স্মরনে ফাতিমা আল ফিহরি
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২৩ নভেম্বর, ২০১৭, ১০:৫৫:৫০ রাত
ফাতিমা আল ফিহরি। নামটি হয়তো আমাদের অনেকেরই অপরিচিত। কিন্তু এই মহান নারী ছিলেন বিশ্বের শিক্ষার অগ্রদূত। ৮০০ খ্রিষ্টাব্দে এই মহিয়সি নারী জন্ম নেন আধুনিক তিউনিসিয়ার অন্তর্ভুক্ত কারওয়াইন শহরে। তার পিতা মুহাম্মদ আল ফিহরি ছিলেন একজন বিখ্যাত ব্যবসায়ি। ব্যবসার জন্য তিনি আধুনিক মরক্কোর ফেজ নগরিতে বসতি স্থাপন করেন। তার ছিল দুই কন্যা ফাতিমা আল ফিহরি এবং মারিয়ম আল ফিহরি। পিতার ইন্তেকাল এর পর তার বিপুল সম্পদ এর উত্তরাধিকার পান তারা দুই বোন। তারা দুজনই ছিলেন উচ্চশিক্ষিতা এবং বিদ্যোৎসাহি। উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া বিপুল সম্পদ তারা দুই বোন মুসলিম জাতির কল্যানের জন্য ব্যায় করার সিদ্ধান্ত নেন। মরিয়ম আল ফিহরি প্রতিষ্ঠা করেন ফেজ শহরের আল-আন্দালুস মসজিদ। ফাতিমা আল ফিহরি তাদের জন্মভুমির নাম অনুসারে প্রতিষ্ঠা করেন কারওয়াইন মসজিদ। এই মসজিদ এর সাথে তিনি স্থাপন করেন একটি মাদ্রাসা এবং পাঠাগার। ফাতিমা আল ফিহরি ৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। তার সম্পদগুলি তিনি ওয়াকফ করে দিয়ে যান এই মসজিদ ও মাদ্রাসার জন্য। পাশাপাশি তৎকালিন ফেজ এর শাসকরা ও এই প্রতিষ্ঠান এর পৃষ্টপোষকতা করেন।
আল কারওয়াইন কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখনও জ্ঞান বিতরন করে যাচ্ছে। ইউনেস্কো এবং গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কে এখনও চালু থাকা বিশ্বের সর্বপ্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্বিকৃতি দিয়েছে। আনুষ্ঠানিক ভাবে এই মসজিদ ও মাদ্রসার যাত্রা শুরু হয় ৮৫৯ খ্রিষ্টাব্দে। মুসলিম বিশ্বের অসংখ্য বিখ্যাত মনিষি এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা লাভ করেছেন যার মধ্যে আছেন ইবনে খালদুন ও ভুগোলবিদ আল ইদ্রিসি। মুসলিমদের পাশাপাশি সমসাময়িক ইউরোপের অনেক ইহুদি ও খৃষ্টানও এখানে শিক্ষা লাভ করেন। যাদের মধ্যে একজন জারবার্ট পরবর্তিতে খৃষ্টজগতের প্রধান ধর্মগুরু পোপ দ্বিতিয় সিলভেস্ট্রা হয়েছিলেন। ইসলামি শিক্ষার পাশাপাশি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়া হত গনিত,দর্শন এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞান। এখানে শিক্ষা নিতে তাই সবারই আগ্রহ ছিল।
এই প্রতিষ্ঠানটি স্থানিয় বিভিন্ন বংশিয় মুসলিম শাসক ছাড়াও স্পেন এবং বাগদাদ এর খিলাফত এর পৃষ্টপোষকতাও লাভ করে। এর মধ্যে কর্ডোভার বিদ্যোৎসাহি উমাইয়া খলিফা তৃত্বিয় আবদুর রহমান এর অবদান বিশিষ্ট। তিনি আল কারওয়াইন মসজিদ এবং মাদ্রাসার ভবন নতুন করে নির্মান করে দেন এবং কয়েকটি মিনার তৈরি করান। ১১৩৫ সালে মোরাভিদ বংশিয় সুলতান আলি ইবনে ইউসুফ সম্পুর্ন মসজিদ এবং মাদ্রাসা ও সংলগ্ন গ্রন্থাগার এর পুননির্মান করান। পশ্চিম মরক্কোর মারিনিদ বংশিয় সুলতান দ্বিতিয় আবু সেলিম ১৩৫৯ সালে একটি মিনার নির্মান করেন যেখানে জৌর্তিবিজ্ঞান পর্যবেক্ষনাগার বা অবজারভেটরি ছিল। কালের বিবর্তনে এই প্রতিষ্ঠান রাজকিয় পৃষ্টপোষকতা হারায়। কিন্তু তবুও এর শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে। যদিও তখন শুধু ইসলামি আইন ও ধর্মই গুরুত্ব পেতে থাকে। গনিত বা প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এরম ত বিষয়গুলির গুরত্ব কমে যায়। ১৯৬৩ সালে ফরাসি ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হওয়ার পর মরক্কো সরকার এই প্রতিষ্ঠানকে পুর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বিকৃতি দেয়।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সময় ই এর সাথে প্রতিষ্ঠা করা হয় একটি গ্রন্থাগার। এই গ্রন্থাগারটি বর্তমানে বিশ্বের প্রাচীনতম গ্রন্থাগার এর স্বিকৃতি পেয়েছে। সমমাময়িক সকল গ্রন্থই এই গ্রন্থাগারে সংরক্ষিত হত। এখানে সংরক্ষিত পান্ডুলিপিগুলির মধ্যে রয়েছে ইমাম মালিক এর লিখিত হাদিস গ্রন্থ ”আল মুয়াত্তা” এর মুল কপি। ইবনে ইসহাক এর রচিত সীরাত এর ও একটি প্রাথমিক মুলকপি এখানে সংরক্ষিত আছে। ইবনে খালদুন এর মুল রচনাবলিও অনেকগুলিই এখানে সংরক্ষিত রয়েছে। এখানে প্রায় ৪০০০ এর মত পান্ডুলিপি সংরক্ষিত আছে আল-কুরআন ও হাদিস এর প্রাচীনতম পান্ডুলিপিগুলি সহ। আছে মুসলিম স্বর্নযুগের গনিত, প্রাকৃতিক বিজ্ঞান এবং দর্শন বিষয়ক অনেক পান্ডুলিপিও।
এই ঐতিহাসিক বিশ্ববিদ্যালয় কে অনেকেই স্বিকৃতি দিতে চাননা এই যুক্তিতে যে এটা আসলে বিশ্ববিদ্যালয় নয়। ৮৫৯ সালে যখন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তখন সংগঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এর ধারনাই ছিল ইউরোপে অপ্রচলিত। এমনকি কর্ডোভা এবং এই আল কারওয়াইন এ শিক্ষালাভ কারি পোপ সিলভেস্ত্রাই প্রথম ইউরোপে সংখ্যাভিত্তিক গনিত এর ধারনা প্রচার করেন ১০০০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে। ইউরোপে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় ১০৮৮ খ্রিষ্টাব্দে ইতালির বলগোনায়। ১৯১২ সালে যখন ফরাসিরা মরক্কো দখলে করে তখন আল কারওয়াইন কে উচ্ছেদ করার চেষ্টা করেছিল ইতিহাস মুছে দেওয়ার জন্য। কিন্তু সফল হয়নি তারা। প্রায় সাড়ে এগারশ বছর এর বেশি ধরে মুসলিম বিদূষি ফাতিমা আল ফিহরির এই অবদান এখনও শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
বিষয়: বিবিধ
১১৯১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন