মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ন বই।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৫, ১০:৫৪:২৮ রাত
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। সবাই নিজের নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে একে বিশ্লেষন করেছেন। এটা স্বাভাবিক। সকল ঐতিহাসিক ই ইতিহাস কে তার নিজের আদর্শিক দৃষ্টি থেকেই বিশ্লেষন করেন। কিন্তু একজন সৎ ঐতিহাসিক বিশ্লেষন ও সিদ্ধান্ত যে দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই করুন না কেন ইতিহাসের ঘটনাবলি বা ফ্যাক্ট বর্ননায় থাকেন নির্মোহ সত্যের অনুসারি। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা শুধু নিজ সিদ্ধান্ত কে সঠিক প্রমানে ইতিহাসের ফ্যাক্ট বা সত্য কে বিকৃত করে ফেলেন।
দুর্ভাগ্য জনক ভাবে আমাদের স্বাধিনতা যুদ্ধের ইতিহাস ও এই ধরনের বিভ্রান্তি তে আক্রান্ত। কেন ১৯৭১ সালে এই স্বাধিনতা যুদ্ধ হল এবং মুক্তিযোদ্ধারা কেন সেটায় যোগ দিলেন এবং যারা বিরোধিতা করেছিলেন কেন বিরোধিতা করেছিলেন সেই নিয়ে কোন নির্ভরযোগ্য পক্ষপাতহীন গবেষনা এখনও হয়নি। তবে স্বাধিনতা যুদ্ধে অংশগ্রহনকারি অনেকেই বিভিন্ন পর্যায় থেকে তাদের স্মৃতিকথা লিখেছেন। আমি পাঠকদের স্বাধিনতা যুদ্ধের ইতিহাস এর নামে কিছু লেখক যে ভুলে ভরা বই গুলি লিখেছেন তার পরিবর্তে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহনকারি দের লিখা অভিজ্ঞতা পড়ার আহবান জানাচ্ছি। এই বিষয়ে এই ধরনের বইগুলি পড়লে পাঠকরা নিজেই মুক্তিযুদ্ধের পটভুমি ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একটি পরিস্কার ধারনা করতে পারবেন। এই ধরনের কিছু বই এর পরিচিতি নিচে দেওয়া হল। পাঠক রাও নতুন বই এর নাম দিতে পারেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে আশাকরি এই বইগুলি সহায়তা করবে। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনকারী সকল পক্ষের মানুষের লিখাই এই তালিকায় স্থান পেয়েছে। শুধুমাত্র বাংলায় প্রকাশিত ও অনূদিত বই এর নাম দেওয়া হল যা পাঠক দের জন্য সহজলভ্য।
১. দ্য লাস্ট ডেজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান- জি.ডব্লিউ চেীধুরি। ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত। লেখক বাঙ্গালি ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা ছিলেন। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান উভয় দেশ ত্যাগ করে মার্কিন নাগরিকত্ব গ্রহন করেন। কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন গবেষক ছিলেন।
২.এক জিবন এক ইতিহাস- সিরাজুর রহমান। ঐতিহ্য। বিবিসি খ্যাত সাংবাদিক সিরাজুর রহমান মুক্তিযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক স্বিকৃতি ও সহায়তা আদায় এ গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রাখেন। বইটি মুক্তি যুদ্ধ ছাড়াও বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ন দলিল।
৩.সামরিক জিবনের স্মৃতি- ব্রিগেডিয়ার(অবঃ) চেীধুরি খালেকুজ্জামান। ইউপিএল। চেীধুরি খালেকুজ্জামান ১৯৭১ সালে ৮ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এ নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের শুরু এবং ইতিহাস সম্পর্কে একজন প্রত্যক্ষদর্শির বিবরন এটি।
৪.মুক্তিযুদ্ধ জাতিয় নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষানিতি-্মেজর জেনারেল(অবঃ) ইমামুজ্জামান।যোগাযোগ পাবলিশার্স। লেখক একজন মুক্তিযোদ্ধা। তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞার বিবরন।
৫.এক জেনারেল এর নিরব সাক্ষ্য স্বাধিনতার প্রথম দশক।- মেজর জেনারেল (অবঃ) মইনুল হোসেন চেীধুরি। মাওলা ব্রাদার্স। মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম সেনানায়ক। পরবর্তিতে তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। এই বইটিতে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর এবং পরবর্তিতে বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিষয়ে অত্যন্ত নিরপেক্ষ বর্ননা করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস জানতে বইটি অবশ্যপাঠ্য।
৬. একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ রক্তাক্ত মধ্য আগষ্ট ও ষড়যন্ত্রময় নভেম্বর- কর্নেল শাফায়াত জামিল (অবঃ)। সাহিত্য প্রকাশ। লেখক একজন মুক্তিযোদ্ধ। যুদ্ধের সময় ৪র্থ ও ৩য় ইষ্ট বেঙ্গল এর অধিনায়ক ছিলেন। তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ও ইতিহাস এর বিবরন দিয়েছেন।
৭. মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস- উইং কমান্ডার(অবঃ) হামিদুল্লাহ খান। কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি। লেখক এর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য সহযোদ্ধা দের বিবরন থেকে লিখা। তিনি প্রথমে সাবসেক্টর ও পরে সেক্টর কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এটি মুক্তিযুদ্ধের সময় অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ন যুদ্ধগুলি সম্পর্কে জানতে অত্যন্ত ভাল একটি উৎস।
৮. যখন সময় এলো- জাতিয় অধ্যাপক সৈয়দ আলি আহসান। নওরোজ কিতাবিস্তান। মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজিবিদের ভুমিকা এবং ভারতিয় বুদ্ধিজিবিদের মানসিকতা সম্পর্কে জানতে একটি গুরুত্ব পূর্ন বই।
৯. আমার দেখা রাজনিতির পঞ্চাশ বছর-আবুল মনসুর আহমদ। আহমদ পাবলিশিং। লেখক আওয়ামিলিগ নেতা বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও সাংবাদিক। পাকিস্তানের অস্থায়ি প্রধানমন্ত্রি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ সহ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন একটি বই।
১০. সেনাবাহিনির অভ্যন্তরে আটাশ বছর- মেজর জেনারেল (অবঃ) সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম।
১১. রক্তেভেজা একাত্তর-মেজর(অবঃ) হাফিজুদ্দিন আহমদ।
১২. জিবনের যুদ্ধ,যুদ্ধের জিবন- লেঃকঃ (আবঃ)নুরন্নবি খান।
১৩. যুদ্ধে যুদ্ধে স্বাধিনতা-মেজর (অবঃ) নাসিরুদ্দিন।
১৪. মুক্তিযুদ্ধের নয়মাস- মেজর জেনারেল (অবঃ) সুবিদআলি ভুইয়া।
১৫. মূলধারা ৭১-মইদুল হাসান।
১৬. আগরতলা মামলা ও আমার নাবিক জিবন-কমান্ডার (অবঃ) আবদুর রউফ। মীরা প্রকাশন। লেখক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা আসামি ছিলেন। পরে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন এবং বাংলাদেশ নেীবাহিনির এডুকেশন ব্রাঞ্চ এ কমান্ডার পদে উন্নিত হন।
১৭. ১৯৭১ ভিতরে বাইরে- এয়ার ভাইস মার্শাল (অবঃ) একে খন্দকার। প্রথমা। লেখক মুক্তিযুদ্ধের সময় ডেপুটি চিফ অফ ষ্টাফ ছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে আটক থাকা বাঙ্গালিদের সম্পর্কে জানতে কয়েকটি বই।
১৮. আমার সৈনিক জিবন,পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ- মেজর জেনারেল (অবঃ) মনজুর রশিদ খান। প্রথমা প্রকাশন।
১৯. পূর্বাপর ১৯৭১ পাকিস্তানি সেনা গহ্বর থেকে দেখা- মেজর জেনারেল (অবঃ)মুহাম্মদ খলিলুর রহমান। সাহিত্য প্রকাশ। লেখক ১৯৭১ সালে ব্রিগেডিয়ার হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনির হেডকোয়ার্টারে কর্মরত ছিলেন।
২০. ফেলে আসা সৈনিক জিবন- লেঃকঃ (অবঃ) এম এ হামিদ।
২১. ১৯৭১ সালে পাক সাবমেরিন ছিনতাই এর চাঞ্চল্যকর গল্প- কমোডর (অবঃ) এসএস নিজাম। ১৯৭১ সালে লেখক ও তার কয়েকজন সহযোগি একটি সাবমেরিন ছিনতাই করে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ব্যার্থ হন। এর চমকপ্রদ বিবরন সাথে মুক্তিযুদ্ধের পটভুমি সম্পর্কেও কিছু তথ্য আছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ভারতিয় ও পাকিস্তানি সামরিক অফিসার দের লিখা কয়েকটি গুরুত্বপুর্ন বই।
২২. বাংলাদেশের জন্ম- মেজর জেনারেল(অবঃ) রাও ফরমান আলি খান। ইউপিএল।
২৩. পাকিস্তান যখন ভাঙলো- লেঃজেঃ(অবঃ) গুল হাসান। ইউপিএল। লেখক ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনির তৃত্বিয় সর্বোচ্চ পদ চিফ অফ জেনারেল ষ্টাফ হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। পরে সেনাপ্রধান হন।
২৪. নিয়াজির আত্মসমর্পন এর দলিল- ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালিক। নভেল পাবলিকেশন্স। সিদ্দিক সালিক আর্মি এডুকেশন কোর এর অফিসার। ১৯৭১ সালে পাবলিক রিলেশন এর দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৮৮ সালে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জিয়াউল হক এর সাথে বিমান দুর্ঘটনায় নিহত হন।
২৫. বিট্রেয়াল ইন ইষ্ট পাকিস্তান- লেঃ জেঃ এএকে নিয়াজি।
১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি সশস্ত্রবাহিনির প্রধান। বইটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন যদিও তার ব্যাক্তিগত দৃষ্টি থেকে লিখা। তার দাবি ও যুক্তি গুলি অবশ্যই বিবেচনাযোগ্য।
২৬. সারেন্ডার এট ঢাকা,বার্থ অফ এ নেশন- লেঃজেঃ জেএফআর জ্যাকব। ইউপিএল। ১৯৭১ সালে জ্যাকব ছিলেন ভারতিয় সেনাবাহিনির ইষ্টার্ন কমান্ড এর প্রধান ষ্টাফ অফিসার।
২৭. স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়- মেজর জেনারেল সুখওয়ান্ত সিং। মীরা প্রকাশন। লেখক ১৯৭১ সালে ভারতিয় সেনাবাহিনির অতি গুরুত্বপূর্ন অপারেশন ডাইরেক্টরেট এর উপ পরিচালক ছিলেন।
এই বই গুলি ছাড়া আরও অনেক বই আছে। তবে আমার মনে হয় এই বই গুলি থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিষয়ে অনেক স্বচ্ছ ধারনা পাওয়া যাবে।
বিষয়: বিবিধ
২৯২৪ বার পঠিত, ৩২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
.
.
১. আমি বিজয় দেখেছি - এম আর আখতার মুকুল
.
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিল পত্র - ১৫ খণ্ডে সমাপ্ত।
মাত্র তো ২৫-৩০ টা বই। আপনিও পড়্রুন।
Are there any links or website to get these books online?
সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল লিখিত "অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা" ধারাবাহিক কোন ইতিহাস না হলেও এতেও উঠে এসেছে ভারতীয় বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর উদ্দেশ্য ও মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রহীন করে তাদের (মুজিব বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী) লুটপাটের অনেক চিত্র।
সহমত আপনার সাথে। এর মধ্যে বেশ কয়েকটা পড়েছি।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মানুষ এখন এতো বেশি আবেগ আপ্লুত যে, রাজাকার, আল বদর আল শামস এবং এর বিপরীতে মুক্তিবাহিনীর দেশের জন্য জীবন দান, এছাড়া আর কিছু জানার কোন টেনডেন্সিই দেখা যায়না। সঠিকটা জানাতে গেলেই আবেগের জাউগায় হিট করে, তা সত্যো হলেও প্রতিক্রিয়া কিন্তু শুভ হয়না।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ, নিশ্চয় বইগুলো পড়ে অনেকে উপকৃত হবে।
১। ডেড রেকনিং-শর্মিলা বসু
২। কালো পঁচিশের আগে ও পরে-আবুল আসাদ
৩। বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ : বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ-এস আই তোসেন
৪। বেশি দামে কেনা কম দামে বেচা আমাদের স্বাধীনতা-আবুল মনসুর আহমদ
ধন্যবাদ।
এখন শুধু নেতাদের কৃত কর্মের জন্য মাফ চাওয়াই হতে পারে তাদের জন্য গ্রেট কাম ব্যাক
বই পড়ার ফলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারতেছেন উনাদের সেই লিজেন্ডারী কাজকারবার ?
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন