শ্রাবণ দিনে এক আলোক সাগর ভ্রমন।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১২ জুলাই, ২০১৬, ০৯:০২:৪৭ রাত
পর্তুগাল-ফ্রান্স এর ইউরো ফাইনাল শেষ হতে ফজর এর সময় হয়ে গেল। তাই আর না ঘুমিয়ে নামাজ পড়েই প্রস্তুত হয়ে নিলাম। ইউরোপিয় ষ্টাইলে সিদ্ধ ডিম,টোষ্ট পাউরুটি আর কফি দিয়ে ব্রেকফাষ্ট সমাপ্ত করে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বৃষ্টি ধোয়া নির্জন রাজপথে। একে এত ভোর তার উপর মাত্র ঈদের পর। অন্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি নির্জন। অনেক কষ্টে একটা রিক্সা নিয়ে প্রথমে নিউমার্কেট। সেখান থেকে রাহাত্তারপুল এর বাস কাউন্টার। সহযাত্রি এবং মেজবান রায়হান ভাই এর সাথে মিস ইনফরমেশন হয়ে একটু বেশি হাঁটাহাঁটি করতে হল! তবু শেষ পর্যন্ত আল্লাহর রহমতে বাসে করে রওনা দিলাম। বর্ষায় টইটুম্বর কর্নফুলির রুপ দেখতে দেখতে হারিয়ে গেল যান্ত্রিক চট্টগ্রাম শহর। দুই দিকে সবুজ প্রকৃতির মাঝে ছুটে চলল বাস।
আমাদের গন্তব্য কক্সবাজার এর একটি প্রত্যন্ত অঞ্চল পেকুয়ার টইটং ইউনিয়ন। চট্টগ্রাম জেলার শেষ প্রান্তে বাঁশখালি উপজেলার সিমান্তের প্রেমবাজার এ নামলাম বাস থেকে। সেখান থেকে ট্যাক্সি করে সরু গ্রামীণ পথে। একটু পরেই বামপাশে দেখা দিল রাজাখালি খাল। ভরা বর্ষায় এর রুপ দেখে কেউ মোহিত না হলে বুঝতে হবে সেই মানুষটির হৃদয় বলে কিছু নেই! রাজাখালি খালের বিশুদ্ধ বাতাস উপভোগ করতে করতে পেীছে গেলাম গন্তব্য স্থল পশ্চিম টইটং রহমানিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায়। তবে রাস্তা থেকে মাদ্রাসায় পেীছাতে পার হতে হল এক দুর্লঙ্ঘ্য বাধা। প্রায় ১০০ মিটার কাদা! তবে পিছিয়ে পরার মত কাপুরুষ তো নই। সু,মোজা খুলে হাতে নিলাম। এক হাতে জুতাজোড়া আর আরেক হাতে ব্যাগ নিয়ে সার্কাস এর ট্র্যাপিজ ষ্টাইলে ব্যালান্স করে করে কোন রকম আছাড় খাওয়া ছাড়াই পেীছে গেলাম মাটির লেপা মেঝে, বাঁশের বেড়া দেওয়া জ্ঞানের আলোকে ভরা ঘরটিতে।
কক্সবাজার এর পেকুয়া উপজেলার প্রত্যন্ত এই অঞ্চলটি শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে ছিল দির্ঘদিন। একে তো দুর্গম সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক কারনে এই এলাকা অনেক পিছিয়ে। অধিবাসিদের মধ্যে যাদের সামর্থ আছে তারা নিকটবর্তি চকরিয়া বা বাঁশখালি তেই সন্তানদের শিক্ষার জন্য প্রেরন করেন। সরকারি বা বেসরকারি কোন উদ্যোগেই এখানে শিক্ষা বিস্তার হয়নি । এখানের অধিবাসিরা প্রধানত লবন শ্রমিক বা চাষবাস করেন। প্রত্যন্ত এই জনপদে শিক্ষার আলো ছড়াতে মাত্র পাঁচ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই মাদ্রাসা। প্রধান উদ্যোক্তা সহযাত্রি রায়হান ভাই যিনি নিজেও একজন অধ্যাপক। নিজের জমির সাথে কিছু জমি কিনে তার প্রতিষ্ঠিত মাটির মেঝের এই মাদ্রাসায় এখন ছাত্রছাত্রির সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে শতক এর ঘর। আশেপাশের কয়েক মাইল এলাকার মধ্যে এটাই একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
একসাথে সালাম জানানর মাধ্যমে একদল শিশু আমাদের আমন্ত্রন করল মাদ্রাসায়। নিষ্পাপ মুখের এই শিশুদের গায়ে দামি জামা নেই। হাতে নেই আইপ্যাড,আইফোন। কিন্তু এদের চোখে আছে ভবিষ্যত এর সপ্ন। আছে আগ্রহ জ্ঞান অর্জন এর। মাটির মেঝে, বাঁশের বেড়া আর ফাটা টিনের চালের নিচে বসেই এরা নিজেদের উদ্ভাসিত করছে জ্ঞানের আলোয়। এই এলাকায় বিদ্যুত নেই। নেই আরো অনেক সুযোগ সুবিধা। তার মাঝেও তারা আছে সুখি। যদিও সেদিন মাদ্রাসা বন্ধ তবে এই শিশুরা এসেছে ঈদ পুর্নমিলনি অনুষ্ঠান এ। ক্লাসে ক্লাসে বসা শিশুদের ঘুরে দেখলাম। রায়হান ভাই যখন ল্যাপটপে তাদের শুনালেন পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত তারা অাগ্রহ নিয়ে দেখল তা।
ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মধ্যেই আবারও কাদার সাগর(!) ভেঙ্গে রওয়ানা দিলাম রায়হান ভাই এর বাড়ির উদ্যেশ্যে। এতক্ষন বাস জার্নিতে ভালই ক্ষিদে পেয়েছিল। সুস্বাদু নুডলস আর সেমাই এর সাথে ডিপ টিউব ওয়েল এর ঠান্ডা পানি প্রান জুড়িয়ে দিল। কাদা মাখা খালি পায়েই এলাকাটা ঘুড়ে দেখলাম। বিরাট এক পুকুর এর পারে ঝিড়ি বৃষ্টিতে সবুজ প্রকৃতিতে চলছে অনেক রংয়ের খেলা। কিছুক্ষন পর ফিরে এলাম আবার মাদ্রাসায়। মাটির বারান্দার একপাশে তখন রান্না হচ্ছে। রান্না করছেন মাদ্রাসারই শিক্ষকবৃন্দ স্থানিয় সহায়তায়। মাদ্রাসার সামনের ছোট্ট পুকুরটিতে ওজু সেরে জোহর নামাজ আদায় করলাম মাদ্রাসার মাটির বারান্দাতেই।
নামাজ শেষে মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রিরা তাদের কচি কন্ঠে পরিবেশন করল ক্বিরাত ও ইসলামি সংগিত। উপস্থিত ছিলেন অনেক অভিভাবক ও। এর মধ্যেই রান্না শেষ হয়ে এল। শৃঙ্খলা বদ্ধ হয়ে খেতে বসলা শিক্ষার্থিরা। পরম তৃপ্তির সাথে তাদের খাওয়া দেখলে নিজের মন ই ভাল হয়ে উঠে। অনেক অভাবের মধ্যেও তাদের মধ্যে আছে আল্লাহর উপর নির্ভরতা এবং পরিতৃপ্তি। শিক্ষার্থিদের খাওয়ার পর আমরা খেতে বসলাম। মাদ্রাসার একজন শুভানুধ্যায়ি মাসুম ভাই একটা ছাগল এর ব্যবস্থা করেছেন। সেই ছাগলের গোস্ত রান্না হয়েছে আলু সহযোগে। তার সাথে মুগডাল আর মুরগী। দেশি শশার সালাদ সহযোগে একটু বেশিই খেয়ে ফেললাম! বিশেষ করে মুগডালটা খুবই মজা হয়েছিল। শিক্ষার্থি. অভিভাবক অতিথি সহ প্রায় দেড়শ এর অধিক মানুষ পরিতৃপ্তির সাথে খেয়েছেন এইদিন।
মাদ্রাসার মাটির বারান্দায় বসে কচি-কাঁচারা।
পরম তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে শিশুরা পরিবেশন করছেন প্রতিষ্ঠাতা রায়হান ভাই সহ অন্যান্যরা।
খাওয়া অন্তে একটু বিশ্রাম নিয়ে ফিরতি পথে চললাম। এবার রাজাখালি খালের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে পড়ন্ত বিকালের আলোয় উপভোগ করলাম এর সৌন্দর্য। বৃষ্টি ভেজা প্রকৃতিতে ফুরফুরে বাতাসে সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার যোগ্যতা আমার নেই। একসময় খাল পার থেকে সরে গেলাম। গ্রামীণ পথ দিয়ে পেীছলাম টইটং বাজারে। বাসে উঠে রওনা দিলাম যান্ত্রিক সভ্যতার শহর এর দিকে। হৃদয়ে শুধু রয়ে গেল শ্রাবণ দিনের গ্রামবাংলার রুপ আর এক প্রত্যন্ত গ্রামের শিশুদের মাঝে আলোক বিতরন করতে থাকা মাদ্রাসাটি।
[img]
মাদ্রাসা লাইব্রেরির বইএর আলমিরার সামনে লেখক।
বিষয়: বিবিধ
১৮৬৮ বার পঠিত, ২৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মুগের ডাল টা যা মজা হয়েছিল না!! অাপনি হলে মনে হয় ডেক্সি খালি হয়ে যেত।অসুখের পর থেকে তো ভাই খাওয়াদাওয়া খুব কম!! অনেক দিন পর একটু খাইলাম।
সম্ভব হলে এই মাদ্রাসার জন্য কিছু সাহাজ্য প্রয়োজন।
অন্নেক হৃদয়স্পর্শী লিখা। ছবিগুলো অতুলনীয়। জান্নাতি পাখীদের দেখে ভীষণ ভালো লাগলো।
সবকিছু মিলে অনবদ্য।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য। এই সুন্দর পরিবেশ দেখে আসলেই মনটা অনেক ভাল হয়ে যায়। জিবনের সব যন্ত্রনা ভুলে যাই।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
-যদি যাত্রায় আমিও থাকতে পারতাম
-এসব শিশুদের খাবার সাথে যদি আমিও থাকতাম
-প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে দেখার আমারও শখ ছিল, বহু মুসিবতেও পড়েছি, তাই মানস পটে ছবি এঁকেছি।
ফাইনালী আমার দাদার সেই ঐতিহাসিক সংগ্রহ! সে সর্ম্পকে না বললেই নয়। তাঁর সেই সংগ্রহ শালা, যা আপনাকে বিজ্ঞ ও বিদ্বান করেছে। শহুরে জীবনে এক টুকরা স্থানের বড়ই অভাব। তারপরও সেসব আকড়ে রেখেছেন দেখে ভালই লাগল। দেশে আসলে অবশ্যই তা দেখতে আসব। ভাল থাকুন।
-যদি যাত্রায় আমিও থাকতে পারতাম
-এসব শিশুদের খাবার পরিবেশনের সময় যদি আমিও থাকতাম
-প্রত্যন্ত গ্রাম ঘুরে দেখার আমারও শখ ছিল, বহু মুসিবতেও পড়েছি, তাই মানস পটে ছবি এঁকেছি।
ফাইনালী আপনার দাদার সেই ঐতিহাসিক সংগ্রহ! সে সর্ম্পকে না বললেই নয়। তাঁর সেই সংগ্রহ শালা, যা আপনাকে বিজ্ঞ ও বিদ্বান করেছে। শহুরে জীবনে এক টুকরা স্থানের বড়ই অভাব। তারপরও সেসব আকড়ে রেখেছেন দেখে ভালই লাগল। দেশে আসলে অবশ্যই তা দেখতে আসব। ভাল থাকুন।
তবে একটা প্রতিষ্ঠান থেকে সব রকম লোকই বের হতে পারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই কিন্তু সৈয়দ আলি আহসান,সৈয়দ আলি আশরাফ, অধ্যাপক গোলাম আযম রা বের হয়েছেন। আবার এখান থেকেই লেখাপড়া করেছেন অতি অত্যাচারি মানুষ রাও!!
রায়হান ভাইয়ের বাড়িতে গেলেন না!
শুধু মাদরাসা থেকেই বিদায়!
ভালো লাগলো, অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আবার পড়েন!
মন্তব্য করতে লগইন করুন