গাজা সংক্রান্ত কতিপয় ভাবনা
লিখেছেন লিখেছেন মুজতাহিদ বাপ্পী ১২ জুলাই, ২০১৪, ১১:৪৭:৪২ রাত
জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রচুর আবিষ্কার আমাদের উপকারে লেগেছে, নীতি-নৈতিকতার অনেক তাত্ত্বিক ধারণা আমাদের মননকে সমৃদ্ধ করেছে । কিন্তু "গ্লোবাল ভিলেজ" বা "ওপেন মার্কেট ইকোনমি", "প্যারালাল ইউনিভার্স " বা "স্ট্রিং থিওরী", কোনটাই মুসলিমদের জন্য এতোটা কাজে লাগেনি যতোটা কাজে লেগেছে "তীব্র নিন্দা" এবং "দোয়া তত্ত্ব" । দিকে দিকে মুসলিমদের মধ্যে হত্যাকান্ডের বিষয়ে তীব্র নিন্দা এবং দোয়া-প্রার্থনার আচার যে হারে বেড়েছে, কিছুদিন পর হয়তো তারা জীববস্তু নাকি জড়বস্তু এটা নিয়ে জর্জ গ্যালাওয়ের উত্তরসূরী কেউ প্রশ্ন তুলবেন । ইদানিংকালে হারামাইন শরীফাইনের অমেরুদন্ডী সতীত্বের গর্ব যেনো ভ্যাটিকেনের সোডোমি স্ক্যান্ডালের চেয়েও জঘন্য ঠেকছে । আসাম-মিয়ানমার থেকে উইঘুর, মসুল-দামেস্ক থেকে গাজা, কোথাও কোন মুসলিমের পক্ষে মক্কা-মদীনার পাগড়ী গুলো উঠে দাঁড়াতে দেখা গেলোনা । অথচ শাহবাগী প্ররোচনায় আমাদের সরকার যখন হেফাজত নিধনে ব্রত হয়েছিলো তখন পোপ বলেছিলেন সরকারের উচিত আস্তিক-নাস্তিকদের মধ্যে আলোচনার ব্যবস্থা করা । অন্তত বাংলাদেশের ঘটনাগুলো যে পোপের নজর এড়ায়নি সেটা আমরা দেখেছি । কিন্তু মক্কা-মদীনা থেকে পৃথিবীর কোন দুর্যোগেই একটা শক্ত দিক নির্দেশনা বা আহবান শুনতে পেলাম না এ পর্যন্ত । ওরা তাহলে কি চায় মুনাজাতে ? কি কামনা করে আল্লাহর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে ? হাশরের ময়দান ছাড়া সম্ভবত এই প্রশ্নের কোন উত্তর মিলবেনা । অবশ্য আমরাও কম করিনি । রোহিঙ্গা-বিহারী বা প্রতিপক্ষের মুসলিমদের প্রতি আমাদের আচরণ জায়নিস্টদের চাইতে খুব একটা ভালো তা কেউ বলতে পারবেনা । তবে আমাদের সান্ত্বনা এটুকুই- যদি ফিলিস্তিনি শিশুরা আল্লাহর আদালতে আমাদের বিরুদ্ধে আঙ্গুল তুলে, তবে আমরাও কিছু মহামনীষী বেশধারী জোব্বা-পাগড়ির দিকে আঙ্গুল তুলতে পারব
ফিলিস্তিনের পরিণতি এ অবস্থায় এসে দাঁড়ানোর জন্য আরব জাতি সবচেয়ে বেশি দায়ী বলে আমি মনে করি । হামাসের যে কয়টা রকেট-বুলেট এখনো বাকি আছে এগুলো অযথা তেলআবিবের দিকে নষ্ট না করে রিয়াদের দিকে ছোঁড়া উচিত । আরব রাজপ্রাসাদে শিশুদের রক্ত দিয়ে সৌদী রাজাদের পায়জামা-পাগড়ি-কোর্তা-আলখাল্লা রঞ্জিত করে বুঝিয়ে দিতে হবে ত্রাণের টাকায় রক্তের বদলা হয়না । ইসরাঈল তার অস্তিত্বের প্রয়োজনে আক্রমণ করে, জায়নিস্টরা রাতের আকাশে ফায়ারওয়ার্ক দেখার জন্য গাজায় হামলাকে সমর্থন করে, আর মধ্যপ্রাচ্যের লাহাব-জেহেলের বংশধরেরা এই গণহত্যা দেখে নিরব থাকে যেনো হামাস বা মুসলিম ব্রাদারহুডের নেতারা আরব রাজ হেরেমে ত্রাণ সাহায্যের জন্য হাত পাতে আর পরোক্ষভাবে রাজবংশগুলোকে স্বীকার করে নেয় । আরব-ইসরাঈল যুদ্ধে পরাজয়ের পর থেকে যতো লাশ পড়েছে তার ভাগ শুধু ফিলিস্তিনবাসী নিয়েছে । এবার সময় হয়েছে সমগ্র আরবে লাশ বন্টন করে দেয়ার । মক্কা-মদীনায় দুম্বা খেয়ে গাজাবাসীর জন্য অশ্রুপাতের বিলাসিতা থেকে আরব জাতিও রক্ষা পাবে ।
গাজা উপত্যকায় নিহত মুসলিমের জন্য শোক এবং মাতম এর সাথে বিশ্বকাপ ফুটবল খেলাকে মিলিয়ে আবেগময় ফেসবুক স্ট্যাটাস প্রসবের রেইট দেখে আমরা বুঝতে পারি কেনো এতগুলা উম্মাহর আস্ফালন ইসরায়েলকে ছয় দশকেও থামাতে পারেনি । ছোটকাল থেকেই দেখে আসছি হেবরনে গণহত্যা-সেব্রেনিসায় গণহত্যা নিয়ে মুসলিম উম্মাহ বেশ সোচ্চার ছিলো । তাদের সোচ্চার থাকার কৌশল গুলো এতোই হাস্যকর আর শিশুসুলভ যে এগুলো দেখেই বলে দেয়া যায় গাজা থেকে উইঘুর পর্যন্ত মুসলিমরা আরো কয়েক দশক ধরে মরতেই থাকবে, কাউকে মারতে পারবেনা । আপনারা যারা আবেগে কাইন্দালাইতেসেন, শুধু একটা প্রশ্নের উত্তর দিন । এমন কোন মুসলিম কি আছে যে বর্তমান গাজা হত্যাকান্ডে ব্যাথিত নয় ? বিগত ছয় দশকে কি আপনার মতো শোকাহত মর্দে মুজাহিদ পৃথিবীতে কম এসেছে ? তারপরেও মাহমুদ আব্বাসেরা ক্ষমতায় থেকে শান্তির পায়রা উড়ায়, আপনারা কাসসাম ব্রিগেডের অতিপ্রাকৃতিক শক্তি নিয়ে ফেসবুকে ইসরায়েলকে নিশ্চিণ্হ করে ফেলেন, বাস্তবে শ্যারন থেকে নেতানিয়াহুরা ঠিকই জিতে যায় ! এসব আবলামী ছাড়ার বয়স কি এখনো হয়নি আপনাদের ? শোক জানাবেন ভালো কথা । তাই বলে, "হে মুসলিম উম্মাহ, তোমরা সবাই বিশ্বকাপ খেলা দেখতেসো আর আমি ইসরায়েলের সব জায়নিস্টকে ভিডিও গেইমে কোপায়া ফেলতেসি" মার্কা স্ট্যাটাস দিয়ে আপনার ভেতরের বেকুবটাকে রোজার মাসেও না বের করলে কি চলে না ? আপনার ফেসবুক দোয়াতে গাজায় কোন লাভ হবেনা এটা কবে আর বুঝবেন ! অতএব- এমন আবেগ প্রদর্শন করবেন না যেটা মুসলিমদের জাতিগত দৈন্যকে আরো প্রকট করে । দোয়া করতে হলে যেভাবে করার নিয়ম সেভাবেই করুন । যুদ্ধ করতে হলেও যেভাবে করা প্রয়োজন সেভাবেই করুন । ফেসবুকে মুসলিম বা মুজাহিদের অভিনয় করবেন না ।
যারাই জয়লাভ করে, তারাই আমাদের থেকে দূরে । অথবা আমরাই যেনো তাদের থেকে দূরে । ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর আমরা যখন ভেবেছি এটা উম্মাহর জন্য একটা আশার আলো, তখনই একদল তাত্ত্বিক এসে ফতোয়াবাজি শুরু করলেন- এটা শিয়া বিপ্লব, আমাদের জন্য নয় । তালেবান যখন আফগানে ক্ষমতাসীন হলো, আমাদের গবেষক দল নিশ্চিত করলেন এরা গন্ডমূর্খ-অপদার্থ, এরা আমাদের লোক নয় । ফলাফল- ইরান একাই গোটা পশ্চিমাবিশ্বের সাথে কূটনৈতিক লড়াই চালিয়ে গেলো তিরিশ বছর । কেউ ইসলামী জযবা নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়ালো না । আফগানিস্তানে তালেবান একাই লড়ে গেলো দশ বছর, কেউ তাদের সঙ্গী হলোনা । লেবাননে হাসান নাসরুল্লাহ যখন ইসরাঈলের বিরুদ্ধে বিজয়ের তাকবীর দিতে গেলেন, আমরাই তার দোষ ধরে ধরে শত্রুর কাতারে দাঁড় করিয়ে দিলাম । এখন যুদ্ধবিধ্বস্ত ইরাক-সিরিয়াতে আইসিস কে নিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা শুরু করেছিলাম, তক্ষুনি মুফতিদের নিষেধাজ্ঞা চলে আসতে লাগলো । "খিলাফত ঘোষণার কারণে আইসিস আমাদের সমর্থন পেতে পারেনা, ওরা চক্রান্তকারী, ইত্যাদি ইত্যাদি । অথচ খিলাফত ঘোষণা তাদের যুদ্ধের কৌশল কিনা সেটাও কেউ আলোচনা করতে যায়নি । এমনকি এরদোগান যখন আধুনিক তুরস্কের কাজে হাত দিয়েছিলেন তখনো তিনি আমাদের লোক ছিলেন বলে শুনিনি । মুসলিমদের কোন একটা দল যখন কিছুটা বিজয়ের স্বাদ পায়, অন্য সবাই যেনো ফতোয়াবাজির মাধ্যমে তাদেরকে কাঠগড়ায় পাঠাতে ব্যস্ত হয়ে যায় । অপরদিকে যারা প্রতিনিয়ত মরে আর মার খায়, তারা সবাই কিভাবে জানি আমাদের লোক হয়ে যায় । হামাস-ব্রাদারহুড সহ যাবতীয় হতভাগা-পরাজিত-নির্যাতিত জনস্রোত সব নাকি খাঁটি মুসলিম, বাকিরা সবাই কিছুটা হলেও পথভ্রষ্ট । এই গোলকধাঁধা থেকে আমার মতো সাধারণ পাবলিক কখনো বের হতে পারেনা । আসলেই কি হামাস সঠিক আর আইসিস ভুল ? আসলেই কি ব্রাদারহুড খাঁটি আর হিজবুল্লাহ ভন্ড ? নাকি হীনম্মন্যতার কারণে কিছুটা পরশ্রীকাতরতাও ঢুকে পড়েছে আমাদের মনোজগতে ! ইদানিং আর এতো দুর্ভাগ্যের হিসাব মেলাতে পারিনা ।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১২৫৮ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লিখেছেন। ধন্যবাদ আপনাকে
মন্তব্য করতে লগইন করুন