নির্ভয়া, সুজেট, হেতাল এবং বিলকিস বানু।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৮ মে, ২০১৭, ০৯:৩৫:৩৫ রাত
নির্ভয়া কারো নাম নয়। ২০১২ সালের ১৬ই ডিসেম্বের ভারতের রাজধানি নয়াদিল্লিতে রাত ১১ টা বাজে পাবলিক বাসে গনর্ধষন ও হত্যার শিকার হওয়া ২৩ বছর বয়সি ফিজিওথেরাপির ছাত্রির মিডিয়ার দেওয়া ছদ্মনাম। নির্ভয়া কারো নাম নয়। ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভারতের রাজধানি নয়াদিল্লিতে রাত ১১ টা বাজে পাবলিক বাসে গনধর্ষন ও হত্যার শিকার হওয়া ২৩ বছর বয়সি ফিজিওথেরাপির ছাত্রির মিডিয়ার দেওয়া ছদ্মনাম। রাত্রের শো তে সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরছিলেন নির্ভয়া এবং তার এক ছেলেবন্ধু। নির্জনে সুযোগ পেয়ে সেই বাসেরই পাঁচজন কর্মচারি তার উপর অত্যাচার চালান এবং মারাত্মক আহত করেন। তিনদিন পর নির্ভয়া হাসপাতালে মারা যান। তার বন্ধুকেও প্রচন্ড মারধোর করা হয় যার জন্য সে এখন পঙ্গু। ঘটনাটি তাৎক্ষনিক ভাবে মিডিয়াতে প্রচন্ড আলোড়ন সৃষ্টি করে। সারা ভারতই ঘটনার নিন্দায় এবং বিচারের দাবিতে আন্দোলন হয়। দির্ঘ তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়া শেষে গত ৫ই মে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই কাজে জড়িত ৪ জন কে মৃত্যুদন্ড দেওয়ার চুড়ান্ত রায় দেয়। রায়ে এটা বলা হয়েছে যে এদের আচরন এমনই যে এখানে ক্ষমা বা দয়া প্রদর্শন এর সুযোগ নেই। সরোচ্চ আদালত এর এই রায় এর পর শাস্তি এখন নিশ্চিত। অভিযুক্ত আরো একজন থাকলেও তাকে ঘটনার সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক থাকায় কোন শাস্তি দেওয়া হয়নি। তিন বছর রিহ্যাবিলেটেশন সেন্টার এ থাকার পর এখন সে একটি স্বেচ্ছাসেবি সংস্থার তত্বাবধানে আছে।
একই বছরের আরেকটি আলোচিত কান্ড ঘটে ভারতেরই কলকাতায়। সুজেট জর্ডান নামের এক মহিলা ৪ জন পুরুষ এর বিরুদ্ধে তাকে ধর্ষন এর অভিযোগ আনেন। তার ভাষ্যমতে ঘটনাটি ঘটে ২০১২ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি। যদিও তিনি অভিযোগ আনেন মাসের প্রায় শেষ দিকে। বিষয়টি একপর্যায়ে রাজনৈতিক রুপ নেয়। যখন পশ্চিমবঙ্গের তৎকালিন সদ্য নিযুক্ত মুখ্যমন্ত্রি মমতা বন্দোপাধ্যায় এটাকে সাজান ঘটনা বলে মন্তব্য করেন। শুরু হয় মিডিয়া ও সোস্যাল মিডিয়ায় আন্দোলন। ঘটনাটি পার্ক স্ট্রিট কান্ড নামে পরিচিত লাভ করে। শেষ পর্যন্ত মামলা নেওয়া হয় এবং তদন্ত ও বিচার শেষে অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেওয়া হয়। প্রধান অভিযুক্ত ছিলেন কলকাতার এক ধনি মুসলিম পরিবারের সন্তান কাদের খান দির্ঘদিন পলাতক থাকার পর এই বছর এর শুরুর দিকে গ্রেফতার হয়। মামলা চলাকালিন সময়ে মিডিয়া ও পুলিশ এর অনুসন্ধানে একটা কথা উঠে যে অভিযোগকারিনি সুজেট একজন কলগার্ল এবং অভিযুক্তরা তার সাথে তার সম্মতিতেই মিলিত হয়েছেন। কিন্তু এটাকে ধর্ষন এর অভিযোগ এর বিরুদ্ধে গ্রহনযোগ্য যুক্তি বলে আদালত গ্রহন করেনি। বিষয়টি কলকাতা হাইকোর্ট ফয়সালা হলেও এখনও সম্ভবত সুপ্রিম কোর্ট এর আপিল এর সুযোগ আছে। প্রথম ঘটনাটির সাথে এই ঘটনাটির একটা পার্থক্য আছে। অভিযুক্তদের পক্ষে কিছু যুক্তি থাকায় তাদের অতি কঠোর শাস্তি হয়নি। যদিও একজন কলগার্ল এর সাথে তাদের সম্পর্ আইনি দিক দিয়ে কোন সমস্যা না হলেও নৈতিক দিক দিয়ে অবশ্যই তাদের কিছু শাস্তি প্রয়োজন ছিল।
হেতাল পারেখ ছিলেন কলকাতা নিবাসি একজন গুজরাটি ব্যবসায়ির কন্যা। ১৯৯০ সালে তাকে তাদের পারিবারিক ফ্ল্যাট এ মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়। তাকে ধর্ষন ও হত্যার অভিযোগ আনা হয় ফ্ল্যাটবাড়িটির সিকুরিটি গার্ড ধনঞ্জয় এর বিরুদ্ধে। দির্ঘদিন বিচার চলার পর এই অভিযোগে ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় এর ফাঁসি কার্যকর করা হয়। প্রত্যক্ষ প্রমান না থাকা সত্বেয় কেবলমাত্র পারিপ্বার্শক প্রমান ও পুলিশি রিপোর্ট এর প্রেক্ষিতে এই দন্ড দেওয়া হয়। কিন্তু মামলা চলাকালিন সময়িই এই অভিযোগ উঠে যে ধনঞ্জয় কে ফাঁসিয়েছে পুলিশ। কিন্তু প্রধানত গুজরাটি ব্যবসায়ি সম্প্রদায় এর চাপেই তাকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তার ফাঁসির পরও কয়েকজন অনুসন্ধানি সাংবাদিক এই মামলার রায় এবং প্রমানগুলি নিয়ে গবেষনা করেন এবং তাদের মতামত হচ্ছে ধনঞ্জয় নিরপরাধ ছিলেন এবং তিনি পুলিশি ষড়যন্ত্রের শিকার। এই কেসটি আবার চালু করার চেষ্টা করছেন কয়েকজন এখনও। যাতে মৃত্যুর পরে হলেও অভিযোগ হতে রেহাই পায় ধনঞ্জয়।
এই ঘটনাগুলির সাথে বিলকিস বানু মামলার বেশ বড় ধরনের পার্থক্য আছে। বিলকিস বানু গুজরাটের এক মুসলিম পরিবারের কন্যা ও বধু। ২০০২ সালে গুজরাটের ভয়াবহ মুসলিম নিধন এর সময় তার পরিবারের সাথে পালাচ্ছিলেন তিনি। এমন সময় কিছু হিন্দু দাঙ্গাকারি তাকে সহ তার পরিবারের সদস্যদের ধরে ফেলে। সকল পুরুষকে প্রথমে হত্যা করা হয়। হত্যা করা হয় সাথে বিলকিস বানুর ৩ বছর বয়সি কন্যা কেও। এরপর পাশবিক অত্যাচার করা হয় তিনি সহ তার পরিবার এর অন্যান্য নারি দের উপর। একপর্যায়ে তিনি বেহুশ হয়ে যান। প্রায় দেড়দিন পার হুশ ফিরলে তিনি দেখেন যে বাকি সবাই মৃত্যুবরন করেছেন। অনেক কষ্টে তিনি একজন আদিবাসির ঘরে আশ্রয় নেন। কিছুটা সুস্থ হলে আহমেদাবাদ শহরে আশ্রয়নিয়ে পুলিশে অভিযোগ দিতে যান। কিন্তু তৎকালিন গুজরাট এর নরেন্দ্র মোদি সরকার এর পুলিশ তার অভিযোগ নেয়নি। পরবর্তিতে মানবাধিকার কর্মিদের চেষ্টায় অভিযোগ নেয়। কিন্তু এসময় ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য গেলে ডাক্তাররা তার আইনি পরীক্ষা দুরে থাক ঠিকমত সাস্থ্য সেবা ও দেননি। এর মধ্যেও দমে না গিয়ে তিনি মানবাধিকার কর্মিদের সাথে যোগাযোগ করেন এবং শেষ পর্যন্ত পুলিশ তার অভিযোগ গ্রহন করে। কিন্তু পুলিশি তদন্তে অসংখ্য গাফিলতি রেখে দেয় এবং নিন্মআদালাত অভিযুক্তদের খালাস দেয়। তিনি পুনরায় তদন্ত ও বিচার এর দাবি করেন এবং বিচারকাজ রাজনৈতিক প্রভাব এড়ানর জন্য গুজরাটের বাইরে নিয়ে যাওয়ার আবেদন করেন। সুপ্রিম কোর্ট সেই আবেদন গ্রহন করে। ভারতের কেন্দ্রিয় তদন্ত ব্যুরো কে পুনরায় তদন্ত করতে বলা হয় এবং বিচার এর দায়িত্ব দেওয়া হয় মুম্বাই হাইকোর্ট কে। দির্ঘদিন এই মামলা চলার পর গত ৬ ই মে মুম্বাই হাইকোর্ট এই মামলায় অভিযুক্তদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়। হাইকোর্ট এর বিচারপতিরা রায়ে এটা উল্লেখ করেন যে অপরাধটি নির্ভয়া কান্ডের মত নৃশংস হলেও পুলিশি গাফিলতির কারনে অভিযুক্তদের চরম দন্ড দেওয়া যাচ্ছেনা। কারন পুলিশি তদন্তের গাফিলতি তে অনেক প্রমান নষ্ট হয়ে গেছে। বিলকিস বানুর এই লড়াই কিছুটা হলেও সফল হলো এর মাধ্যমে।
এই ঘটনাগুলির প্রত্যেকটিই নৃশংস ও অমানবিক হলেও এর প্রত্যেকটির প্রকৃতি আলাদা। একজন কে হত্যার অপরাধে নির্ভয়া কান্ডে চারজন কে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হলেও একাধিক হত্যার অপরাধে বিলকিস বানু মামলায় চরম দন্ড দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে হেতালপারেখ ও পার্কষ্ট্রিট মামলার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে উভয় মামলাতেই অভিযুক্তদের পক্ষে কিছু যুক্তি থাকা সত্বেয়ও মিডিয়া মানুষের আবেগের প্রভাব পরেছে বিচারে। একই প্রভাব নির্ভয়ার পক্ষেও পরেছে বলে মনে হয়। দিল্লির আইনজিবি সমিতি প্রথমে এই মামলায় কেউ আসামি পক্ষ সমর্থন করবেনা বলে সিদ্ধান্ত নিলেও সম্ভবত আদালত এর প্রভাবে এটা কার্যকর হয়নি। নৃশংস অপরাধে অভিযুক্ত হলেও বিচার পাওয়ার অধিকার সবার আছে। এই মামলাগুলির মধ্যে সবচেয়ে পরিস্কার মামলা ছিল নির্ভয়া মামলা। মারাত্বক আহত অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর আগেই নির্ভয়া পুলিশকে ঘটনার বিবরন নিজেই দিয়েছিল এবং তার বন্ধু প্রত্যক্ষদর্শি সাক্ষি ছিল। একই ঘটনা বিলকিস বানুর ক্ষেত্রেও ঘটেছে। নিজেই অত্যাচারিত এবং প্রত্যক্ষদর্শি এবং অন্যান্য পারিপ্বার্কসাক্ষ্য ও তার কথার সত্যতা প্রমান করেছে। কিন্তু আইনের ফাঁকে পুলিশি ষড়যন্ত্রের মুখে তার পক্ষে কঠোর রায় হয়নি। অন্যদিকে অপরদুটি ঘটনার একটি পার্কষ্ট্রিট কান্ডে দেখা যায় প্রধানত জনমতএর চাপেই রায় দেওয়া হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে অভিযুক্তরা আইনি দিকে নিরপরাধ থাকার সম্ভাবনা থাকলেও তারা যে নৈতিক দিক দিয়ে অপরাধি সেই সন্দেহ নেই। হেতাল পারেখ এর ঘটনার সময় সোস্যাল মিডিয়া বলে কিছু ছিলনা। তখন ভারতে প্রাইভেট টিভি চ্যানেল চালু হলেও সেগুলি ছিল শুধু বিনোদনমুলক চ্যানেল সংবাদ বা বিশ্লেষন সেখানে ছিলনা। তখন পুলিশি তদন্তের গাফিলতি মানুষের সামনে আসতে পারেনি। তবুও সেটা এখন মানুষের সামনে এসেছে এবং পুনরায় বিবেচনার দাবি উঠছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশে অনেকটা পার্কষ্ট্রিট কান্ডের মতই একটা ঘটনা ঘটেছে। স্যোসাল মিডিয়াও এই নিয়ে যথেষ্ট সরব হয়েছে। ঘটনার পক্ষে বিপক্ষে তথ্য ও যুক্তিও উপস্থাপিত হচ্ছে। আমি মনে করি সকলের উচিত বিষয়টাকে গভিরভাবে পর্যবেক্ষন করা। যাতে করে পুলিশ বা কোন প্রভাবশালি শক্তি একে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে না পারে। অভিযুক্ত ও অভিযোগকারি উভয়েরই ন্যায় বিচার পাওয়ার অধিকার আছে। স্যোসাল মিডিয়ার উচিত ন্যায়বিচার এর পক্ষে আন্দোলন গড়ে তোলা। অভিযুক্ত যেমন আইনি অপরাধি হতে পারে অভিযোগকারি ও হতে পারে নৈতিক অপরাধি। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। আর রাষ্ট্র নির্মান করে মানুষ। তাই মানুষই এই ন্যায়বিচার এর নিশ্চয়তা দিতে পারে। কোন অন্ধ মাটির দেবিমুর্তি ন্যায়বিচার এর নিশ্চয়তা দিতে পারেনা যে নিজেই চলতে সক্ষম নয়।
কৈফিয়ত:- কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন যে কেন আমি উদাহরন হিসেবে শুধু ভারতে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছি। এর কারন এমন ঘটনা আমাদের দেশে আগে একাধিক ঘটলেও আমাদের মেইনস্ট্রিম মিডিয়ার সাংবাদিকগন তৈল প্রদানে যতটা দক্ষ এই ধরনের ঘটনার বিশ্লেষন এবং অনুসন্ধানি সংবাদ তৈরিতে ততটাই অক্ষম। আমার কাছে বাংলাদেশে সংগঠিত এই ধরনের কোন ঘটনার বিবরন বিচারপ্রক্রিয়া ও রায় সম্পর্কে কোন তথ্য নেই। আর উদাহরন হিসেবে ভারতিয় ঘটনা দেওয়ার আরেকটি কারন হচ্ছে উভয় দেশের আর্থসামাজিক অবস্থা প্রায় কাছাকাছি। শুধু ভারতিয় মিডিয়া ও বিচারবিভাগ আমাদের তুলনায় অনেক বেশি স্বাধিন ও দক্ষ।
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৫ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন