স্বামি বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণ মিশন
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১২ জানুয়ারি, ২০১৬, ১১:১৬:৪৯ রাত
১২ ই জানুয়ারি ১৮৬৩ সালে কলকাতার প্রতিষ্ঠিত আইনজিবি বিশ্বনাথ দত্ত ও তার স্ত্রী ভুবনেশ্বরির প্রথম পুত্র নরেন্দ্রনাথ দত্ত জন্ম নেন। মেধাবি নরেন্দ্রনাথ দত্ত বিদ্যাসাগর এর প্রতিষ্ঠিত মেট্রোপলিটন স্কুল এ শিক্ষা লাভ করেন এবং একমাত্র প্রথম বিভাগে উত্তির্ন ছাত্র হিসেবে ১৮৭৭ সালে এন্ট্রান্স পরিক্ষায় উত্তির্ন হন। প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়ার সময় নরেন দত্ত ব্রাম্ম সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর এর পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন। এই সময় বিবেকানন্দ সমসাময়িক পাশ্চাত্য দর্শন বিষয়ে ও প্রচুর লেখাপড়া করেন এবং একাধিক বই অনুবাদ ও করেন। তিনি ব্রাম্ম ধর্ম গ্রহন করেন। তিনি ভাল গায়ক ও ছিলেন। একই সময়ে তিনি কিছূদিন ফ্রি ম্যাসন লজ কোলকাতার ও সদস্য হয়েছিলেন।
১৮৮১ সালে তার সাথে তার ভবিষ্যত গুরু তৎকালিন দক্ষিনেশ্বর কালিমন্দির ও মঠ এর পূজারি শ্রি রাম কৃষ্ণ বা রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব এর সাথে তার পরিচয় হয়। শ্রিরামকৃষ্ণ ছিলেন সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারি এবং কালিপূজারি। ব্রাম্ম এবং কিছুটা নাস্তিক চিন্তায় আচ্ছন্ন বিবেকানন্দর উপর শ্রিরামকৃষ্ণ যথেষ্ঠ প্রভাব বিস্তার করেন। নরেন্দ্রনাথ শ্রিরামকৃষ্ণর কথা বার্তায় তিনি বিশেষ আকৃষ্ট হন। এক পর্যায়ে তিনি শ্রিরামকৃষ্ণর প্রধান শিষ্য হয়ে যান। সাধারন ধর্ম বিশ্বাস বিরোধি চিন্তার কারনে শ্রিরামকৃষ্ণ দক্ষিনেশ্বর মন্দির থেকে বিতারিত হন। নরেন্দ্রনাথ এই সময় বি.এ পাশ করে চাকরির চেষ্টায় ছিলেন। শ্রিরামকৃষ্ণ অসুস্থ হয়ে পড়লে নরেন্দ্রনাথ সহ তার বন্ধু কয়েকজন কলকাতার উপকন্ঠে কাশিপুর এলাকায় শ্রিরামকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত হন।ক্যান্সার এ আক্রান্ত হয়ে ১৮৮৫ সালে শ্রিরামকৃষ্ণের মৃত্যু হয়।
শ্রিরামকৃষ্ণের মৃত্যুর পর নরেন্দ্রনাথ সহ তার কয়েকজন শিষ্য বরানগর এলাকায় একটি ভাঙ্গা বাগানবাড়িতে আশ্রয় নেন। ১৮৮৭ সালে সেখানেই নরেন্দ্রনাথ সহ তার কয়েকজন সাথি আনুষ্ঠানিক ভাবে হিন্দু ধর্মিয় নিয়মে বিরজা হোম এর মাধ্যমে সন্যাস গ্রহন করেন। নরেন্দ্রনাথ এর নতুন সন্যাসি নামকরন হয় বিবেকানন্দ। সন্যাসি জিবনযাপন এর এক পর্যায়ে বিবেকানন্দ তির্থ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েন। একজন মাত্র ২৫ বছর বয়সি গ্র্যাজুয়েট যার ভাল ছাত্র হিসেবে খ্যাতি ছিল তার সন্যাসি বেশ দেখে অনেকেই আকৃষ্ট হতেন। এই সময় ভারতবর্ষের বেশ কয়েকজন দেশিয় রাজার সাথে তার পরিচয় হয়। শিক্ষিত এই সন্যাসির প্রতি তারা বিশেষ আকর্ষন বোধ করতেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রাজস্থান এর খেতরির রাজা অজিত সিং। বিবেকানন্দের প্রায় সমবয়সি অজিত সিং এর সাথে বন্ধুত্ব হয় ও তাকে গুরু হিসেব বরন করেন। পরবর্তিতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অজিত সিং তাকে এবং তার সহকর্মিদের বিশেষভাবে সহায়তা করেন। অজিত সিং ও অন্যান্য কয়েকজন এর পৃষ্টপোষকতায় বিবেকানন্দ ১৮৯৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত বিশ্বধর্ম সম্মেলন এ যোগ দেওয়ার সুযোগ পান। এই সম্মেলনে গেরুয়া পরিহিত অবস্থায় তার আকর্ষনিয় ভাষন বিশেষ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন সংস্থার আমন্ত্রনে বক্তৃতা করার সুযাগ পান। এই সময় তিনি তার বেদান্তবাদ এর দর্শন প্রকাশ ও প্রচার শুরু করেন। এই ধর্মমত মুলত সনাতন হিন্দু ধর্মেরই পরিশিলিত রুপ। মুর্তিপূজা ইত্যাদির প্রতি সমর্থন করলেও বিবেকানন্দ জাতপাত সহ বিভিন্ন বিষয়ে আপত্তি করতেন।১৮৯৭ সালে ভারতে যখন ফিরে আসেন তখন তিনি বিখ্যাত মানুষ।
আমেরিকা ও ইউরোপে তিনি অনেক শিষ্য ও বন্ধু লাভ করেন। তার এই বিদেশি শিষ্যদের মধ্যে অন্যতমা ছিলেন মার্গারেট নোবল। যিনি পরবর্তিতে সিষ্টার নিবেদিতা বলে পরিচিত হন ও ভারতে নারি শিক্ষা ও স্বাধিনতা সংগ্রাম এর বিশেষ অবদান রাখেন। কবি রবিন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে লোকমাতা বলে অভিহিত করেন। যদিও ব্রাম্ম সমাজ এর প্রধান রবিন্দ্রনাথ এর সাথে স্বামি বিবেকানন্দের সম্পর্ক ভাল ছিলনা। দেশে ফিরে এসে প্রধানত বিদেশি বন্ধু ও ভক্তদের সাহাজ্যে বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন শ্রিরামকৃষ্ণ মঠ। যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল শ্রিরামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দর নতুন বেদান্ত ভিত্তিক হিন্দু ধর্মের প্রচার। রামকৃষ্ণ মঠ একটি নতুন সন্যাসি সংঘ হিসেবেও গড়ে উঠে। ধর্মপ্রচার ও ধর্মচর্চা ছাড়াও স্বামি বিবেকানন্দ তার প্রতিষ্ঠিত সন্যাসি সংঘে মানব সেবার নিয়ম প্রবর্তন করেন। অত্যন্ত ভাল সংগঠক হিসেবে কাজ করেন বিবেকানন্দ ও তার সাথিরা। শ্রিঘ্রই এই সংগঠন এর উদ্যোগে দুর্ভিক্ষ ও ভুমিকম্প উপদ্রুত অঞ্চলে ত্রান সহায়তার কর্মসূচি বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষন করে। এছাড়া শিক্ষা ও সাস্থ ক্ষেত্রেও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয় এই সংস্থা থেকে। সংস্থা প্রতিষ্ঠিত তিনি আগে থেকেই ডায়াবেটিস এ আক্রান্ত ছিলেন। অসুস্থ হয়ে ১৯০২ সালের ৪ঠা জুলাই কলকাতার বিপরিতে গঙ্গা নদিও পশ্চিম পাশের হাওড়া তে তারই স্থাপিত বেলুড় মঠে মৃত্যুবরন করেন। তাকে সেখানেই দাহ করা হয়।
মাত্র ৩৯ বছর এর জিবনে স্বামি বিবেকানন্দ যে কাজ ও সংস্খা স্থাপন করে গিয়েছিলেন শতবর্ষ অতিক্রান্ত হলেও সেই সংস্থাটি এখনও সমান কার্যকর এবং এর পরিধি অনেক সম্প্রসারিত হয়েছে। রামকৃষ্ণ মিশন এর অধিনে এখন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় সহ উন্নত হাসপাতাল,স্কুল,কলেজ, অনাথাশ্রম প্রভৃতি সারা ভারত জুড়ে পরিচালিত হচ্ছে। ভারতের বাইরে বাংলাদেশ সহ ১৫-১৬ টি দেশে এই প্রতিষ্ঠানের শাখা আছে। বেদান্ত মতবাদ প্রচার ছাড়াও বিভিন্ন সেবাকার্য এই সংস্থাটি বিশ্বব্যাপি পরিচালনা করে যাচ্ছে।
এটি প্রধানত হিন্দু ধর্মিয় প্রতিষ্ঠান হলেও এর প্রতিষ্ঠাতা স্বামি বিবেকানন্দ কে এখনও অনেকে হিন্দু মানতে অস্বিকৃতি জানান। স্বামি বিবেকানন্দ যখন শিকাগোতে তখন তার সন্মানে একটি সম্বর্ধনা সভায় সভাপতিত্ব করতে তৎকালিন বিচারপতি দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায় রাজি হননি এই যুক্তিতে যে কায়স্থ বলা হলেও বিবেকানন্দ আসলে শুদ্র শ্রেনির অন্তর্ভূক্ত এবং শুদ্র সন্যাসি হতে পারেনা। বিবেকানন্দের মৃত্যুর পরও আরো দুই বিচারপতি তার শোকসভায় যোগ দিতে অস্বিকার করেন। এরমধ্যে একজন তো মন্তব্য করেন যে হিন্দু রাজত্ব থাকলে বিবেকানন্দের মৃত্যদন্ড হতো! ১৯৮০ সালের দিকে রামকৃষ্ণ মিশন এর পক্ষ থেকে ভারতিয় সুপ্রিম কোর্টে একটি আপিল করা হয় যে তাদের যেন হিন্দু বহির্ভুত সংখ্যালঘু গোষ্ঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। যদিও ভারতিয় সুপ্রিম কোর্ট তাদের আবেদন গ্রহন করেননি। কিন্তু এর আগে থেকেই রামকৃষ্ণ মিশন এর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি ও প্রচার এর অভিযোগ ছিল। তবে এই সময় থেকে আগের সেবক এবং ধর্মিয় সহিষ্ণুতার ভাবমুর্তি কিছূটা ভেঙ্গে যেতে শুরু করে। স্বামি বিবেকানন্দর লেখা পড়ে এটা বুঝা যায় যে তিনি সর্বধর্ম সমন্বয় নয় বরং শান্তিপূর্ন সহাবস্থান নিতিতে বিশ্বাস করতেন। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনে একাধিক প্রশিক্ষনার্থি ব্রম্মচারির অভিজ্ঞতার বিবরনে দেখা গেছে ভারতে বিজেপি ও আরএসএস এর প্রভাব রামকৃষ্ণ মিশন এর উপর ও যথেষ্ট পরেছে। রামকৃষ্ণ মিশনে আগেকার সহিষ্ণুতা এবং বেদান্তর পরিবর্তে হিন্দু গোঁড়ামি কে প্রাধান্য দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে এর মধ্য থেকেই। কয়েকজন সন্যাসি এই অভিযোগে সংঘ ত্যাগ ও করেছেন। বর্তমান ভারতিয় প্রধানমন্ত্রি এবং গুজরাট এর নৃসংশ হত্যাকান্ডের নায়ক নরেন্দ্র মোদি প্রায় দুই বছর রামকৃষ্ণ মিশনের সদস্য ছিলেন এবং এখনও এই মিশন এ মঠের অন্যতম ভক্ত হিসেবে পরিচিত।
স্বামি বিবেকানন্দ তার সল্প মেয়াদি জিবনে যে শুভ কাজের সূচনা করেছিলেন শতবর্ষ পার হয়ে তা এভাবেই বিকৃত হয়ে পরেছে।
বিষয়: বিবিধ
২৫৯২ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আমার শৈশবে রামকৃষ্ণ মিশনকে সেবাপ্রতিষ্ঠান হিসেবেই দেখেছি!
কিন্তু বাংলাদেশের জন্মের পর সবই যেন বদলে গেলো!!
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, জাযাকাল্লাহ,
হিন্দুদের মন্দির হিসেবেই জানতাম!
তথ্যসমৃদ্ধ উপস্হাপনা জানিয়ে গেল অনেক কিছু!
ধন্যবাদ রইল মুহতারাম!
গত দুইদিন আগে ঢাকার বাড্ডাতে এক হিন্দু পবিত্র কোরানে আগুন দিয়েছে অথচ এটা কোন মিডিয়াতেই আসলোনা !! আর যদি কোন মুসলিম দেশের কোন এক অজোপাডাগায়েও কোন মন্দিরে অথবা কোন হিন্দুর উপর আক্রমন করতো তাহলে হয়তো ঐটা সারাদেশের মিডিয়া প্রচার করতে করতে হয়রান হয়ে যেত। তাই বলছিলাম কি ভাইয়া, হিন্দুদের প্রচারের জন্য মিডিয়ার কোন অভাব নেই, কিন্তু ইসলামের জন্য কলম ধরার লোখের খুব অভাব। আশাকরি আপনি আমার পয়েন্ট বুঝতে পারছেন। ধন্যবাদ আপনাকে
আর হ্যাঁ, পোস্টটি পাবলিশ করার আগে মনে হয় বানানের দিকে নজর দেন নি! অসংখ্য ভুলে ভরা। একটু দেখে ঠিক করে নেবেন।
একটানে লিখা তাই বানান সংশোধন করা হয়নি। কম্পিউটার টাইপ ও ফন্ট কনভার্ট করতে গিয়ে বেশি ভুল হয়ে গেছে। আর এই পোষ্টে যুক্তাক্ষর এর ব্যবহার ও বেশি হয়েছে!!!!
ধন্যবাদ..
মন্তব্য করতে লগইন করুন