোধিতা বেছে নেয় । বিএনপি অনেক সময় জামায়াতকে ছাড়া অন্য দলের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে সমাবেশ করে একটা পার্থক্য তৈরির অজুহাত বানিয়ে দেয় । জামায়াত অনেক ক্ষেত্রে বিএনপির কাছ থেকে জোট সম্পর্কের বাইরে নিজেদের দলীয় সংকটে সমর্থন আশা করে । জোটের ছোটদল গুলো হয়ে পড়ে আন্দোলনবিমুখ এবং সুশীলমার্কা । এভাবে বছরের পর বছর সময় দেয়া হয় আওয়ামী লীগকে । প্রতিবেশী দেশের কুশিলবগণ আওয়ামী লীগকে সুসংহত রেখে বিরোধীদেরকে বিপর্যস্ত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পায় । জোটভুক্ত তৃণমূল কর্মীদের মধ্যে প্রচন্ড ক্ষোভ জমা হয় । কর্মীদের ক্ষোভ একাংশের নেতাদেরকে প্রভাবিত করতে সময় লাগেনা ।
৩। বড় শরীক হিসেবে জোটের আন্দোলন মুখ থুবড়ে পড়ার বেশি দায় বিএনপির উপরই বর্তাবে এটাই স্বাভাবিক । কেবল ছাত্রদলের কমিটি গঠনের দৃষ্টান্ত দেখেই অনেক কিছু স্পষ্ট হয়ে যায় । বিএনপি নিজেদের দল গোছানোর অজুহাতে আন্দোলনে বিরতি দেয় । কিন্তু ঢাকা মহানগরীর কমিটি গঠনের ঘোষণা দেবার পরও আহবায়ক কমিটি পর্যন্তই তাদের পদক্ষেপ বাস্তবায়ন হয় । একই পরিণতি ঘটেছে ছাত্রদলের ক্ষেত্রে । আহবায়ক কমিটি নামের অভিশাপে আটকা পড়েছে বিএনপির মূল শক্তি ছাত্রদল । এই আহবায়কেরা সর্বদা আন্দোলনমুখী কর্মীদের নিষ্ক্রিয় হওয়া পর্যন্ত সময় নেয় । তারপর নিষ্ক্রিয় নেতাদের নামে যখন কমিটি গঠন করা হয় তখন আর আন্দোলনের কাজে লাগেনা এই কমিটি । ফলাফল- ছাত্রদল হয় নিষ্ক্রিয় । বিএনপি হয় প্রাণহীন । জোটের অবস্থা কেরোসিন । এভাবে নিজ দলের বিশৃঙ্খলা সামাল দিতে না পেরে বিএনপি বাকি শরীক দলগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ হারায় । জোট হয় ক্ষতিগ্রস্থ । আর ক্ষতিগ্রস্থ অবস্থা যদি না দেখার ভান করা হয়- সেটা ধীরে ধীরে বীজ থেকে মহীরুহে পরিণত হবে এটাই নিয়তি ।
কৈফিয়ত হলো- আমি নিখুঁত ক্যালকুলেশন করে কখনোই স্ট্যাটাস দিইনা । নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করি মাত্র । অনেকের কাছে এই লেখা পছন্দ নাও হতে পারে । একপেশে মনে হতে পারে । এ ধরনের সেনসিটিভ ইস্যু নিয়ে নিরপেক্ষ পোস্ট লেখা প্রায় অসম্ভব । তাই কারো কটুকথার তোয়াক্কা করা আপাতত বাদ দিয়েছি ।
আমি এখনো বিশদলীয় জোটের প্রতি শ্রদ্ধাশীল । বিএনপি এবং জোট নেতৃবৃন্দ যদি তাদের প্রতি এতো বেশি মানুষের সমর্থনকে কাজে লাগাতে না পারে, সরকারের প্রতি সর্বস্তরের মানুষের তীব্র ক্ষোভ এবং ঘৃণাকে রাজনৈতিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে না পারে, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তাদেরকে ঠিক ততোটাই অথর্ব মনে করবে যতোটা আমরা এযুগে আরব লীগ বা ওআইসি কে মনে করে থাকি । তবে এখনো যদি জোটের নীতিমালা এবং কার্যক্রম মনিটরিং করার জন্য এমন একটা সর্বদলীয় কমিটি থাকে, যেই কমিটির মেম্বারগণ নিজদলীয় অন্তর্কোন্দল নিয়ে দিনের পর দিন ব্যস্ত থাকবেনা, কোন শরীক দলকে ছোট মনে করে এড়িয়ে চলবেনা, বড় দলের নিজস্ব এজেন্ডাকে জোটের মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা করবেনা, অবাস্তব আন্দোলনের আশা দিয়ে জাতির কাছে ঐক্যজোটকে খেলো করবেনা, আওয়ামী লীগের সাথে সংলাপের আশায় আন্দোলন থেকে গা বাঁচিয়ে চলার নীতি গ্রহণ করবেনা- তাহলে জোটভুক্ত শরীক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস অনেকটাই কমে আসবে । মানুষের দীর্ঘদিনের আশা- বিরোধীদলের চূড়ান্ত আন্দোলন তখন বাস্তবতায় রুপ নিবে । কারণ আওয়ামী লীগ যে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছে, সমপরিমান বা তার চেয়ে বড় আন্দোলন ছাড়া ওদেরকে সরানো যাবেনা । এক্ষেত্রে যদি বিদেশী বন্ধুদের পরামর্শ রাখতে গিয়ে জোটের শক্তিকে উপেক্ষা করতেই থাকি, হয়তো জোটের ভাঙ্গন রোধ করা সম্ভব হবেনা । অথবা ভাঙ্গন না হলেও ততদিনে কঙ্কালসার জোট নিয়ে আওয়ামী মহাজোটকে মোকাবিলা করা দুরাশা-ই থেকে যাবে ।
বিষয়: বিবিধ
১৫১৫ বার পঠিত, ৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন