সভ্য(!) বাঙ্গালির বোঝা!!!
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৪ আগস্ট, ২০১৫, ১০:১২:৪৫ রাত
"হোয়াইটস ম্যানস বার্ডেন"
শব্দটা আরো আগে থেকে ব্যবহৃত হলেও ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদি সাহিত্যিক রুডইয়ার্ড কিপলিং এর একটি কবিতা থেকেই বেশি জনপ্রিয় হয়। এই বাক্যের আভিধানিক অর্থ দাড়ায় "সাদা মানুষের বোঝা"। এই বাক্যটি আসলে ব্যবহৃত হয় ইউরোপবাসি সাদা চামড়ার তথাকথিত সভ্য(!) মানুষগুলির সাম্রাজ্যবাদ কে বৈধ করার উদ্দেশ্যে। এই সাম্রাজ্যবাদিরা নিজেদের দেশের সাধারন মানুষদের বুঝাতেন যে আফ্রিকা ও এশিয়ায় তারা সাম্রাজ্য বিস্তার করছেন শুধু এই এশিয়া ও আফ্রিকার অসভ্য(!) মানুষগুলিকে সভ্য করে তুলার উদ্দেশ্যে। একই কথা অবশ্য তারা এই দেশিয় দের ও বুঝাতে যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন এবং এখনও করছেন। তাদের উদ্দেশ্য এতই নিস্বার্থ যে এটা তাদের জন্য বারডেন বা বোঝা! শুধু মাত্র শ্বেতাঙ্গদের বোঝা হালকা করার জন্য তারা আফ্রিকার লক্ষলক্ষ কালো মানুষ কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্রিতদাস হিসেবে চালান দিচ্ছেন। বিপুল সম্পদ সম্বৃদ্ধ ভারতবর্ষ থেকে কোটি কোটি টাকা অর্থ আহরন করছেন। ধ্বংস করছেন মালয় ও ইন্দোনেশিয়ার সম্বৃদ্ধ বনাঞ্চল। এই সব অপকর্ম তারা করছেন কেবল মাত্র হোয়াইট ম্যানস বার্ডেন এর জন্য। না হলে যে এরা সভ্য হবেনা!!!
সাবেক আইসিএস অফিসার এবং ইতিহাসবিদ স্যার পেন্ডেরেল মুন লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হিসেবে তাদের কাছে আইসিএস বা ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস এ যোগ দেওয়ার আহবান আসে "সাদা মানুষের বোঝা" এই যুক্তিতে। ভারতবর্ষ সম্পর্কে তিনি নিজের মনে অনেক পরিকল্পনা তৈরি করেন। তার ধারনায় তখন ভারতিয় মাত্রই অসভ্য! আইসিএস উত্তির্ন হয়ে যখন তিনি ব্রিফিং এর জন্য যান তখন উচ্চ কর্মকর্তারা তাকে সোজা ভাষায় যা বুঝান সেটা হচ্ছে ভারতিয়দের সভ্যতা বা গনতন্ত্র শিখান ভারতে বৃটিশ আইসিএস দের লক্ষ নয়। তাদের দরকার ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের কোটি কোটি পাউন্ড বিনিয়োগ এবং আয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা! পেন্ডেরেল মুন কে সত্য বললেও এরা ভারতবাসিকে কখনই সত্য বলতেন না এবং দুঃখটা এই যে আমাদের দেশে এখনও সেই বৃটিশ বিনিয়োগ রক্ষার আইনগুলিই চলছে আর আমাদের প্রসাশন এর উচ্চশিক্ষিত(!) কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশরা সেই আইনের প্রশংসায় গলা ভেঙ্গে ফেলছেন।
কিন্তু আজকে যে নতুন সংবাদ শুনলাম তাতে মনে হয় ২০০ বছর সময় শাসন করে ভারতিয় তথা বাংলাদেশিদের সভ্য(!) করে তুলতে পারলেও এর বেশি সময় ধরে শাসন করেও তারা আফ্রিকান দের সভ্য করতে পারেনি। সম্ভবত বোঝা বইতে বইতে তারা এখন এত ক্লান্ত হয়ে গেছেন যে এই দায়িত্ব তারা এখন বাঙ্গালির কাঁধে তুলে দিয়েছেন। যে উদ্দেশ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনি কঙ্গো, কোট ডি ভয় তথা আইভরি কোষ্ট বা সিয়েরা লিওন এ নিযুক্ত হয়েছে। শান্তিরক্ষা নয় বরং তারা তাদের সভ্য করতে গিয়েছে!!
