হুদায়বিয়ার সন্ধি। আল্লাহতায়লার দেয়া সুস্পষ্ট বিজয় পর্ব-৩(শেষ পর্ব)
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০১ জানুয়ারি, ২০১৫, ০২:৩৯:৫৮ দুপুর
শেষ পর্ব (হুদায়বিয়ার সন্ধির ফলাফল এবং প্রতিক্রিয়া)
১ম পর্ব
২য় পর্ব
ষষ্ঠ হিজরিতে হুদায়বিয়ার সন্ধির পূর্ব পর্যন্ত মদিনার বাইরে এবং এর অভ্যন্তরেও ইসলাম এর প্রচার কম হয়েছিল। কারন মদিনাকে কেন্দ্র করে যে ইসলামি রাষ্ট্র কায়েম হয়েছিল তা বাইরের আক্রমন এবং মুনাফিকদের আভ্যন্তরিন ষড়যন্ত্র্রের কারনে আত্মরক্ষার জন্যই ব্যাস্ত ছিল। বিশেষ করে মদিনার ইহুদিরা বিভিন্ন ষড়যন্ত্র করে সবসময়ই গোলমাল বাধিয়ে রাখার চেষ্টা করত। অন্যদিকে মক্কা থেকে বহু দুরে অবস্থান এর কারনে হজ্জ উপলক্ষে মক্কায় সমবেত হওয়া মানুষদের ইসলামের দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল বরং কুরাইশ রাই বিরুপ প্রচারনার সুযোগ পাচ্ছিল। কুরাইশ দের প্রভাব এর কারনে অন্য কোন গোত্র ও সহজে ইসলাম গ্রহন করছিলনা বা ইচ্ছা থাকলেও সেটা প্রকাশ করছিলনা। হুদায়বিয়ার সন্ধি সকল ধরনের সমস্যা থেকে মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র কে মুক্ত করে। যে কারনে মাত্র দুইবছর পর মক্কা সহ আরব উপদ্বিপ এর অধিকাংশ ইসলামের ছায়াতলে চলে আসে।
হুদায়বিয়ার সন্ধির মাধ্যমে কাফিররা মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র কে স্বিকৃতি দেয়। পরের বছর বায়তুল্লাহ জিয়ারত করার সুযোগ দেওয়ার অঙ্গিকারের মাধ্যমে তারা বায়তুল্লাহর উপর মুসলিমদের অধিকার এর ও স্বিকৃতি দেয়। এই স্বিকৃতি মদিনার ইসলামি রাষ্ট্রকে অন্য গোত্র ও রাষ্ট্রগুলির কাছে একটি স্বাধিন রাষ্ট্রের মর্যাদায় উপনিত করে। সমসাময়িক দুই পরাশক্তি রোম তথা বাইজানটাইন এবং ইরান এর সরকার এই সময় থেকেই মদিনার এই ইসলামি রাষ্ট্র সম্পর্কে খবর নিতে শুরু করে। এই স্বিকৃতি থাকায় রাসুল (সাঃ) হুদায়বিয়ার সন্ধির পরপরই তৎকালিন বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান দের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে চিঠি প্রেরন করেন।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পরেই রাসুল (সাঃ) তৎকালিন বিশ্বের দুই পরাশক্তি রোম এবং ইরান সাম্রাজ্যের প্রধান যথাক্রমে কাইজার হিরাক্লিয়াস এবং কিসরা খসরু পারভেজ এর কাছে ইসলাম এর দাওয়াত দিয়ে চিঠি প্রেরন করেন। কাইজার চিঠি গ্রহন করলেও ইসলাম গ্রহন করেননি অন্যদিকে খসরু চিঠি ছিড়ে ফেলে রাসুল(সাঃ) কে গ্রেফতার এর জন্য নির্দেশ দেন। কিন্তু এই আদেশ পালিত হওয়ার বদলে কিসরা নিজেই রোম এর সাথে যুদ্ধে পরাজিত হন এবং নিজ পুত্রের ষড়যন্ত্রে মৃত্যুবরন করেন। হুদায়বিয়ার সন্ধির কারনে যুদ্ধের অবকাশ থাকায় এবং রাষ্ট্র হিসেবে আরব অঞ্চলে স্বিকৃতি পাওয়ায় এই দাওয়াত প্রেরন সম্ভব হয়। হাবশা তথা আবিসিনিয়ার বাদশাহ নাজ্জাশি ও ইসলাম গ্রহন করেন। মিসর এবং আম্মান এর শাসকদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়। মিসর এর শাসক ইসলাম গ্রহন না করলেও মদিনাকে স্বিকৃতি দেন এবং রাসুল(সাঃ) এর জন্য উপহার প্রেরন করেন।
দশ বছর যুদ্ধবিগ্রহ না করার অঙ্গিকার এর মাধ্যমে ইসলাম প্রচার এর যে সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং কুরাইশ বংশিয় কাফিরদের মধ্যেও চিন্তার যে সময় ও সুযোগ হয় তার প্রথম দফাতেই কুরাইশদের নেতৃস্থানিয় তিনজন এবং যারা ছিলেন সেসময় এর শ্রেষ্ঠ তম যোদ্ধা হযরত খালিদ বিন ওয়ালিদ(রাঃ),হযরত আমর বিন আল আস(রাঃ) এবং হযরত উসমান বিন তালহা (রাঃ) ইসলাম গ্রহন করেন। এরা তিনজনই ছিলেন বদর যুদ্ধে বিখ্যাত কুরাইশ বির দের মৃত্যুর পর কুরাইশ দের অবশিষ্ট শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। এরা একই সাথে জ্ঞানি ও প্রাজ্ঞ ব্যাক্তি ও ছিলেন। রাসুল (সাঃ) হিজরত এর পর বারবার যুদ্ধের কারনে এরা চিন্তাভাবনার অবকাশ পাচ্ছিলেননা। এখন যুদ্ধ বন্ধ থাকায় এরা চিন্তাভাবনার সুযোগ পান এবং আল্লাহতায়লা তাদের অন্তর এর পরিবর্তন করে দেন এবং তারা রাসুল(সাঃ) এর দাওয়াত এর সত্যতা বুঝতে পারেন। খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) ইসলাম গ্রহন এর জন্য মক্কা থেকে মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়না করেন তিনি মদিনার নিকটে আমর বিন আল আস(রাঃ) এবং উসমান বিন তালহা(রাঃ) এর দেখা পান। আমর বিন আল আস(রাঃ) এর প্রশ্নের উত্তরে তিনি সুস্পষ্ট ভাবে বলেন যে তিনি নিশ্চিত মুহাম্মদ(সাঃ) আল্লাহর রাসুল সুতারাং অযথা কোন যিদের বশবর্তি হয়ে তার বিরোধিতা করার মানে নাই। এরা রাসুল (সাঃ) সকাশে উপস্থিত হয়ে ইসলাম গ্রহন করলে রাসুল (সাঃ) বলেন যে মক্কা তার তিন কলিজার টুকরাকে আমার হাতে তুলে দিয়েছে। এদের অবর্তমানে মক্কায় যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ার মত মানুষ আর বিশেষ কেউ ছিলনা।
চুক্তির তৃত্য়ি শর্ত অনুসারে আরবের অন্যান্য গোত্রগুলি যখন মুসলিমদের সাথে সম্পর্ক রাখা ও না রাখার ক্ষেত্রে স্বাধিন হয়ে গেল তখন তারা মদিনায় আসতে এবং ইসলাম কে জানতে আগ্রহি হয়ে উঠে। রাসুল (সাঃ) ও বিভিন্ন গোত্রের কাছে ইসলামের দাওয়াত দিয়ে প্রতিনিধি প্রেরন করেন। অনেকেই এই সময় ইসলাম গ্রহন করে যারা করেনি তারাও নিরবতা বা নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে।
এই চুক্তির ফলে যে অবকাশ পাওয়া যায় সেই সময় মদিনা থেকে বহিস্কৃত খায়বর এর অবস্থান কারি ইহুদিদের ষড়যন্ত্রের মূলউৎপাটন করা হয়। এতদিন যে ইহুদিরা কুরাইশদের বিভিন্ন ভাবে উস্কানি দিচ্ছিল এই চুক্তির কারনে সেই কুরাইশরা তাদের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করেননি বা তাদের কোন সহযোগিতাও করেনি। এর ফলে মদিনা সকল ধরনের আভ্যন্তরিন হুমকি থেকে মুক্ত হয়ে যায়।
এই চুক্তি একটি বিশেষ শিক্ষা হচ্ছে যুদ্ধ করার সময় দুরদর্শিতার গুরুত্ব এবং যুদ্ধ করে বিজয়ি হওয়ার ইচ্ছার পরিবর্তে শান্তির সাথে সমস্যার সমাধান এর সুযোগকে প্রাধান্য দেওয়া। মক্কা যেরকম নিরপত্তাহিন ভাবে রাসুল (সাঃ) এর আক্রমনের মুখে পড়েছিল সেই অবস্থায় যে কোন সামরিক নেতা মক্কা দখল এর সুযোগ ছাড়তেন না। কিন্তু রাসুল(সাঃ) তো শুধু বিজয় বা প্রতিশোধ নেওয়ার উদ্দেশ্যে কখনও অভিযান করেননি। তাই তিনি বারবার আলোচনার জন্য চেষ্টা করেছেন এবং শেষ পর্যন্ত সন্ধিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। যার ফলে ইসলাম এরও বিজয় প্রকৃতপক্ষে তরান্বিত হয়েছিল।
হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে বাইয়াতে রিজোয়ান এর শপথ ও ছিল আল্লাহতায়লার পক্ষ থেকে একটি পরিক্ষা। যুদ্ধের জন্য প্রস্তত না থাকা সত্বেয় হযরত উসমান (রাঃ) এর হত্যার সংবাদে একজন মুনাফিক ছাড়া রাসুল (সাঃ) এর সকল সঙ্গি তার সাথে যুদ্ধের ময়দানে সর্বাবস্থায় উপস্থিত থাকার অঙ্গিকার এর মাধ্যমে যে ঈমান ও আস্থার পরিচয় দেয় সেটাই যে আসলে মুসলিম জাতির আসল শক্তি সেটাই এর মধ্যে প্রমানিত। এই কারনে আল্লাহতায়লা স্বয়ং শপথকারিদের প্রতি তার সন্তষ্টির কথা কুরআনে ইরশাদ করেছেন। সকল যুগের মুসলিমদের জন্যই এই ঘটনায় শিক্ষা রয়েছে।
হুদায়বিয়ার সন্ধির আরেকটি ছোট্ট সামাজিক ও পারিবারিক শিক্ষা হচ্ছে যখন রাসুল (সাঃ) সন্ধি সাক্ষরিত হওয়ার পরে যখন মুসলিমদের কুরবানি করতে এবং চুল কামাতে নির্দেশ দিলেন অর্থাত ইহরাম ছাড়ার পর যা করতে হয়। তখন পরপর তিনবার এই নির্দেশ দেওয়ার পরও কেউ উঠল না। এটি এই জন্য নয় যে তাদের মধ্যে আল্লাহর রাসুল(সাঃ) এর নির্দেশ অমান্য করার প্রবনতা দেখা দিয়েছিল। বরং চুক্তির বাহ্যিক ফল এর কারনে তারা দুঃখিত হয়ে ছিলেন। এই সময় রাসুল(সাঃ) নিজে সিদ্ধান্ত নেননি বা আল্লাহর ওহির ও অপেক্ষা করেননি। তিনি তার স্ত্রি উম্মুল মুমিনিন উম্মে সালামা (রাঃ) এর কাছে অবস্থা ব্যাক্ত করেন এবং তারই পরামর্শ মতে কাজ করেন। এটি একটি বড় শিক্ষা আমাদের জন্য। যে প্রয়োজন মনে করলে অন্য কোন বিষয়ে স্ত্রির কাছে পরামর্শ চাওয়া যায়। এই কাজের মাধ্যমে রাসুল(সাঃ) নারিদের যে উচ্চ মর্যাদায় ভুষিত করলেন তার প্রমান বিশ্বের ইতিহাসে আর নাই।
হুদায়বিয়ার সন্ধির পরই আল্লাহতায়লা পবিত্র কুরআন এর সূরা আল ফাতহ যার অর্থ বিজয় সূরার এই সংক্রান্ত আয়াতগুলি নাজিল করেন। যা মুসলিম দের দুঃখ দূর করে দেয়। আল্লাহতায়লা মুসলিমদের বিজয় এর যে ওয়াদা করেছিলেন মাত্র তিন বছরের মধ্যেই তা প্রমানিত হয়ে যায়। অষ্টম হিজরিতে কুরাইশদের মিত্র গোত্র বনু বকর এই চুক্তি শর্ত ভঙ্গ করলে আল্লাহর রাসুল(সাঃ) মক্কায় অভিযান করেন। এই অভিযানের সময় কুরাইশদের নেতৃত্ব দেওয়ার মত কেউ আর অবশিষ্ট ছিলনা। যার কারনে বিনা যুদ্ধেই মক্কা বিজয় হয় এবং ইসলাম এর পুর্ণ প্রতিষ্ঠা হয়। হুদায়বিয়ার সন্ধির আগে কোন যুদ্ধেই হাজার খানেক এর বেশি মুজাহিদ মুসলিম বাহিনি পক্ষে হাজির হয়নি কিন্তু মাত্র দুই বছর সময়ে ইসলাম এ্তই বিস্তৃতি লাভ করে যে মক্কা অভিযানের সময় দশহাজার মুজাহিদ অংশ গ্রহন করে। ইসলামি রাষ্ট্রের স্বিকৃতি এবং এর বিস্তৃতি উভয়ই হুদায়বিয়ার সন্ধি থেকে লাভ হয়েছিল।
হুদায়বিয়ার সন্ধি কেবল ইসলামের ইতিহাস নয় বরং পৃথিবির ইতিহাসের একটি গুরুত্বপুর্ন ঘটনা বা মাইলষ্টোন হিসেবে ধরা হয়। মানবজাতির ইতিহাসে সবচেয়ে শান্তিুপুর্ন এবং মানবিক শাসন ও সমাজ ব্যবস্থার সূচনা করে এই চুক্তি।
হুদায়বিয়ার সন্ধি তাই কেবল মুসলিম নয় বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই আল্লাহতায়রার প্রদত্ত একটি নিয়ামত সরুপ।
তথ্য সূত্র-
সহিহ বুখারি সহ হাদিস সংকলন।
আর রাহিকুল মাখতুম-ছফিউর রহমান মোবারকপুরি।
ইসলামে প্রতিরক্ষা কেীশল-মেজর জেনারেল(অবঃ) আকবর খান।
খালিদ বিন ওয়ালিদ(রাঃ) -মেজর জেনারেল(অবঃ) আকবর খান।
বিষয়: বিবিধ
২৪৫৫ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
"হতাশ হয়ো না, যদি মুমিন হও"।
এই চুক্তি এবং এর ঘটনার মধ্যে মুসলিমদের জন্য রয়েছে অনেব শিক্ষা।
আর মক্কার তিন প্রধান বীরের ইসলাম গ্রহণই প্রমাণ করছে হুদায়বিয়ার সন্ধির অন্তরনিহিত তাৎপর্য্য। আরেকটি বিষয় হচ্ছে কোন দরকারী বিষয়ে স্ত্রী সাথে পরামর্শ করার মধ্য দিয়ে স্ত্রীদের মতামতের গুরুত্ব এবং নারীর স্বকীয়তার স্বীকৃতি দিয়েছেন মুহাম্মাদ (সাঃ)।
শেষ কথা হচ্ছে- আমাদের দেশে বর্তমান ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের উপর জুলুমবাজ স্বৈরাচারীর যে নিপীড়ন চলছে, তার বিরুদ্ধে বাবলা গাছের তলায় নেওয়া শপতের মতো এদেশেও একটি শপতের ডাক কখন আসবে? আল্লাহ এদেশেও ইসলামী আন্দোলনকে সফলতা দান করুন। আপনাকে উত্তম প্রতিদান দিক।
আমরা কেউ এখন সেই শপথ এর বাইরে নই। আমাদের কাজ দিয়েই প্রমান করতে হবে আমরা কি আল্লাহর সন্তষ্টি চাই না আল্লাহ আর তার রাসুল কে ত্যাগ করে প্রবৃত্তির অনুগামি হবো।
অনেব ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
হুদায়বিয়ার সন্ধি তাই কেবল মুসলিম নয় বরং সমগ্র মানবজাতির জন্যই আল্লাহতায়রার প্রদত্ত একটি নিয়ামত সরুপ।আসলেই তাই পরিস্কার ভাবে বুঝতে পারলাম আপনার লেখাগুলো থেকে ।
অনেক অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া ।
একজনও যদি উপকৃত হয় আমার পরিশ্রম সার্থক। ভিশু ভাই ও এই ধন্যবাদ এর দাবিদার। এই বিষয়টি অত্যন্ত শিক্ষনিয় একটি বিষয়।
মঙ্গলময় সর্বাবস্থায় আপনাকে ভালো ও সুস্থ রাখুন দোয়া রইলো।
আপনার মন্তব্য আমাকে অনেক উৎসাহিত করল।
দুয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমিন।
হুদায়বিয়ার সন্ধিতে শিক্ষার জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে।
সবগুলি পর্ব পড়লেই এর বক্তব্য পরিস্কার হবে।
আশাকরি ভালো লেগেছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন