পোট্রেট অফ এ লেডি। আমার নানি।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০২ মার্চ, ২০১৬, ১২:১২:৫৬ রাত
কিছু মৃত্যুর জন্য মন আগে থেকেই প্রস্তত থাকে। বিশেষ করে সেই মানুষগুলির জন্য যারা ইতঃমধ্যে অতিক্রম করে গেছেন মানুষের গড় আয়ুর সিমানা। তবুও হৃদয় এ বিচ্ছেদ এর বেদনা ঠিকই বেজে যায়। এমনই এক মৃত্যু প্রত্যক্ষ করতে হলো আজকে। আমার নানি নব্বই এর অধিক বয়সে দুনিয়ার জিবনে তার সফর শেষ করলেন আজকে সকাল দশটার দিকে। তার ইন্তেকাল এর সাথে দুইটি শতাব্দির সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সেই শিশুকাল থেকে তার মুখে ই শুনতাম চট্টগ্রাম এর বীর নাবিক দের দুঃসাহসিক সমুদ্র অভিযান এর গল্প। যে নাবিকদের তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। ধনাঢ্য ব্যবসায়ির স্ত্রী হয়েও জিবন কাটিয়ে গেছেন সাধারন ভাবে।
বিগত শতাব্দির তৃতিয় দশকে জন্ম তার। পিতা সৈয়দ আহমদ এর প্রথমা কন্যা তিনি। বর্তমান চট্টগ্রাম নগরীর উপকন্ঠে বসবাস কারি নাবিক পিতা তার নাম রাখেন জারিয়া বেগম। কিছুদিন লেখাপড়া করার ও সুযোগ পান তিনি এবং সেসসময় প্রাইমারি স্কুল এ শিক্ষকতাও করেন। সময় এর বিচারে যা কোন অভিজাত বংশের মুসলিম নারির জন্য অভাবনিয় ছিল। তার বিয়ে হয় চট্টগ্রাম এর বিখ্যাত ব্যবসায়ি দোভাষ পরিবার এর প্রধান খান বাহাদুর আবদুল হক দোভাষ এর একমাত্র পুত্র নবী দোভাষ এর সাথে। ধনি এবং অভিজাত এই পরিবারে বধু হয়ে তিনি জিবন অতিবাহিত করেন। কিন্তু বিয়ের অল্প কয়েকবৎসর পরেই ১৯৫৪ সালে তার স্বামি ইন্তেকাল করেন। দির্ঘ ষাট বছর এর ও বেশি সময় স্বামি হারা কিন্তু পুত্র-কন্যা, নাতি-নাতনি এমন কি প্র-প্রপেীত্র কে দেখার সেীভাগ্য লাভ করেছেন তিনি।
অল্প বয়সে তিনি যখন বিধবা হন তার নিজের সন্তান রা তো বটেই তার স্বামির পূর্ব বিয়ের সন্তান রাও প্রায় নাবালক। কিন্তু এই মহিয়সি নারি সকল কে মানুষ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যার মধ্যে একজন পরবর্তিতে জাতিয় রাজনিতি এবং স্বাধিনতা যুদ্ধে বিশেষ অবদান রাখেন এবং সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। দির্ঘ এই জিবনে তাকে সহ্য করতে হয়েছে একাধিক সন্তান ও জামাতা-ছেলের বউ এর মৃত্য। কিন্তু সর্বাবস্থায় আল্লাহর স্মরন থেকে বিচ্যুত্ হননি তিনি।
তার ইন্তেকালে হারিয়ে গেলে একটি শতাব্দির প্রতিনিধিত্ব। তার মুখে শুনতাম ১৯৪০ এর দশক এর উত্তাল সময়গুলির কথা। দ্বিতিয় মহাযুদ্ধের হুমকির মুখে এই দেশ আর সেই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ইতিহাস। পাকিস্তান আন্দোলন এর কথা যে আন্দোলন এর সাথে সরাসরি জড়িত ছিলেন তার স্বামি ও শশুড়। তার শশুড় যিনি একসময় অবিভক্ত বাংলা কংগ্রেস এর কোষাধ্যক্ষ ও পরে মুসলিম লিগ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি ছিলেন তার এর বন্ধু ও সহকর্মি কংগ্রেস নেতা দেশপ্রিয় জে এম সেন সহ সেই সময় এর প্রখ্যাত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কে প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতার কথা। শুধু পারিবারিক ইতিহাস নয়। এই কথা গুলি থেকেই আমাদের সামনে উন্মোচিত হতো এক বিরাট ট্রানজিশন যুগের ইতিহাস। যেখানে একই সাথে রাজনৈতিক,সামাজিক এবং প্রযুক্তি পরিবর্তিত হচ্ছে। তার নাবিক পিতার মুখে শোনা গত শতাব্দির লন্ডন সহ ইউরোপের বিবরনগুলি পৃথিবির ইতিহাস কেও ছুয়ে যেত। কুপির আলো আর মানুষের মুখের সংবাদ থেকে শুরু করে যিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন ইন্টারনেট এর মাধ্যমে বিদেশে অবস্থান করা আত্মিয়র সাথে ভিডিও চ্যাট।
ধর্মভিরু এই মহিলা ১৯৭১,১৯৮৮ ও ২০০৮ সালে তিনবার হজ্জ করার সেীভাগ্য অর্জন করেন। পাঁচওয়াক্ত নামাজে ছিলেন নিয়মিত। প্রতিদিনই কুরআন পড়তেন। ইন্তেকাল এর মাস তিনেক আগে ছাড়া সারা জিবন নিজের হাতেই রান্না করে খেতেন। অসংখ্য আঘাত সহ্য করেও পরিবারের সবার কাছে ছিলেন অন্তহিন স্নেহ আর আনন্দের উৎস।
তার ইন্তেকাল একটি শতাব্দির শেষ চিন্হটি মুছে দিল। আল্লাহতায়লা তাকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাত নসিব করুন।
বিষয়: বিবিধ
১৫৫৬ বার পঠিত, ৩৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আল্লাহ তায়ালা উনার যাবতীয় গুনাহ খাতা মাফ করে দিন, সমস্ত নেক আমল গুলো কবুল করে নিন। উনার সন্তানদের সাদাকায়ে জারিয়া হিসেবে গ্রহণ করুন।উনার পরিবার পরিজনদের সবর করার তৌফিক দান করুন। উনাকে জান্নাতবাসী করুন! আমীন।
ওনার মুখ থেকে ইতিহাসের যেসব সত্য ঘটনা শুনেছেন, সেগুলো আমাদেরকেও বিস্তারিত জানাবেন আশা করি।
তিনি ছিলেন মরহুম জানে আলম দোভাষ। উনি ৭০ ও ৭৩ সালে সংসদ সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি চট্টগ্রাম আওয়ামি লিগ এর কোষাধ্যক্ষ ছিলেন। কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য ছিলেন আজিবন। ১৯৭১ সালে বন্দর এর মাল উঠানামার ঠিকাদারি বা ষ্টিভিডর হিসেবে তার যে পারিবারিক ব্যবসা ছিল তার সুযোগে সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস না করার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।
انا لله و انا اليه راجعون
اسئل الله العظيم ان يرحمهاويدخلها الجنة النعيم
আপনাদেরকেও ছবরে জামীলের তাওফীক দান করুক। উনার আওলাদদের থেকে সাদাকায়ে জারিয়া জারি থাকুক।
জানতে ইচ্ছুক...............
ধন্যবাদ আপনাকে। উপরে ওহিদুল ইসলাম ভাই এর মন্তব্যের জবাবে লিখেছি আপনি যা জানতে চেয়েছেন।
আল্লাহ উনাকে জান্নাতুল ফেরদাউস নসীব করুন। আমিন আমিন আমিন
انا لله و انا اليه راجعون
আল্লাহ উনাকে জান্না নসিব করুন
নানি দাদির কাছ থেকে শুনা গল্প গুলো আমার কাছে রুপ কথার মত মনে হত
মন্তব্য করতে লগইন করুন