কথাটি কোন সাধারন মানুষের নয়। খোদ বাংলাদেশ জাতিয় সংসদ এর একজন সদস্যের যিনি সরকারি প্রতিনিধি হয়ে আফ্রিকার কঙ্গো ও কোটডি ভয় পরিদর্শন করে এসেছেন। তার মতে আফ্রিকান অসভ্যরা (!) নাকি ১৫ দিনে একবার গোসল করে। তারা নাকি ইংরেজি বলতে পারেনা। তাদের সভ্যতা শিখাচ্ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনি। ভাগ্য ভাল ফ্রান্সে জাননি তাহলে হয়তো তারা ইংরেজি জানেনা তাই অশিক্ষিত ধরে বসতেন! সাংবাদিক দের সামনে তিনি অবলিলাতেই উচ্চারন করে গেলেন ওরা নাকি কালো মানুষ! এই মানুষটি বারাক ওবামার সামনে কি বলবেন সেটা বিবেচনার ভার পাঠক দের উপরই দিলাম।
আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষার মিশনে গিয়েছেন বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনির যে সকল সদস্য তাদের মধ্যে অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতার বিবরন দিয়ে বই লিখেছেন। আমার ব্যাক্তিগত একাধিক বন্ধু ও পরিচিত মানুষের কাছেও শুনেছি এই মিশন গুলির অম্লমধুর অভিজ্ঞতার কথা। মধ্য আফ্রিকার এই অঞ্চলগুলিতে যথেষ্ট অভাব আছে ব্যবহারযোগ্য পানির । মিশনে পর্যাপ্ত পানির অভাবে তারা অনেকে সপ্তাহে এক-দুই বারের বেশি গোসল করতেন না। ৫ তারা হোটেলে থেকে পরিদর্শন করে আসা এই মানুষটি কি সেই মিশন এর সদস্য বা আফ্রিকার অধিবাসিদের সম্পর্কে বুঝতে চেয়েছেন?
মিশরিয় সভ্যতা তে বলা হয় বিশ্বের সবচেয়ে প্রাচিন সভ্যতা। এই সভ্যতা দক্ষিন আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে যথেষ্ট প্রমান আছে। যিম্বো নামে একটি নগরি বর্তমান যিম্বাবুয়ে তে অবস্থিত ছিল হযরত সুলাইমান (আঃ) এর সময়ে। বিখ্যাত শেবা এর রানি বিলকিস এর রাজ্য ও আফ্রিকায় অবস্থিত ছিল বলে অনেক ঐতিহাসিক এর মত। আফ্রিকার কালো অরন্যের মধ্যে এখন আবিস্কৃত হয় প্রাচিন শহরের ধ্বংসাবশেষ। এই অফ্রিকা জন্ম দিয়েছে নেলসন ম্যানডেলার। তার আত্মজিবনি "লং ওয়াক টু ফ্রিডম" এ বিস্তারিত বিবরন দেওয়া আছে কিভাবে তথাকথিত সভ্যতার নামে শোষন করা হয়েছে আফ্রিকাকে।
ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদ আর বর্ণবাদিতাকে বোধহয় আমরা এখন নিজের করে নিচ্ছি। দেশরক্ষায় নিয়োজিত সেনাবাহিনি কারো ভাড়াটে হয়ে যাচ্ছে আফ্রিকায় সভ্যতা শিখাতে। "সাদা মানুষের বোঝা" কি এখন হতে যাচ্ছে "সভ্য(!) রাবিন্দ্রিক বাঙ্গালির বোঝা"? হ্যাঁ আমরা এখন অনেক সভ্য। এখানে এক কিশোর কি পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। দিনেরপর দিন বিনা অপরাধে জেল খাটেন নির্দোষ। রাস্তা ঘাটে পুলিশ বিনা কারনে আক্রমন করে মানুষকে। সুতারাং সাম্রাজ্যবাদি সঙ্গায় আমরা সভ্যই বটে!!
কোন একদিন হয়ত ইংরেজ সাহিত্যিক জেরোম কে জেরোম এর মত কোন বাংলাদেশি সাহিত্যিক কেও বলতে হবে "বার্ডেন টা যদি অত হেভি ই হয় তবে ওটা বইছিস কেন? আমি তো খবর পেয়েছি, ইন্ডিয়ানরা সেই সেবা,সেই হোলি ক্রুসেড এর জন্য থ্যান্কু-টি পর্যন্ত বলে না। তবে ফেলে আয় না বোঝাটা তাদের ই ঘাড়ে"!!!
* জেরম কে জেরম এর উদ্ধৃতিটি সৈয়দ মুজতবা আলির "পঞ্চতন্ত্র" থেকে নেওয়া।
** আফ্রিকার শান্তি মিশনে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনির অবদান সম্পর্কে জানতে এই বইগুলি পড়তে পারেন।
১.সাদা কাক ও কালো মানুষের গল্প- কর্নেল জি র মোহাম্মদ আশরাফউদ্দিন। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্স।
২.আমার দেখা আফ্রিকা-কর্নেল মো. ফরিদউদ্দিন। ঐতিহ্য প্রকাশনি।
বিষয়: বিবিধ
১৪২১ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো @সবুজ ভাই। সুন্দর লিখেছেন।
শুকরিয়া।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ মূল্যবান লিখাটার জন্য
বোধহয় ওখানে উপযুক্ত মাল না পেয়ে এয়ারপোর্টে নামা মাত্র টেনে এসে এই সব কথা বলেছেন।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ।
পুরো প্রতিবেদনটাই একটি সেরা প্রতিবেদন।
ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজী শেখার প্রতি প্রচন্ড আগ্রহ পরিলক্ষিত হচ্ছে বেশ কিছুদিন ধরেই। এটা গোলামী মনস্ক চিন্তা চেতনা থেকেই সৃষ্ট। এই ইংরেজী শেখার একটাই উদ্দেশ্য ইংরেজের অধিনে কিংবা তাদের সাংস্কৃতির কারো অধিনে একটি চাকুরী জুটানোর জন্যই।
ইউরোপের বহু দেশেই ইংরেজীকে কিভাবে ঘৃনা করে সেটা যদি আমাদের দেশের মানুষ দেখত, তাহলে কতই না ভাল হত। বলছি না ইংরেজী খারাপ, বলছি মানুষের মনোবৃত্তি নিয়ে। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা বলল আফ্রিকার ওরা অসভ্য কেনান তারা ইংরেজী জানেনা কিন্তু এই ব্যক্তি চিত্তে ও চরিত্রে যে একজন জানোয়ার এই কথাটা তাকে কে বুঝিয়ে দেবে। অনেক ধন্যবাদ
এই মানসিকতা আমাদের মধ্যে খুবই গভির। ইংরেজি না জানলেই সে যেন শিক্ষিত নয়। আমাদের মধ্যে শিক্ষিতদের আচরন এমনই। জাপান-কোরিয়ায় বিশ্বকাপ ফুটবল চলার সময় এক সাংবাদিক অতি গর্বর(!) সাথে লিখেছিলেন যে কোরিয়ায় সেচ্ছাসেবক হিসেবে কর্মরত এক বাংলাদেশির ইংরেজি উচ্চারন নাকি কোরিয়ানেরে ভুল ইংরেজির ভিড়ে সেক্সপিয়ার এর প্রতিনিধিত্ব করছে! এই সাংবাদিক এটা ভুলে গিয়েছিলেন ভুল ইংরেজি বলে কোরিয়ান রা বিশ্বকাপ আয়োজন করছে এবং সেই বিশ্বকাপ এ সেমিফাইনাল খেলছে।
এত কথা আপনি পান কোথা থেকে?
অনেক কিছুই জানলাম, সুন্দর পোষ্টটির জন্য শুকরিয়া।
আপনাকেও ধন্যবাদ।
আপনাদের পোষ্ট ও মন্তব্য থেকে এত কথা পাই।
আপনি রবী ঠাকুরের কবিতাটা উদ্ধৃত করতে পারলে দারুণ হতো!
সাড়ে সাত কোটি বাঙগালিরে জন্ম দিয়েছ. মানুষ করনি!!
হা হা হা ...
মানে আমি নিজেকে তো মানুষ বলেই মনে করি তাই ওই কবিতাটা বাদ দিছি!!
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন