মাওলানা হসরত মোহানী। চুপি চুপি রাত দিন।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ০৮:২৪:২৫ রাত
”চুপকে চুপকে রাতদিন আসূঁ বাহানা ইয়াদ হ্যায়,
হাম কো আবতক উ আশিকি কা ও জমানা ইয়াদ হ্যায়”
গোলাম আলীর কন্ঠে এই অতি জনপ্রিয় গযলটি সঙ্গিত প্রেমিক মানুষ মাত্রই অবশ্যই শুনেছেন। ভারতিয় ”নিকাহ” ছায়াছবিটিতেও ব্যবহৃত হয়েছিল এই গযলটি। কিন্তু আমরা অনেকেই জানিনা এই গযলটির রচয়িতা শুধু একজন কবি ছিলেন না। ছিলেন একজন স্বাধিনতা সংগ্রামি ,সাংবাদিক এবং ঘুমন্ত মুসলিম জাতিকে জাগিয়ে তুলার একজন নকিব।এই মহান ব্যাক্তিটির নাম সাইয়েদ ফজলুল হাসান । তার সাহিত্যিক তাখাল্লুস বা ছদ্মনাম ছিল হসরত। তার জন্মস্থান বর্তমান উত্তর প্রদেশের মোহন এর নাম অনুসারে তিনি পরিচিত ছিলেন হসরত মোহানী বলে।
১৮৮২ সালে হসরত এর জন্ম । তিনি ছিলেন ইরানি সাইয়েদ বংশোদ্ভুত। ছোটবেলা থেকেই মেধাবি হসরত এর কাব্য প্রতিভার উন্মেষ হয়। স্কুলে তিনি অত্যন্ত মেধার পরিচয় দেন এবং স্কুল জিবন শেষে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাথমিক যুগের ছাত্র হিসেবে যোগ দেন। এই সময় হসরত ছিলেন একজন জাতিয়তাবাদি কবি। তিনি শ্রিকৃষ্নের উপর কবিতা লিখতেন এবং জন্মাষ্টমির সময় মথুরাতে যেতেন। নাসিম দেহলভি এবং তাসলিম লাখনেীভি ছিলেন তার কাব্য উস্তাদ। তিনি হিন্দু নেতা বাল গঙ্গাধর তিলক এর প্রতিও বিশেষ আকর্ষিত ছিলেন।
আলিগড়েই তার রাজনৈতিক জিবনের শুরু। হসরত মোহানী ১৯০৪ সালে ভারতিয় জাতিয় কংগ্রেস এ যোগ দেন। তবে আলিগড়ে থাকতেই তার সহপাঠি মাওলানা মুহাম্মদ আলি জওহর এবং মাওলানা শওকত আলির প্রভাবে হসরত এর মনে মুসলিম স্বাতন্ত্র বিষয়ে নতুন চিন্তা গড়ে উঠে। কংগ্রেস এর সদস্য হিসেবেও হসরত ছিলেন একজন বিপ্লবি মানসিকতার মানুষ। মাত্র বছর তিনেকের মধ্যেই হসরত কংগ্রেস এর ভন্ডামি এবং মুসলিম বিরোধিতা বুঝতে পেরে কংগ্রেস ত্যাগ করেন । হসরত এসময় প্রথম ভারতিয় হিসেবে উপমহাদেশের পুর্নাঙ্গ স্বাধিনতা দাবি করেন।
১৯০৮ সালে হসরত ”উর্দু-ই মুয়াল্লা” নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন লাখনেী থেকে। এই পত্রিকার মাধ্যমে তিনি প্রথম দাবি তুলে ”আযাদী ই কামিল ” অর্থাত পুর্নাঙ্গ স্বাধিনতার। ভারতিয় জনপ্রতিনিধি হওয়ার দাবিদার কংগ্রেস তখনও এই দাবি তুলার সাহস করেনি। এই প্রবন্ধ লিখার অপরাধে তাকে গ্রেফতারকরা হয় এবং দুই বছর এর কারাদন্ড দেওয়া হয়। তার বিশাল বই এর সংগ্রহ সরকার বাজেয়াপ্ত করে এবং নিলাম করে দেয়। এত কিছুর পরেও হসরত তার লক্ষ থেকে বিচুত্য হন নি। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পুনরায় তার বিপ্লবি আন্দোলন অব্যাহত রাখেন তিনি।
উপমহাদেশের স্বাধিনতার জন্য কাজ করতে গিয়ে হসরত চিরজিবন দারিদ্রের মধ্যে কাটান। দেশি কাপড়ের পোষাক পরতেন তিনি সবসময়। লাখনেীতে দেশিয় কাপড় এর একটি দোকান ও খুলেন তিনি। যদিও ব্যবসায় বেশি মনোযাগ দেওয়ার সময় তিনি পেতেন না। তার স্ত্রি বেগম নিশাতুন্নেসা ছিলেন তার যোগ্য সহধর্মিনি। ১৯০৮ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে হসরত মোহানী একাধিকবার দির্ঘ কারাবাস করেন। এই সময় তিনি ভেঙ্গে তো পরেনই নি বরং স্বামিকে সবসময় তার সংগ্রামে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তিনি কারাগারে স্বামি কে চিঠিতে লিখেছিলেন ”সাবধান! সত্য প্রকাশে কখনও প্রানের মায়া করবেন না। আমার জন্য চিন্তা করবেন না। আমি সবরকম এর নিপিড়ন সহ্য করে নেব”। ১৯৩৭ সালে এই মহিয়সি মহিলা ইন্তেকাল করেন।
মাওলানা হসরত মোহানি মুসলিম লিগে যোগ দেন এবং ১৯২১ সালে লিগের বার্ষিক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের পর তিনি পাকিস্তানে না গিয়ে ভারতের মুসলিম দের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে ভারতেই থেকে যান। ভারতিয় গনপরিষদ এর সদস্য নির্বাচিত হন তিনি এবং ভারতের প্রথম সংবিধান রচনার জন্য গঠিত পরিষদ এর সদস্য ও করা হয় তাকে। কিন্তু তিনি এই সংবিধারন সাক্ষর করেননি এই জন্য যে তার মতে এই সংবিধান এ ধর্মনিরপেক্ষতার আড়ালে মুসলিম সহ অন্য সম্প্রদায় কে তাদের ন্যায্য প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
উর্দু কবিতা ও গানের ক্ষেত্রে হসরত মোহানী আধুনিক যুগের সূচনা করেন। তার রচিত গযলগুলি এখনও অতি জনপ্রিয়। এই বিপ্লবি কবি ও আলিম ১৯৫১ সালে ইন্তেকাল করেন। লাখনেীতে তাকে দাফন করা হয়। আমরা এই মহান বিপ্লবি মানুষটির মাগফিরাত কামনা করছি।
বিষয়: বিবিধ
১৬৬০ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার প্রতিভাবান ব্যাক্তির সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়ার জন্য আন্তরিক শুকরিয়া! জাযাকাল্লাহ খাইর!
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
মুসলিম হিসেবে ইসলাম ও মানবতার জন্যে অপুরিশোধ্য অবদান রেখে যাওয়া মহান ব্যক্তিদের জীবনী জানিই না যেন আমরা!
অন্তরিক ধন্যবাদ ও জাযাকাল্লাহ আপনাকে- মহান মানুষদের পরিচয় করিয়ে দেয়ায়!!
আর আহ্। উর্দু! বাঙালীত্বের চাপে আমরা কয়েক শ বছরের সেই ঐতিহ্য হারিয়ে ফেলেছি।
ভালো লাগলো সংগ্রামী মাওলানার জীবনকথা!
অনেক ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন