বসফরাসে বিস্ফোরন এর পদধ্বনি
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২৯ নভেম্বর, ২০১৫, ০২:০৬:২৫ দুপুর
তুরুস্কের বিরুদ্ধে অবরোধ আরোপ করেছে রাশিয়া। গত ২৪এ নভেম্বর উত্তর সিরিয়ার আকাশে তুর্কি এফ-১৬ বিমান রাশিয়ার এসউ-২৪ শ্রেনির একটি বোমারু বিমান কে ভুপাতিত করার পর থেকেই উভয় দেশের মধ্যে শুরু হওয়া কূটনৈতিক বিরোধ এর চুড়ান্ত পর্যায় হিসেবে ধরা হচ্ছে একে। এমনকি একটি যুদ্ধের পূর্ব সংকেত ও ধরা যেতে পারে। সিরিয়া- ইরাক কে কেন্দ্র করে চলতে থাকা মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ক্রমেই বিস্তৃত হয়ে আরো ভয়ংকর হয়ে উঠার যে আশংকা বিশেষজ্ঞরা করছিলেন তার বাস্তবায়ন হচ্ছে বলেই মনে করছেন অনেকে। ২০১৪ সালে রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল এর পর থেকেই তুরুস্ক-রাশিয়া বিরোধ সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল। রাশিয়ার এই অবরোধ তুরুস্ক ও রাশিয়া উভয় দেশের অর্থনিতির উপর প্রভাব ফেলবে সেই সঙ্গে সারা বিশ্বে চলতে থাকা মন্দা কেও বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করবে।
তুরস্ক-রাশিয়া বিরোধ কিন্তু ঐতিহাসিক ভাবেই। পিটার দি গ্রেট যখন রুশ সাম্রাজ্য স্থাপন করেন তখন থেকেই উভয় দেশের মধ্যে কখনও যুদ্ধ কখনও ঐক্য এই নিতি চলে আসছে। তুরুস্ক যখন উসমানিয়া সালতানাত এর অধিনে মুসলিম জাহান এর নিশান-ই-খিলাফত বহন করছিল তখনও রাশিয়া তুরুস্কের প্রতি নামমাত্র অনুগত মধ্য এশিয়ার মুসলিম রাস্ট্রগুলির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। এই যুদ্ধগুলিতে বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ড সহ উত্তর ও পূর্ব ইউরোপিয় দেশগুলি তুরুস্কের সমর্থন করলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে এই নিতি পালটে যায়। ১ম বিশ্বযুদ্ধে রাশিয়ার জার সরকার ইংল্যান্ড এর পক্ষে জার্মানির সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। অন্যদিকে তুরুস্ক জার্মান পক্ষ অবলম্বন করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ইংল্যান্ড এক গোপন চুক্তিতে তুরুস্কের বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রনালীর নিয়ন্ত্রন রাশিয়ার হাতে দেওয়ার অঙ্গিকার করে। কিন্তু যুদ্ধে বিজয়ি হলেও ১৯১৭ সালে রাশিয়ার কম্যুনিষ্ট বিপ্লব চুক্তিটি বাস্তবায়ন হতে দেয়নি। পরিবর্তে পশ্চিমা মিত্র শক্তি তুরুস্ক খিলাফতকে উচ্ছেদ করে শক্তিশালি সরকার কায়েম করতে কামাল পাশার ধর্মহীন সরকার কে সর্বোতভাবে সহায়তা করে। কম্যুনিস্ট রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রধান কেন্দ্র হয়ে দাড়ায় তুরুস্ক। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আবার তুরুস্ক ও রাশিয়ার সাময়িক বন্ধুত্ব হয়। দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের পর কম্যুনিষ্ট-পশ্চিমা বিরোধ কোরিয়া ও ভিয়েতনাম এর দিকে সম্প্রসারিত হলে সাময়িক ভাবে সোভিয়েট ও তুরুস্ক শান্তিপূর্ন প্রতিবেশি হিসেবে বসবাস করতে থাকে।
সোভিয়েট ইউনিয়ন এর পতন এর পর রাশিয়া সাময়িকভাবে অর্থনৈতিক দুর্বলতার মুখে পরে। তুরুস্ক তখন যথেষ্ট সহায়তা করেছিল। ভ্লাদিমির পুটিন রাশিয়ার ক্ষমতায় আসলে রাশিয়া তার দুর্বলতা কাটিয়ে উঠে পুনরায় পরাশক্তি হয়ে উঠার সপ্ন দেখতে শুরু করে। প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে রাশিয়া তার সিমান্তবর্তি সাবেক সোভিয়েট স্টেট জর্জিয়ার আভ্যন্তরিন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে জর্জিয়াকে তিনভাগে বিভক্ত করে। এরপর ইউক্রাইন এর নিয়ন্ত্রনে থাকা ক্রিমিয়া অঞ্চল কে গত বছর বিভিন্ন সমস্যা সৃস্টি করে নিজেদের নিয়ন্ত্রনে নিয়ে নেয়। কৃষ্ণ সাগর এর পূর্ব উপকুল এর ক্রিমিয়ার নিয়ন্ত্রন নেওয়া কৃষ্ণ সাগরে রূশ প্রভাব বিস্তার এর প্রথম পদক্ষেপ হিসেবেই দেখা হয়।
এরই মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হয় আরেক যুদ্ধ। তথাকথিত আইসিস বা দায়েশ এর সাথে সিরিয়ার বাশার আল আসাদ এর সরকার এবং গনতন্ত্রপন্থিদের সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয়। রাশিয়া এই ক্ষেত্রে সরাসরি সমর্থন করে বাশার আল আসাদ কে। তুরুস্ক সবসময়ই আসাদ বিরোধি ছিল। আইসিস বিরোধি হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট সহ পশ্চিমা দেশগুলি বাশার এরও বিরোধি। রাশিয়া নিজের প্রভাব বৃদ্ধির জন্য বাশার আল আসাদ কে সরাসরি সমর্থন দিচ্ছে এবং ইরান কেও তার পাশে রেখেছে। এই নিয়ে তুরুস্কের সাথে রাশিয়ার চলতে থাকে কূটনৈতিক যুদ্ধ সরাসরি যুদ্ধে রুপ নিল ২৪ এ নভেম্বর। রাশিয়া এই বিমান ভুপাতিত করার ত্রিব্র প্রতিবাদ করে। কিন্তু তুরুস্ক এই বিষয়ে কোন ক্ষমা চাইতে অস্বিকার করে এবং প্রমান সহ দেখায় যে আকাশ সিমা লংঘনকারি রুশ বিমানটিকে যথেষ্ট সতর্ক করা হয়েছিল। কয়েকদিন কূটনৈতিক বিতর্ক চলার পর আজকে রুশ প্রেসিডেন্ট পুটিন এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ এর মাধ্যমে চলমান সংকট কে আরো ঘনিভুত করলেন।
রাশিয়া আশা করছে এই অবরোধ তুরুস্ককে অনেক চাপে ফেলবে। কারন তুরুস্ক তার জ্বালানির জন্য রাশিয়ার উপর বিশেষভাবে নির্ভরশিল। নিকটবর্তি ইরানের কাছে প্রচুর তেল থাকলেও ইরানের সাথেও বর্তমান তুরুস্কের সম্পর্ক ভাল নয়। সৌদি আরব সহ উপসাগরিয় দেশগুলি থেকে তেল আমদানি ও সহজ হবেনা। রাশিয়ার প্রভাবাদিন ককেশিয় দেশগুলিও এতে কোন সহায়তা করবে না। অন্যদিকে শিতকালিন খাদ্যের জন্য রাশিয়া তুরুস্কের উপর অনেকাংশে নির্ভরশিল। কিন্তু তাদের কাছে বিকল্প পথ একাধিক আছে। কিন্তু রাশিয়ার বড় সমস্যা হবে আগে থেকেই তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একঘরে অনেকটা। তুরুস্কের সঙ্গে এতদিন যে ভাল বানিজ্য ছিল সেটা বন্ধ হলে তাদের অর্থনিতিতেও যথেষ্ট প্রভাব পড়বে।
আভ্যন্তরিন রাজনৈতিক দিক দিয়ে রাশিয়া এখন অনেক সুদৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। ভ্লাদিমির পুটিন এর লৌহকঠিন শাসনে রাশিয়া এখন পূর্ন ঐক্যবদ্ধ। যেকোন সমস্যা মোকাবিলা করতে তারা সক্ষম। অন্যদিকে মধ্যবর্তি নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা ফিরে পেলেও তুরুস্কে একেপি সরকার অনেক চাপের মধ্যেই থাকবে। যে কোন যুদ্ধ বা সমস্যার ক্ষেত্রে কুর্দিরা ভিন্ন মত ও পথ অবলম্বন করতে পারে। ন্যাটোর সদস্য হলেও গত ১৫ বছর ধরে একেপি সরকার এর শাসনে সাবেক অতি ধর্মহীন তুরুস্কে ইসলাম এর উত্থান অনেক পশ্চিমা রাস্ট্রই ভাল চোখে দেখছে না। আইসিস ও মধ্যপ্রাচ্য নিয়েও পশ্চিমা দেশের সাথে বিরোধ আছে তুরুস্কের। যে কোন যুদ্ধই তুরুস্কের জন্য বিশেষ সমস্যার হয়ে উঠতে পারে।
তবে আন্তর্জাতিক রাজনিতিতে রাশিয়াকে পুনরায় পরাশক্তি হয়ে উঠার সুযোগ দিতে না চাইলে পশ্চিমারা অবশ্যই তুরুস্কের সমর্থনে এগিয়ে আসবে। বিশাল রাষ্ট্র রাশিয়ার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে তার অসংখ্য বন্দর এর বেশিরভাগই বৎসরের অর্ধেক সময় বরফের কারনে জাহাজ চলাচল এর অনুপযোগি থাকে। কেবল মাত্র কৃষ্ণ সাগরের বন্দরেই সারা বছর জাহাজ ভিড়তে পারে। কিন্তু কৃষ্ণ সাগরে জাহাজ চলাচল সম্পুর্ন ভাবে নির্ভরশিল তুরুস্কের মর্জির উপর। বসফরাস প্রনালি, মরমরা সাগর, ও দার্দানেলিস প্রনালির নিয়ন্ত্রন সম্পুর্নভাবে তুরুস্কের হাতে। কৃষ্ণ সাগর অনেকটাই একটি হ্রদ এর মত বদ্ধ। তুরুস্কের নিয়ন্ত্রনে থাকা এই সংকির্ন জলপথটি অতিক্রম না করে ভুমধ্য সাগর হয়ে রাশিয়ান দের মহাসাগরে প্রবেশ করা অসম্ভব ব্যাপার। সোভিয়েট আমলেই রাশিয়ার এই বিরাট দুর্বলতা ধরা পরে। বিশাল সাম্রাজ্য গঠন করেও প্রয়োজনিয় সি-একসেস এর অভাবে রাশিয়া অনেক ক্ষেত্রেই প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। যেখানে তার প্রতিদন্দি মার্কিনরা বিমানবাহি জাহাজ এর সাহাজ্যে সহজেই হস্তক্ষেপ করেছে। সোভিয়েট অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে রাশিয়া সম্ভবত এখন তাদের প্রথম টার্গেট হিসেবে তুরুস্ককেই নির্ধারন করেছে যাতে করে মহাসাগরে প্রবেশ করতে তাদের বিশেষ বাধা না থাকে।
মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বের আসনে উঠে আসা তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদুগান পশ্চিমা বিশ্বের কাছেও বিশেষ প্রিয় মানুষ নন। এরদুগান এর উদ্যোগে মুসলিম বিশ্ব এক হোক এটা পশ্চিমা জোটের কাম্য নয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়ার এই আগ্রাসন কে তারা কিভাবে নেবে সেটা দেখার বিষয়। রাশিয়া তুরুস্ক বিরোধে যদি তুরুস্কের ক্ষতি হয় তবে বর্তমান বিশ্বে চলমান ইসলামি আন্দোলনগুলিও চাপের মুখে পড়বে। সেটা আবার পশ্চিমা বিশ্বের জন্য লাভজনক। সব মিলিয়ে এক জটিল সমিকরন আর মহাযুদ্ধের হুমকির মুখে এখন বিশ্ব।
মানচিত্র টিতে কৃষ্ণসাগর এবং এর আশেপাশের দেশগুলির অবস্থান দেখান হয়েছে। বাম পাশে থ্রেস নামে পরিচিত তুরুস্কের ইউরোপিয় অংশ এর নিজে বসফরাস ও দার্দানেলিস প্রণালি দেখান হয়েছে।
বিষয়: বিবিধ
২২৪০ বার পঠিত, ২৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আরবদেশগুলোকে তুরস্কের পক্ষে পেলে অবশ্যই পশ্চিমারা তুরস্কের পক্ষে থাকবে।
দোয়া করি তেমন কিছু না হোক
ধন্যবাদ
তুরস্কের ইসলামী শক্তির উত্থান রোধ করতে দুই পরাশক্তির সাজানো ছকে তুরস্ক হতে যাচ্ছে যুদ্ধক্ষেত্র!
ইতিমধ্যে তুরস্ককে ন্যাটো থেকে বহিস্কারের কথা উঠেছে! সেটা হলে রুশ-তুর্কী লড়াই-এ পশ্চিমাজোট তামাশা দেখবে শুধু, যেমনটা রুশ দেখেছে ইরাকে!!
আরবরাষ্ট্রগুলো তুরস্কের পাশে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা দুর্বল!!
তুরস্কের কুটনীতি ও সমরশক্তির কঠিন পরীক্ষা!!
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য ধন্যবাদ। আসলেই ন্যাটো বা আমেরিকা তুরুস্ককে কতটা সাহাজ্য করবে তা অনিশ্চিত। কিন্তু তুরুস্ক যদি অন্ততপক্ষে তাদের পূর্ন নিরপেক্ষ রাখতে পারে তাহলেও তাদের সুবিধা হবে।
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
(এত বড় সাহস! ইউরোপের রুগ্ন ব্যক্তির এত বড় সবলের যুদ্ধ বিমানকে চ্যালেঞ্জ করে?)
-ধন্যবাদ। আপনার লেখা থেকে মন্তব্য করা হল।
মন্তব্য করতে লগইন করুন