প্রকৃতির প্রতিশোধ বা নিয়তির খেলা
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৫ অক্টোবর, ২০১৫, ১২:০৯:৫৫ রাত
গত শতাব্দির ষাটের দশক ছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এর সাথে সোভিয়েট সাম্রাজ্যবাদ এর লড়াই এর সর্বোচ্চ সময়। তথাকথিত কোল্ড ওয়ার তখন প্রক্সি ওয়ার এ চলছে পূর্ব আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া এবং আফগানিস্তান এ। আফগানিস্তান এ যেমন সোভিয়েট রা সরাসরি যুদ্ধে নেমেছিল তেমনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে নেমেছিল দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার ভিয়েতনাম এ। পৃথিবির ইতিহাসে সবচেয়ে ঘৃনিত যুদ্ধগুলির একটি ছিল এই ভিয়েতনাম যুদ্ধ। তবে একই সঙ্গে অমিত শক্তিশালি হয়েও জনগনের কাছে পরাজয় এর অন্যতম উদাহরন এই ভিয়েতনাম যুদ্ধ।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৫ সাল থেকেই চিন ও রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট গেরিলাদের সাথে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট ভিয়েতনাম সরকার এর এই লড়াই শুরু। এই সময় ভিয়েতনাম বিভক্ত হয়ে যায় উত্তর ও দক্ষিন ভিয়েতনাম এ। দির্ঘদিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েও বিশেষ কাজ না হওয়ায় ১৯৬৪ সালের মার্কিন ডেস্ট্রয়ার ইউএসএস ম্যাডক্স এ উত্তর ভিয়েতনামি টর্পেডো বোট এর হামলার মিথ্যা নাটক সাজিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি হস্তক্ষেপ করে এই যুদ্ধে। প্রথম বিমানবাহি জাহাজ থেকে হামলা এবং পরে ফিলিপাইন ও ওকিনাওয়ার বিমান ঘাটি থেকে বি-৫২ বোমারু বিমান ব্যবহার করে ছোট্ট ভিয়েতনাম দেশ টিকে যেন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তাতেও ভিয়েতনামি জনসাধারন কে দমাতে না পেরে তিনবাহিনির মিলিত অভিযান শুরু করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
এই অভিযান ছিল বিশ্বের নৃশংসতম কিছু ঘটনার সৃষ্টিকারি। যার মধ্যে কুখ্যাতটি মাইলাই হত্যাকান্ড। মার্কিন সরকার প্রথমে অস্বিকার করলেও এই হত্যাকান্ডে অংশগ্রহনকারি কয়েকজন সৈনিক এর স্বিকৃতি এই সত্যটিকে প্রকাশ করে। এরকম আরো প্রায় শখানেক ঘটনা ঘটিয়েছিল ভিয়েতনামে মার্কিন সশস্ত্রবাহিনি। এবং এর প্রতিটিই ছিল যুদ্ধের সাথে সম্পর্কবিহিন সাধারন মানুষের উপর। দক্ষিন ভিয়েতনামি কম্যুনিষ্ট গেরিলা তথা ভিয়েতকং দের খুজার নামে এভাবে জ্বালিয়ে দেওয়া হত গ্রামের পর গ্রাম। নাপাম তথা অগ্নি বোমা ব্যবহার করে জ্বালিয়ে দেওয়া গ্রাম থেকে দেীড়িয়ে যাওয়া এক নগ্ন আহত শিশুর ভিডিও সে সময় আইকনিক হয়ে উঠে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ এর বিরুদ্ধে।
কিন্তু ভিয়েতনামের স্থানিয় মানুষ যারা নিজদেশের পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে আশৈশব পরিচিত তাদের বিশাল জঙ্গল অধ্যুষিত এই দেশে খুঁজে বের করা সম্ভব ছিলনা। এই জন্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদিরা নতুন পথ নেয়। সেই পথ ছিল বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ ব্যাবহার করে ভিয়েতনামের সবুজ প্রকৃতিকে ধ্বংস করে দেওয়া এবং একই সাথে ভিয়েতনামের ফসল ধ্বংস করে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা। এই কাজে মার্কিন সহায়তায় এগিয়ে আসে কুখ্যাত কোম্পানি মনসান্টো। এই কোম্পানি "এজেন্ট অরেঞ্জ" ছদ্মনামে তৈরি করে একটি বিষাক্ত কেমিকেল। এই কেমিকেল টি ছিটালে সকল সবুজ গাছপালা পুড়ে মরে যেত এবং সেই মাটিতে দির্ঘদিন কোন ফসল হবেনা। এই বিষাক্ত কেমিকেল শুধু ফসল ই ধ্বংস করেনা এটা মানুষ ও অন্য প্রানির উপরও খুবই খারাপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এই কেমিকেল ও নাপাম বোমায় ভিয়েতনাম এর ১২০০০ বর্গমাইল সবুজ বন ও তৃনভূমি ধ্বংস হয়ে যায়। এই কেমিকেল এ প্রভাবে অনেক এলাকা ব্যবহার বা প্রবেশ করার অযোগ্য হয়ে যায় যার অনেকগুলি এখনও বিপদজনক রয়ে গেছে। এর প্রভাবে ভিয়েতনামে এখনও অনেক শিশু অঙ্গহিন কিংবা মানসিক অসুস্থতা নিয়ে জন্মায়। শুধু ভিয়েতনামি যোদ্ধাদের লুকানর সুবিধা নষ্ট করার নামে পরিবেশ ও মানবতার বিরুদ্ধে এই কাজ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদি রা করেছিল।
কিন্তু এই কেমিকেলটির ক্ষতিকর প্রভাব শুধু ভিয়েতনামেই সীমাবদ্ধ না থেকে খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই ছড়িয়ে পরে। এই কেমিকেল ছড়ানর জন্য মার্কিন সশস্ত্রবাহিনির যারা কাজ করত তারাও এই কেমিকেল এর বিষক্রিয়াতে আক্রান্ত হয়ে যায়। ভিয়েতনামে মার্কিন নৌবাহিনির নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রিয়ার অ্যাডমিরাল এলমো জুমওয়াল্ট। তিনি পরে মার্কিন নৌবাহিনি প্রধান হয়েছিলেন। তার অধিন নৌবহর এর "সুইফট" শ্রেনির পেট্রল বোট এর সাহাজ্যে ভিয়েতনাম উপকূলে এবং মেকং নদির অববাহিকা অঞ্চলে ছড়ান হতো এই বিষ। তার পুত্র এলমো জুমওয়াল্ট ৩য় ছিলেন তারই অধিনে একজন লেফট্যানান্ট ও পেট্রল বোট এর ক্যাপ্টেন। ষাটের দশকের শেষে দেশে ফিরে এলেও এই বিষের প্রভাবে তিনি হজকিন্স ডিজিজ এ আক্রান্ত হন। ১৯৭৭ সালে তার প্রথম সন্তান ও জন্মগত মানসিক প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জন্মায়। জুমওয়াল্ট এ সাক্ষাতকারে বলেন যে তার পরিবারের এই বিপর্যয়এর জন্য যে "এজেন্ট অরেঞ্জ" দায়ি তা তিনি নিশ্চিত। কিন্তু কোন আদালতে তিনি যেতে পারছেন না কারন প্রমান করা কঠিন। এই "এজেন্ট অরেঞ্জ" এত বিষাক্ত পদার্থ যে এর খালি ড্রামগুলিও অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে। যে কারনে অবশিষ্ট কেমিকেল এবং এর খালি ড্রামগুলি এখন জনষ্টোন এটল নামে প্রশান্ত মহাসাগরের এক নির্জন দ্বিপে নিয়ে রাখা হয়েছে।
ভিয়েতনামের বিশাল সবুজ প্রকৃতি ধ্বংসের ফলে যে পরিবেশ বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল সেটা থেকে এখনও মুক্ত হতে পারেনি ভিয়েতনাম। হয়তো একদিন প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে ফিরে যাবে পুর্বাবস্থায়। কিন্তু যে মানুষগুলি তাদের জিবনে বহন করল এই ক্ষত এলমো জুমওয়াল্ট এর এই বিপর্যয়ে তাদের কোন লাভ হবে কি? কিন্তু প্রকৃতি সে তার সুবিচার এর রিতি মেনে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কেও রেহাই দেয়নি।
এজেন্ট অরেঞ্জ ছড়াচ্ছে মার্কিন হেলিকপ্টার।
মার্কিন নাপাম হামলায় সারা শরির পুড়ে গেলেও জিবন রক্ষায় দেীড়াচ্ছে সবার সাথে ফেন থি কিম ফু। এই ছবিটি বিশ্বের বিবেকে নাড়া দিয়েছিল।
বিষয়: বিবিধ
২৪১৫ বার পঠিত, ৩৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
শুকরিয়া আপনাকে!
ক্ষমতার দম্ভে তারা এখন আফগানিস্তানেও একই পরিনতির সম্মুখিন। আমেরিকাকে সবাই ই চিনে।
এইটাইতো একটা মাকির্ণি গ্যঞ্জাম মনে হচ্ছে!
এই সত্য টা বুঝেনা বলেই মানুষ পাপ করে। ইহকালে হোক পরকালে জবাব দিতেই হবে।
এক টানে পড়ে ফেললাম
জাযাকাল্লাহ........
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
তবে তেল চাইলে আর ও বেশি বেশী দিতে পারব আমাদের এখানে তেল অনেক সস্তাই আছে ।
আপনাকেও ধন্যবাদ্।
মন্তব্য করতে লগইন করুন