”খন্জর সিংহ”
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১৮, ১১:৪৫:০৯ রাত
তারা ছিল মরুভূমির সন্তান। উষর মরুর নির্মম রোদ আর রাতের হাড় কাপান শিতলতা তাদের করেছিল নির্দয় আত্বকেন্দ্রিক। একফোটা পানি আর একটু সবুজ ঘাসের জন্য তারা ছুটে যেত শত শত মাইল। ঘোড়া ছিল তাদের বাহন, তাদের ঘরবাড়ি এমনকি তাদের খাদ্য! ঘোটকির দুধ থেকে তৈরি পানিয় কুমিস এ চুমুক দিয়ে তারা ছুটত বায়ুবেগে। তারা ছিল গোত্রে গোত্রে বিভক্ত। একটু পানির উৎস,ঘোড়া আর ভেড়ার জন্য মরুর প্রান্তরে জন্মান সবুজ ঘাস দখল আর রক্ষায় তারা নির্দ্বিধায় জীবন দিত। শান্তি শব্দটি তাদের অজানা। প্রতিটি মুহর্ত ছিল তাদের সংগ্রামের। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তত থাকত প্রতিদন্দ্বি গোত্রের আক্রমন এর ভয়ে। উত্তরে চীনের প্রাচির, দক্ষিনে আকাশছোয়া হিমালয় আর পূর্বে প্রশান্ত মহাসাগরের মধ্যে ছিল তাদের বিচরন। পশ্চিমে দুস্তর মরুটা শুধু মাঝে মাঝে তারা পার হত। নতুন কোন পানির উৎসের খোজে।
নতুন পানির উৎসের খোজে পশ্চিমে এগিয়ে যাওয়া এমন এক গোত্র উপস্থিত হল আরল সাগর এর তিরে। অফুরন্ত মিষ্টি পানির উৎসটি তাদের জীবনযাত্রা কে ভিন্ন করে দিল।ভবঘুরের মত এখানে ওখানে ঘুরতে থাকা বাদ দিয়ে তারা তাবুর বদলে গড়ে তুলতে লাগল কুটির। প্রাকৃতিকভাবে জন্মান বুনো ঘাসের দানার উপর নির্ভরশিলতা কমিয়ে নিজেরাই শুরু করল কৃষিকাজ। আশেপাশের অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে তাদের প্রথমে সংঘাত আর পরে সম্পর্ক গড়ে উঠল। উত্তর দিকে রাশিয়ানরা তাদের নাম দিল অঘুজ তুর্কি। আরল থেকে কাস্পিয়ান পর্যন্ত বিস্তৃত হল তাদের প্রভাব।আমু নদির মিষ্টি পানি তাদের কে ভুলিয়ে দিল মরুর কূপের লবনাক্ত পানির স্বাদ। গোত্র থেকে তারা একটি জাতিতে পরিনত হল। যাযাবর জীবন ছেড়ে শহরবাসে অভ্যস্ত হয়ে উঠলেও তদের রক্তে রয়ে গেল তাদের পূর্বপুরুষের যোদ্ধা আর কঠোর পরিশ্রম এর জীবনের প্রশিক্ষন। যা তাদের কে পরিনত করল এক যোদ্ধা জাতিতে।
কখনও কখনও তাদের রাজ্যে আসত ভিন্ন দেশের ব্যবসায়িরা। যাদের ভাষা আচরন আর পোষাক সবই ভিন্ন। প্রকৃতি পূজারি এই জাতি অবাক হয়ে দেখত তাদের ভিন্ন পোষাক আর আচরন। দুয়েকজন আলবুরজ পর্বত এর সীমা পেরিয়ে দেখতে যেত এই ব্যবসায়িদের দেশ কে। তারা দেখে আসত ইটপাথরের দালান আর অতুল ঐশ্বর্যের চমক। কেউ কেউ উত্তরে তুষার শোভিত রুশভুমিতে যেত। তারা আকর্ষিত হত এই দেশগুলির মানুষের জীবনযাত্রায়। তাদের আদর্শ ও ধর্মতেও। ৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দে তাদের এক নেতা সেলজুক বেগ পুরাতন ধর্ম ও জীবনাদর্শকে ত্যাগ করে গ্রহন করলেন নতুন ধর্ম ইসলাম। তারপর তার অজেয় তুর্কমেন বাহিনিকে নিয়ে কাস্পিয়ান এর পশ্চিম তিরের দিকে রওনা দেন।
সেলজুক বেগ প্রাচীন ইরান সাম্রাজ্যের এলাকায় স্থাপন করলেনে একটি রাজ্য। আব্বাসিয় খলিফার কাছ থেকে সুলতান হিসেবে স্বাধিন শাসক এর স্বিকৃতি ও পেলেন।তার উত্তরাধিকারি তুঘরিল এর রাজ্য বিস্তৃত হতে লাগল তাদের পূর্ব বাসস্থান আরল এর তির থেকে শুরু করে ইরাক এর উত্তরে আনতোলিয়া পর্যন্ত। বাগদাদ ও জয় করলেন তিনি বুয়ায়িদ শাসকদের কাছ থেকে আর তা ফিরিয়ে দিলেন আব্বাসিয় খলিফা আল কাইম কে। যদিও খলিফা শুধু নামেমাত্র অধিশ্বর হলেন। সুলতান তুঘরল হলেন খিলাফত এর প্রকৃত নিয়ন্ত্রক।তার উত্তরাধিকারি ভাতিজা আলপ আরসালান আর তার পু্ত্র মালিক শাহ এর সময় ও বজায় রইল এই সাম্রাজ্য। আলপ আরসালান আর মালিক শাহ এর সুযোগ্য উপদেষ্টা নিযামুল মুলক এর সুব্যবস্থাপনায় তার প্রতিষ্ঠিত সালতানাত আর অব্বাসিয় খিলাফত এর অবস্থা মোটামুটি ভালই ছিল।
কাতলমিস ছিলেন আলপ আরসালান এর জ্ঞাতি ভাই। সেলজুক ও তুঘরল এর সাথি হিসেবে তিনি অনেক যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে সেলজুক সাম্রাজ্য বিস্তৃত হয় কৃষ্ণ সাগর এর তির পর্যন্ত। এই এলাকা স্বাধিন ভাবে শাসন করতেন তিনি। কাতলমিস আলপ আরসালান এর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন সেলজুক সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে।তিনি পরাজিত হন। তার পুত্র সুলায়মান পালিয়ে গিয়ে টরাস পর্বতমালার একটি স্বাধিন তুর্কমান গোত্রের কাছে আশ্রয় নেন। তিনি তাদের নেতা নির্বাচিত হন। ১০৭৬ খ্রিষ্টাব্দে বাইজানটাইন তথা পূর্ব রোমক সাম্রাজ্যের অধিপতি ৭ম মাইকেল তার সাহা্জ্য চান পশ্চিম আনতোলিয়ার খৃষ্টান অধিপতি নিসফোরাস এর হাত থেকে কনষ্টান্টিনোপল কে রক্ষা করতে। সুলায়মান সারা দেন। নিসফোরাস এর উপর আক্রমন করলে নিসফোরাস তাকে প্রস্তাব দেন যে তিনি যদি তার সাথে যুদ্ধ না করেন তবে তাকে ও তার সহযোগিদের আনতোলিয়ায় স্থায়ি ভাবে আশ্রয় দেওয়া হবে। সুলায়মান রাজি হয়ে যান এবং মাইকেল এর পক্ষ ত্যোগ করেন। সুলায়মান ও তার গোত্র কে বসফরাস এর তিরে বসতি স্থাপন করতে দেওয়া হয়। দুই বছর পর নিসফোরাস এর বিদ্রোহ ব্যার্থ হওয়ার পর তার উত্তরাধিকারিরা বিপদে পরে যান। এ অবস্থায় তারা তাদের রাজধানি ঐতিহাসিক নিসিয়া নগরি সুলায়মান এর হাতে সমর্পন করেন। সুলায়মান নিসিয়া কে রাজধানি করে নতুন একটি সালতানাত এর পত্তন করেন যার নাম হয় রুম সালাতানত।
কিলিজ আরসালান।তুর্কি ভাষায় কিলিজ শব্দের অর্থ খনজর আর আরসালান মানে সিংহ। ১০৭৯ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম নেন সুলায়মান এর এই পুত্র। সত্যিই তিনি ছিলেন খন্জর এর মত দৃঢ় আর সিংহের ন্যায় দুর্দম।তার পিতা সুলায়মান রুম এ স্বাধিন সুলতান হিসেবে শক্তি অর্জন করে ১০৮৬ খৃষ্টাব্দে আক্রমন করেন সিরিয়ার এন্টিয়ক বা আন্তাকিয়া শহর। কিন্তু মালিক শাহ এর অনুগত সিরিয়ার সেলজুক প্রশাসক তুতুস এর কাছে পরাজিত ও নিহত হন সুলায়মান। তার পুত্র কিলিজ আরসালান কে গ্রেফতার করে করে মালিক শাহ নির্বাসিত করেন ইরানে।১০৯২ খৃষ্টাব্দের শেষ দিকে সুযোগ্য উজির নিযামুল মুলক এর অবসর ও হত্যা এবং সুলতান মালিক শাহ এর ইন্তেকাল সেলজুক সাম্রাজ্য কে ছিন্নভিন্ন করে দেয়। কিলিজ আরসালান মুক্তি পেয়েই তার অনুগত তুর্কমেনদের সাথে নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তার পিতার রাজধানি নিসিয়ার দিকে। মালিক শাহ এর প্রতিনিধি আমিন গজনভি কে উচ্ছেদ করে সুলতান হন যখন তিনি তার বয়স আঠার বছর ও হয়নি তখনও।
মালিক শাহ এর ইন্তেকাল এর পর এক জাতি হয়ে ওঠা সেলজুকরা আবারও বিভক্ত হয়ে পরে গোত্রে গোত্রে। সংঘাত আর রক্তপাত চলতে থাকে সিরিয়া থেকে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত। ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় সিরিয়া আর আনতোলিয়ার বিস্তর্ন ভুমি। প্রত্যেক অধিপতি একে অপর এর রক্তপান করতে যেন উদ্বেল হয়ে উঠে। মুসলিম সমাজের এই অবস্থা দেখে বাইজান্টাইন কনস্টান্টিনোপল এর অধিপতি আলেক্সিস একটি সুবর্ন সুযোগ দেখেন এশিয়ায় রোমান সাম্রাজ্য পুনর্উদ্ধার এর। এই জন্য তিনি পূর্ব রোমান তথা বাইজান্টাইন সাম্রাজ্যের একসময় এর প্রধান শত্রু পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের ধর্মিয় প্রধান পোপ দ্বিতিয় আরবান এর কাছে সহায়তা চান। পোপ আরবান তাতে সারা দেন।
১০৯৬ খৃষ্টাব্দে। নিসিয়ার রাজপ্রাসাদে খবর আসে বসফরাস পার হয়ে চল্লিশ হাজার ইউরোপিয় প্রবেশ করেছে তার রাজ্যে। বিস্মিত সুলতান আরো জানতে পারেন এরা বাইজান্টাইন নয় বরং পশ্চিম ইউরোপের নাগরিক।বিনা অনুমতিতে তার রাজ্যসীমায় শুধু প্রবেশ ই করেনি তার প্রজা মুসলিম ও অর্থডোক্স খৃষ্টান দের উপর বিভিন্ন অত্যাচার ও করছে তারা। তাদের পোষাক জেরুসালেমগামি তির্থযাত্রিদের মত হলেও তাদের আচরন যোদ্ধার কিংবা ডাকাতের! দ্রুতই তাদের দমন করার জন্য সেনাবাহিনি পাঠালেন সুলতান।নিসিয়ার নিকটে তাদের সঙ্গে সংঘর্ষ হল সুলতানের বাহিনির। সে বাহিনিতে তখন প্রায় বিশহাজার এর বেশি লোক ছিল। সুলতান কিলিজ আরসালান সম্পুর্ন সেই বাহিনীকে ধ্বংস করে দেন। তার সৈনিক ছিল মাত্র পাচ হাজার। চারভাগের একভাগ শক্তি নিয়েই তিনি বিশাল বাহিনিটিকে পরাজিত করে স্বস্তি ফিরিয়ে আনেন তার সাম্রাজ্যে।
কিন্তু তিনি খেয়াল করেননি তার হাতে পরাজিত এই বিশাল বাহিনিতে প্রশিক্ষিত সৈনিক বেশি ছিলনা। বেশিরভাগই ছিল যুদ্ধবিদ্যায় অজ্ঞ কৃষক পরিবার থেকে আসা ধর্মোন্নমত কিছু বিশৃংঙ্খল মানুষ। ইউরোপে খরা জনিত অভাব থেকে বাঁচতে আর পোপের ঘোষনামত পাপ স্খলন করতে যোগ দিয়েছিল প্রাচ্যগামি এই বাহিনিতে। তাদের পিছনে আসছিল আরেকটি সুসজ্জিত সামরিক দল। তাদের লক্ষ্য জেরুসালেম। পোপ তাদের পরিধান করার অধিকার দিয়েছেন এর ক্রুস শোভিত পোষাক। যা তাদের কে ক্রুসেডার হিসেবে চিন্হিত করবে
বিষয়: বিবিধ
১০৯৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন