কাশ্মির। ভৌগলিক রাজনৈতিক অবস্থার ইতিহাস।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০১৬, ১১:৪৫:৪৯ রাত
ভারত অধিকৃত কাশ্মির এর পরিস্থিতি এখন মিডিয়ার প্রধান সংবাদ। সামাজিক যোগাযোগ সাইট গুলিতেও এই বিষয়ে অনেকেই মন্তব্য ও মত প্রকাশ করছেন। অনেকেই দেখা যাচ্ছে বিষয়টিকে কেবল ভারত-পাকিস্তান সংঘাত হিসেবে দেখছেন। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তা নয়। কাশ্মির এর এই সংঘাত ঐতিহাসিক এবং বর্তমান অবস্থার জন্য অনেকগুলি কারন রয়েছে। মিডিয়া ভারত অধিকৃত কাশ্মির ও পাক অধিকৃত কাশ্মির বললেও প্রকৃত সত্য তা নয়। কাশ্মির এর সংঘাত এর ইতিহাস পরবর্তিতে বিস্তারিত আলোচনার ইচ্ছা থাকল। এই নিবন্ধে কাশ্মির এর ভূ-রাজনৈতিক অবস্থার সম্পর্কে কিছু জানানর চেষ্টা করা হলো।
বর্তমান ভারতের অধিকৃত কাশ্মির অঞ্চলটি ভারতিয় সংবিধান অনুসারে জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের একটি অঞ্চল। কাশ্মির এর ইতিহাস কিন্তু অনেক প্রাচিন। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমন এর সময় কাশ্মির এর পথ ব্যবহার করেছিলেন। পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মির এর কিছু অংশে এখনও আলেকজান্ডার এর সাথে আসা গ্রীকদের বংশোদ্ভুত কিছু জাতি আছে। ঐতিহাসিক ও ভেীগলিক ভাবে কাশ্মির অঞ্চল এর পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম দিকে পির-পঞ্জাল পর্বত শ্রেনি, উত্তর ও পূর্বে হিমালয় এবং উত্তর দিকে কারাকোরাম পর্বতমালা অবস্থিত। এই পর্বত শ্রেনিগুলির উপশ্রেনি গুলির মধ্যে অসংখ্য উপত্যকার সমন্বয় হচ্ছে এই কাশ্মির। এই এলাকার উপত্যকাগুলির পরিবেশ ও আবহাওয়া অত্যন্ত মনোরম হওয়ায় এই এলাকাকে ভুস্বর্গ বলা হয়।
মুসলিম পূর্ব আমলে কাশ্মির একাধিক হিন্দু রাজ্যে বিভক্ত ছিল। বর্তমান কাশ্মির উপত্যকা যা ভারত অধিকৃত কাশ্মির এর কাশ্মির বিভাগ বলে পরিচিত সেটাই ছিল মূল অঞ্চল। ১৩৩৯ খ্রিষ্টাব্দে কাশ্মির উপত্যকায় একটি মুসলিম সালতানাত প্রতিষ্ঠিত হয়। মোগল বাদশাহ আকবর এর সময় পর্যন্ত বিভিন্ন রাজবংশ এই অঞ্চল শাসন করে। আকবর এই অঞ্চল কে মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করে নেন। কাশ্মির এর মনোরম পরিবেশ পরবর্তি বাদশা জাহাঙ্গির এবং শাহজাহান কে বিশেষ ভাবে আকৃষ্ট করে এবং তারা এই এলাকার উন্নয়ন এ অনেক প্রকল্প নেন। এই সময় কাশ্মির মোগল বাদশাহদের গ্রিষ্মকালিন আবাস ছিল। মোগল সাম্রাজ্যের পতন এর যুগে কাশ্মিরে আবার একাধিক ছোট রাজ্যের জন্ম হয়। ১৮২০ সালে শিখ মহারাজা রণজিত সিং কাশ্মির এর দখল নেন এবং তাকে লাহোর ভিত্তিক পাঞ্জাব রাজ্যের অর্ন্তভুক্ত করে নেন। কিন্তু ১৮৪৬ সালে প্রথম ইংরেজ-শিখ যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর এই অঞ্চল ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে চলে যায়।
দুর্গম এই অঞ্চল নিয়ন্ত্রন করা কঠিন হবে বুঝতে পেরে কোম্পানি শিখ যুদ্ধে তাদের সহযোগি জম্মু অঞ্চল এর ডোগরা হিন্দু বংশোদ্ভুত রা গুলাব সিং এর কাছে সাড়ে সাত লক্ষ ( মিলিয়ন ও হতে পারে) স্বর্নমুদ্রার বিনিময়ে বিক্রি করে দেয়। একটা কথা অনেকেই জানেন না যে বর্তমান জম্মু অঞ্চল ঐতিহাসিক ভাবে কাশ্মির এর অংশ ছিলনা। জম্মু ও কাশ্মির এর মধ্যে ১৯৪৭ সালের আগে কোন ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ও ছিলনা। নয়হাজার ফুট উচ্চতা অবস্থিত গিরিপথ বানিহাল পাস ই ছিল জম্মু ও কাশ্মির এর মধ্যে যোগাযোগর প্রধান রাস্তা। অন্যদিকে মোগল আমলেই বর্তমান পাকিস্তান এর লাহোর ও পিন্ডি অঞ্চল থেকে কাশ্মির উপত্যকার সাথে ভাল যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল। মহারাজা গুলাব সিং কাশ্মির উপত্যকা কিনলেও উপত্যকার উত্তর দিকের চিত্রল-গিলগিট সহ কিছু অঞ্চলে কয়েকটি স্বাধিন মুসলিম শাসিত ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল। শিখ আমল থেকেই কাশ্মির অঞ্চলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম রা বিভ্ন্নি অত্যাচার এর শিকার হতে শুরু করে।
১৯৪৭ সালে যখন উপমহাদেশ স্বাধিন হয় তখন ভারত স্বাধিনতা আইন এর শর্ত অনুযায়ি কাশ্মির এর মহারাজা হরি সিং প্রথমে স্বাধিন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। কাশ্মির এর মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে নেতা শেখ আবদুল্লাহ ও এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন এবং নির্বাচিত গনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংসদ ও সরকার গঠিত হয়। কাশ্মির পাকিস্তান এর সাথে টেলিযোগাযোগ ও সমুদ্র বন্দর ব্যবহার এর বিষয়ে চুক্তি করে। কিন্তু কাশ্মির এর এই স্বাধিনতা ভারত মেনে নিতে পারেনি। হিন্দু মহাসভার প্ররোচনায় হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু অঞ্চলে শুরু হয় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এক পর্যায়ে এই দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে কাশ্মির অঞ্চলেও। এই দাঙ্গার জন্য ভারতিয়রা পাকিস্তান কে দোষারোপ শুরু করে। অন্যদিকে এই সময় নির্বাচিত সরকার এর উপর মহারাজার অযাচিত হস্তক্ষেপ ও গনতন্ত্র হরন এর চেষ্টার বিরুদ্ধে কাশ্মিরে শুরু হয় গন আন্দোলন। এই আন্দোলন কে বিদ্রোহ আখ্যা দিয়ে মহারাজা ভারতিয় সাহাজ্য চান এবং ভারতে যোগদেন।
কাশ্মির এর মহারাজা ভারতে যোগ দিলেও কাশ্মির এর উত্তর ও পশ্চিম এর বেশকিছু এলাকায় মুসলিম জনতা সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই প্রতিরোধে প্রধানত নেতৃত্ব দেন সাবেক বৃটিশ সেনাবাহিনির এই অঞ্চলের অধিবাসি মুসলিম অফিসার রা। যাদের মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য আযাদ হিন্দ ফেীজ এ সুভাস চন্দ্র বসুর সহযোগি কর্নেল হাবিবুর রহমান ও ক্যাপ্টেন বুরহানউদ্দিন। কাশ্মিরে ভারতিয় সৈন্য প্রবেশ এর সাথে সাথে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল কায়েদে আযম মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ সেখানে সামরিক হস্তক্ষেপ এর নির্দেশ দেন। কিন্তু পাকিস্থান সেনাবাহিনির তৎকালিন প্রধান ইংরেজ জেনারেল ফ্রান্ক মেজারভি এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে দেরি করেন। মাস খানেক পর পাকিস্তানি বাহিনি যুদ্ধে নামলেও তখন কাশ্মির উপত্যকা সহ বিরাট এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রনে। তখন থেকেই এই এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় লড়ছে আত্মনিয়ন্ত্রনঅধিকার এর জন্য।
কাশ্মির এর উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত গিলগিট-বালতিস্তান এলাকার ক্ষুদ্র মুসলিম শাসিত রাজ্যগুলি আগেই পাকিস্তানে যোগ দেয়। অন্য এলাকাগুলি পাকিস্তানি বাহিনি নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। বর্তমানের এই এলাকা বিশ্বের উচ্চতম যুদ্ধক্ষেত্র হিসাবে খ্যাত। এই অঞ্চল পাকিস্তানে নর্দান টেরিটরি হিসেবে শাসিত হয়।
বর্তমান ভারতিয় কাশ্মির এর পশ্চিম দিকে প্রায় পাঁচহাজার বর্গমাইল এলাকা যা ভেীগলিকভাবে কাশ্মির উপত্যকার অংশ সেখানে প্রতিষ্ঠিত রয়েছে আযাদ কাশ্মির নামে একটি স্বাধিন রাষ্ট্র। এই রাষ্ট্রের নিজস্ব সরকার রয়েছে। নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি ও পার্লামেন্ট আছে। আছে নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা। তবে এর কোন পররাষ্ট্র মন্ত্রনালয় বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নাই। এই দায়্ত্বি সম্পুর্ন পাকিস্তান এর। তবে আভ্যন্তরিন বিষয়ে এই অঞ্চল সম্পুর্ন স্বাধিন এবং এর সুপ্রিম কোর্ট এর সিদ্ধান্তই চুড়ান্ত। পাকিস্তান সরকার প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া আর কিছুতে আইনত কোন হস্তক্ষেপ করতে পারেনা।
ভারতিয় জম্মু ও কাশ্মির রাজ্যের সবচেয়ে বড় অংশটি হচ্ছে এর পূর্বদিকে অবস্থিত লাদাখ অঞ্চল। আকারে বিশাল হলেও এই অঞ্চল এর জনসংখ্যা অত্যন্ত কম। এখানে তিব্বতি ও লাদাখি বেীদ্ধ সম্প্রদায় সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং দ্বিতিয় সংখ্যাগরিষ্ঠ হলো মুসলিম সম্প্রদায়। এর একটি অংশ চিনের নিয়ন্ত্রনে আছে এবং একে আকসাই চিন বলা হয়।
কাশ্মির নিয়ে সংঘাত কে শুধু মাত্র পাক-ভারত সংঘাত হিসেবে দেখা ভুল। কাশ্মিরিরা মুলত স্বাধিনতার জন্য লড়ছে। পাকিস্তান এর সাথে সংযুক্ত হতে চাইলেও বর্তমান আযাদ কাশ্মির এর মত পুর্ন সায়ত্বশাসন নিয়েই সংযুক্ত হতে চায়। পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রনে থাকা আযাদ কাশ্মির অঞ্চল কে পাকিস্তান অধিকৃত অঞ্চল বলা যায় না। আর উত্তর দিকের অঞ্চল গুলি ভেীগলিক ভাবে কাশ্মির এর অংশ হলেও মহারাজার নিয়ন্ত্রনের সময়ও রাজনৈতিক ভাবে কাশ্মির এর অংশ ছিলনা। কাশ্মির সমস্যা উপমহাদেশের জন্য ক্যান্সার হয়ে আছে। এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রন এর অধিকার দেওয়া।
বিষয়: বিবিধ
৩৭৮৭ বার পঠিত, ১৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এটা তারা ইচ্ছে করেই করেছিল যাতে এটা নিয়ে ক্যাচাল হলে নাক গলাতে আসতে পারে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন