সিঙ্গুর থেকে গণ্ডামারা। মানুষের অধিকার।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ৩১ আগস্ট, ২০১৬, ১০:৩৯:১৭ রাত
সিঙ্গুর ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলির জেলার একটি অখ্যাত গ্রাম ছিল ২০০৬ সালের মে মাস পর্যন্ত। ১৮ই মে পশ্চিমবঙ্গের তৎকালিন মুখ্য মন্ত্রি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং টাটাগোষ্ঠির প্রধান রতন টাটা ঘোষনা করেন যে মাত্র এক লাখ রুপি দামের যে কার উৎপাদন এর পরিকল্পনা করেছে টাটা সেই কার এর কারখানা স্থাপিত হবে সিঙ্গুরে।এই কারখানার জন্য জমি লাগবে প্রায় ১০০০ একর। একই বছর সেপ্টেম্বর মাসে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার আইন জারি এই জমি অধিগ্রহন করে। অধিগ্রহন করা জমির বেশিরভাগই ফসলি ক্ষেত। এই এলাকার জমির উৎপাদনশিলতা ও ভাল। টাটা ন্যানো প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যায় টাটা গোষ্ঠি ও পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার।
কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয় যখন এই জমির মালিক কৃষকদের একটি বড় অংশ এই প্রকল্পের জন্য নিজের জমি দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। অনেকে জমি দিতে ইচ্ছুক হলেও ক্ষতি পুরন এর টাকার পরিমান নিয়ে আপত্তি করেন। কিন্তু সরকার কারো আপত্তিই গ্রহন করেনি। জোড় করে উচ্ছেদ করা হয় অনেক অনিচ্ছুক জমির মালিককে। এক পর্যায়ে এই আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালায়। আর তখনি সিঙ্গুর এর আন্দোলন চলে যায় রাজ্য পর্যায়ে।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রণ্ট সরকার এর তিরিশ বছর এর শাসন এর অবসান এর অন্যতম কারন হিসেবে দেখা হয় এই সিঙ্গুর নিয়ে বাড়াবাড়িকে। শিল্পায়ন এর নামে কোন সমীক্ষা বা স্থানিয় মানুষের মতামত এর তোয়াক্কা না করে পুলিশি ক্ষমতার জোড়ে এই জমি দখল করে টাটা কে হস্তান্তর করে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। টাটা তার কারখানার কাজ ও শুরু করে। কিন্তু সিঙ্গুর নিয়ে আন্দোলনে নেমে পড়েন তৎকালিন পশ্চিমবঙ্গের বিরোধি দলিয় নেত্রি মমতা বন্দোপাধ্যায়। এছাড়া পশ্চিমবঙ্গ এবং ভারতের অনেক বুদ্ধিজিবিও দাড়ান এই আন্দোলন এর পক্ষে। সম্প্রতি প্রয়াত সাহিত্যিক মহাশ্বেতা দেবি ছিলেন এদের অন্যতম। সাধারনভাবে কম্যুনিষ্ট পন্থি অনেক বুদ্ধিজিবিও এই বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। কিন্তু কারো মতামত কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। একের পর এক দাঙ্গা, মারামারি,গ্রেফতার ইত্যাদির কারনে ২০০৮ সালে টাটা গোষ্ঠি কারখানার কাজ বন্ধ করে দেয়। কিন্তু জমি ফেরত দেওয়া হয়নি।
সিঙ্গুর নিয়ে আন্দোলন এর কারনেই পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দোপাধ্যায় অভুতপুর্ব জনপ্রিয়তা অর্জন করে ২০১১ সালে ৩০ বছর এর বামফ্রন্ট সরকার এর বদলে ক্ষমতায় আসেন। তিনি ক্ষমতায় এসেই প্রথম বিধানসভা অধিবেসনেই এই জমি কৃষকদের ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু টাটা গোষ্ঠি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করে। কলকাতা হাইকোর্টে বিভক্ত রায়ের পর এই মামলা যায় ভারতের কেন্দ্রিয় সুপ্রিম কোর্টে। আজকে ৩১ এ আগষ্ট ২০১৬ এক রায়ে ভারতিয় সুপ্রিম কোর্ট সিঙ্গুর এর সেই জমি অধিগ্রহন কে বেআইনি ঘোষনা করেছে এবং জমির মালিক দের জমি ফেরত দেওয়ার জন্য আদেশ দিয়েছে।
ভারতিয় সুপ্রিম কোর্ট এই রায়ের বিশেষ কিছু পয়েন্ট হলো
* এই জমি জনস্বার্থে নয় একটি ব্যবসায়িক গোষ্ঠির স্বার্থে অধিগ্রহন করা হয়েছিল।
* জমির জন্য পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরন দেওয়া হয়নি। ক্ষতিপুরন এর জন্য জমির মালিকদের মতামত কে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
* একতরফা সরকারি সিদ্ধান্ত জনগন এর উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
ভারতিয় সুপ্রিম কোর্টের এই ঐতিহাসিক রায় টি একটি মাইলফলক হবে বলে ভারতিয় মিডিয়া বলছে।
বামফ্রন্ট সরকার এর অন্যতম কুখ্যাতি ছিল তারা পশ্চিমবঙ্গের শিল্প ধ্বংস করছে সিবিএ তথা শ্রমিক আন্দোলন কে অধিক সুবিধা দিয়ে। এই অভিযোগ থেকে রক্ষা পেতে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তার সরকার যে ন্যানো কারখানা স্থাপন করতে চেয়েছিলেন সেটা তাদের কে ক্ষমতা থেকেই শুধু উচ্ছেদ করেনি বর্তমানে তাদের অবস্থান তৃতিয় দল এ চলে গেছে।
সম্প্রতি আমাদের দেশের বাঁশখালির গন্ডামারা বলে একটি জায়গায় ও জমি অধিগ্রহন নিয়ে এই ধরনের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যে সেখানেও মৃত্যু হয়েছে একাধিক মানুষের। কিন্তু সেই প্রকল্পের বিষয়েও বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমবঙ্গের তৎকালিন সরকার এর ন্যায় আচরন করছেন। এই জমিগুলিও অত্যন্ত উৎপাদনশিল জমি। দুর্ভাগ্য বিরোধি দল সহ বুদ্ধিজিবি শ্রেনি এই বিষয়ে চুপ করে আছেন। বিশেষ করে মিডিয়া এবং তথাকথিত সুশিল সমাজের আচরন অত্যন্ত রহস্যময় এই নিয়ে।
আমাদের দেশের সরকারি কর্মকর্তারা বিশেষ করে এবং রাজনিতিবিদদের একটি বড় অংশ উন্নয়ন মানেই বুঝেন শহরায়ন। এই ভুল চিন্তার উপর ভিত্তি করে বিদ্যুত উৎপাদন বা বড় প্রোজেক্ট স্থাপন কে আমরা যে গুরুত্ত দিচ্ছি ততটা গুরুত্ব দিচ্ছিনা পরিবেশ রক্ষা কে এবং কৃষি উৎপাদনশিলতাকে। ধ্বংস করে যাচ্ছি বনাঞ্চল এবং ফসলের মাঠ কে।
সাম্রাজ্যবাদি আচরন এবং সাম্প্রদায়িকতা সত্বেয় ভারতের গত ৬৯ বছর এর নিরবিচ্ছিন্ন গনতন্ত্রের চর্চা সিঙ্গুর এর বাসিন্দাদের এই বিজয় দিয়েছে। ভারতিয় মিডিয়া ও টাটা গোষ্ঠির মত একটি প্রধান বিজ্ঞাপন দাতা গোষ্ঠির উপস্থিতি সত্বেয় এই বিষয়ে প্রসংশনিয় নিরপেক্ষতা দেখিয়েছে প্রথম থেকেই।
সিঙ্গুর এর এই আন্দোলন এর সময় নিহত হয়েছিলেন তাপসি মালিক। আজকে তার এই আত্মদান এর ফল পেল সিঙ্গুরবাসি।
সিঙ্গুর এর বিপ্লবি জনগন কে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
বিষয়: বিবিধ
১৮১১ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আইন এবং তার প্রয়োগ যদি যথাযথভাবে কার্যকর থাকে তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান এমনিতেই হয় । আমাদের দেশে আইন আছে, ব্যবহার নেই।
শুকরিয়া।
অাইন থেকেও বড় মানুষের অধিকার। এই বিষয়টিকেই এই রায় এ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
কেমন আছেন ভাইয়া ?
আলহামদুলিল্লাহ এখন আরো ভাল আছি।
৬৯ বছরের নিরবচ্ছিন্ন ত্যাগ! ভাবতেই চেতনায় তোলপাড় উঠে!!
সকল সমস্যা সত্বেয় ভারত এই জন্যই এখনও এক আছে।
গনতন্ত্রের অভাব আমাদের পরাজয় এর প্রধান কারন।
মন্তব্য করতে লগইন করুন