জেনারেল জ্যাকব এবং আমাদের মিডিয়া!
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৫ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:২৫:৫০ রাত
গত ১৩ ই জানুয়ারি মৃত্যুবরন করেছেন ১৯৭১ সালে ভারতিয় ইষ্টার্ন কমান্ড এর চিফ অফ ষ্টাফ লেফটেনান্ট জেনারেল জ্যাক ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই তার অবদান আছে কিন্তু বাংলাদেশের মিডিয়াগুলিতে তার সম্পর্কে যে মন্তব্য করা হচ্ছে যে তিনিই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সহায়তাকারি সেটা শুধু সত্যের অপালাপ। বিষয়টি ব্যাখ্যার আগে সংক্ষেপে তার জিবনি আলোচনা করছি।
লেফটেনান্ট জেনারেল জ্যাক ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব ১৯২৩ সালে কলকাতায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি কলকাতায় বসবাস কারী একটি ধনি ”বাগদাদি ইহুদি” পরিবারের সন্তান। কলকাতা ও দার্জিলিং এ শিক্ষাগ্রহন করেন তিনি। ১৯৪২ সালে তিনি জায়নবাদি মানসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এবং জার্মানিতে হিটলার কতৃক ইহুদি নিধনে প্রতিশোধ নেয়ার উদ্দেশ্যে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন এবং দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধে যোগদেন। এই যুদ্ধে তাকে প্রথমে ইরাকে এবং পরে বার্মায় মোতায়েন করা হয়। রামরি দ্বিপে একটি যুদ্ধে আহত হন এবং বিশ্বযুদ্ধে বড় কোন লড়াই এ তিনি যোগ দিতে পারেননি। ভারত স্বাধিন হওয়ার পর তিনি ভারতিয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন।১৯৬২ সালে চিন-ভারত যুুদ্ধে তিনি যোগ দেননি। যদিও তিনি এই জন্য সেসময় এর লেঃজেঃ বিএম কাউল কে দায়ি করেন। ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় তিনি ভারতের দেওলালি তে আর্টিলারি স্কুল এর অধিনায়ক ছিলেন এবং কোন ব্রিগেড অধিনায়ক এর দায়িত্ব পাননি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর পাকিস্তান সিমান্তের একটি ব্রিগেড এর দায়িত্ব নেন। অর্থাত কোন যুদ্ধেই তিনি সরাসরি অংশ নেননি। ১৯৭১ সালে তিনি মেজর জেনারেল পদ মর্যাদায় ইষ্টার্ন কমান্ড এর চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি যুদ্ধের পর তিনি লেফটেনান্ট জেনারেল পদে উন্নিত হন এবং প্রথম কাশ্মিরে কোর কমান্ডার এবং পরে ইষ্টার্ন কমান্ডের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্বপালন করেন। তার কোর্সমেট জেনারেল টিএন রায়নার পর তারই ভারতিয় সেনাবাহিনীর প্রধান হওয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু ভারতে কংগ্রেস সরকারের পতন ও মোরারজি দেশাই এর নেতৃত্বে জনতা দল সরকার গঠন করলে তার আখাঙ্খা পুর্ন হয়নি। কংগ্রেস সরকারও আরব বিশ্বের সাথে সুসম্পর্ক রক্ষার স্বার্থে তাকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেনি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে অংশগ্রহন কারী সকল ভারতিয় সিনিয়র অফিসারদের মধ্যে তিনিই প্রথম তার অভিজ্ঞতা নিয়ে গ্রন্থ রচনা করেন ”সারেণ্ডার এট ঢাকা,বার্থ অফ এ নেশন" নামে। কিন্তু এই বই টির জন্য তিনি যথেষ্ট বিতর্কিত হন। এই বইটিতে তিনি দাবি করেন যে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মুল পরিকল্পনা ও পরিচালনাকারী তিনিই এবং এক্ষেত্রে জেনারেল অরোরার কোন অবদানই ছিলনা। স্যাম মানেকশকেও তিনি ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য অভিযুক্ত করেন। জেনারেল ওসমানির প্রতি কটুক্তি করেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাফল্যকে খাটো করে দেখান।
তার এই বক্তব্য অনেক বিতর্কের সৃষ্টি করে। ভারতিয় সাংবাদিক সুমিত ওয়ালিয়া এক প্রবন্ধে তার এই বক্তব্যের ত্রিব্র্ সমালোচনা করেন। তিনি ১৯৭১ সালে যে পদে নিয়োজিত ছিলেন অর্থাত ইষ্টার্ন কমান্ড এর চিফ অফ ষ্টাফ সামরিক বিধি অনুযায়ি এই পদের অধিকারির দায়িত্ব সকল ষ্টাফ অফিসার এর কার্যক্রম এর তত্বাবধান ও প্রশাসনিক কাজগুলি করা। যাতে করে অভিযান ও যুদ্ধ সংক্রান্ত বিষয়ে কমান্ড এর অধিনায়ক সম্পুর্ন মনযোগ দিতে পারেন। কিন্তু জ্যাকব দাবি করেন যে তিনিই ১৯৭১ সালের যুদ্ধের সম্পুর্ন পরিকল্পনা ও পরিচালনা করেন। ইষ্টার্ন কমান্ড এর অধিনায়ক লেঃজেঃ জগজিত সিং অরোরা বা ভারতিয় সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল স্যাম মানেকশর কোন অবদান নাই!
জেনারেল জ্যাকব ই পরবর্তিতে ভারতিয় সরকার ও মিডিয়ার বিশেষ আনুকুল্য পান এবং পরবর্তিতে ভারতিয় জনতা পার্টি বা বিজেপির অন্যতম নেতা হন। জ্যাকব বিজেপির নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা বিষয়ক উপদেষ্টা ছিলেন এবং বাজপেয়ি সরকারের সময় গোয়া ও পাঞ্জাবের গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ইহুদি বাদি জেনারেল জ্যাকব ভারত ইসরাইল সম্পর্কের একজন প্রধান প্রতিষ্ঠাতা। তিনি অসংখ্যবার ইসরাইল ভ্রমন করছেন রাস্ট্রিয় অতিথি হিসেবে এবং ইন্দো-ইসরাইল ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির একজন প্রধান উদ্যোক্তা তিনি। জেনারেল জ্যাকব ভারতে ইসরাইলি সমরাস্ত্র ব্যবসাতে অন্যতম প্রধান এজেন্ট। ইহুদি হিসেবে তিনি ইসরাইলের একজন সন্মানিত নাগরিক তবে ভারতিয় আইনে দ্বৈত নাগরিত্ব অনুমোদিত না হওয়ায়া তার সেই পরিচিতি প্রকাশ করেননা।
কিছুদিন আগে তার পুর্নাঙ্গ আত্মজিবনি "অ্যান ওডিসি ইন ওয়ার এন্ড পিস" প্রকাশিত হলে আবারও বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এখানে তিনি সাবেক ভারতিয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রি ভিকে মেনন সহ অনেক উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার সম্পর্কে কটুক্তি করেন।
আজিবন ইহুদিবাদি এই ব্যাক্তি সবসময়ই বাংলাদেশ কে দেখতেন নিন্ম চোখে। কিন্তু তাকে বাংলাদেশ সরকার সর্বোচ্চ সন্মান প্রদান করেছে। কিন্তু তার দাবি যে অনেকাংশেই অসাড় ও মিথ্যা সেটা ভারতিয় সাংবাদিক ও তার সহকর্মিরাও বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবশ্যই তার অবদান আছে কিন্তু বর্তমানে যেভাবে প্রচার করা হচ্ছে সেটা সম্পুর্ন মিথ্যা।
বিষয়: বিবিধ
১৫২৯ বার পঠিত, ১৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যবহুল লিখাটির জন্য জাজাকাল্লাহু খাইর।
সবসময় ভালো থাকুন সুস্থ থাকুন অনেক দোয়া রইলো।
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ আপনাকে সুন্দর লিখাটার জন্য।
আমাদের মিডিয়া কিছুই না যেনে শুধুই লাফায়!! ভারতিয় মিডিয়াতেও মৃত্যু সংবাদ ছাড়া তাকে নিয়ে কোন আলোচনা দেখিনি।
মূল বিষয়টা জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন