হুদায়বিয়ার সন্ধি। আল্লাহতায়লার দেয়া সুস্পষ্ট বিজয় পর্ব-২
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৪, ০৩:৪১:৪৮ দুপুর
পর্ব-২(সন্ধির বিশ্লেষন এবং পটভুমি)
হুদায়বিয়ার সন্ধির শর্তাবলি দেখলে প্রথম দৃষ্টিতে মনে হবে এটা মুসলিমদের পরাজয় ছিল। কারন মুসলিম রা যে উদ্দেশ্যে মক্কার দিকে রওয়ানা হয়েছিল সেই উমরাহ করার উদ্দেশ্য পুরন হয়নি। অন্যদিকে কোন মক্কাবাসি ইসলাম গ্রহন এর জন্য অত্যাচার এর মুখোমুখি হলে তারা মদিনায় আশ্রয় লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলো। কিন্তু একটু ভালভাবে দেখলে বুঝা যায় এই চুক্তি আসলেই ছিল মুমিনদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ”সুস্পষ্ট বিজয়”।
প্রথমত এই চুক্তি করার মাধ্যমে কাফির রা রাসুল (সাঃ) এর নেতৃত্ব এবং মদিনায় প্রতিষ্ঠিত সরকার কে স্বিকৃতি দেয়। যা এতদিন তারা দেয়নি।তারা মুহাজির মুসলিমদের যেখানে স্রেফ অপরাধি বা পলাতক মনে করত এখন তাদের কে সমমর্যাদার বলে স্বিকৃতি দিতে বাধ্য হলো। এই স্বিকৃতি আরবের অন্য অঞ্চল এর গোত্রগুলির কুরাইশ দের স্বার্থে মুসলিমদের বিরোধিতার অবসান ঘটায়।
এই চুক্তির প্রথম দফাটি দেখলে মনে হয় এটা কুরাইশ দের সাফল্য। এটি সত্যিই তাদের সাফল্য ছিল কিন্তু সেটা নিরর্থক একটি বিজয়। এই সাময়িক বিজয় এর বিনিময়ে তারা মুমিনদের তিনটি সুবিধা দিতে বাধ্য হয়েছে। তারা রাসুল (সাঃ) সহ মুমিনদের মাত্র এক বছর এর জন্য তাদের উমরাহ তে দেরি করাতে পেরেছে এবং এটাও স্বিকার করেছে পরের বছর বিনা বাধায় তাদের উমরাহ পালন করতে দেয়া হবে। এটি প্রকৃতপক্ষে তাদের একটি পরাজয় কারন তারা কাবা শরিফ এর রক্ষক হিসেবে মুসলিমদের এর থেকে দুরে রাখার চেষ্টা করত অথচ এখন তারা নিজেরাই সেই সুযোগ দিতে স্বিকৃত হলো।
চুক্তির দ্বিতিয় দফা টিও ছিল মুসলিম দের জন্য একটি বড় সুবিধা। এই দফার মাধ্যমে দশ বছর এর জন্য শান্তি ও নিরাপত্তা ঘোষিত হয়। মুসলিম দের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সূচনা কাফিররাই করেছিল এখন তারাই এই শান্তির জন্য রাজি হয়ে পূর্ববর্তি যুদ্ধ সমূহে তাদের পরাজয় কে স্বিকার করে নেয়। এই দফাটির কারনে তখনও মুসলিম হননি এমন কিছু কুরাইশ নেতৃবৃন্দ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং পরিনিতিতে মক্কা বিজয় এর সময় কুরাইশরা নেতৃত্বহিন হয়ে যায়।
তৃত্য়ি দফাটি ছিল রাজনৈতিক ভাবে অত্যন্ত গূরুত্বপুর্ন একটি বিজয়। এতদিন কুরাইশরা আরবের নেতৃস্থানিয় গোত্র হিসেবে অন্যান্য গোত্রগুলিকে মুসলিম বিরোধিতায় উৎসাহ দিত এবং বাধ্য করত। এই দফাটির মাধ্যমে মুসলিমদের সাথে অন্য গোত্র গুলির সম্পর্কের অধিকার দেয়া হলো এবং মুসলিমদের ব্যবসা বানিজ্য বিস্তার এর সুযোগ দেয়া হলো। অন্য সকল গোত্রের নেতৃত্বের যে আসনে কুরাইশরা এতদিন ছিল এই দফাটি মেনে নিয়ে তারা নিজেদের সেই অধিকার থেকে সরে এল। এর মাধ্যমে যেই ইচ্ছা করুক ইসলাম গ্রহন করতে পারবে বলে তারা স্বিকৃতি দিল এবং এই ব্যাপারে তারা কোন হস্তক্ষেপ না করার ওয়াদা করল।
শেষ দফাটি দেখলে মনে হবে এটি মুসলিমদের জন্য অসুবিধা ও অপমানজনক একটি দফা। কারন এতে কোন মুসলিম মক্কা থেকে মদিনায় আশ্রয় নিতে পারবেনা বলা হয়েছিল কিন্তু মদিনা থেকে কেউ ইচ্ছা করলেই মক্কায় আশ্রয় গ্রহন করতে পারবে বলে স্বিকার করা হয়েছিল। আসলে এটি ছিল পরিপূর্ন ভাবে মুসলিমদের পক্ষে একটি শর্ত। মদিনা থেকে মক্কায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহন করতে পারত শুধু তারাই যারা মুনাফিক বা মুরতাদ। এই মুনাফিক ও মুরতাদদের কোনই প্রয়োজন ইসলামের ছিলনা। তাই তারা যদি মক্কায় চলে যায় তাহলে বরং মুনাফিকদের ষড়যন্ত্র হতে মদিনার ইসলামি রাষ্ট্র মুক্ত থাকলো। অর্থাত তাদের চলে যাওয়াই ছিল কল্যানকর। অন্যদিকে মক্কার কোন মুসলিমকে মদিনায় আশ্রয় নিলে ফেরত পাঠানর শর্ত কষ্টকর হলেও ছিল কল্যানকর। কারন যে সত্যিই ইসলাম ধর্ম গ্রহন করবে তাকে আটক রেখে বা অত্যাচার করে ইসলামের বিপক্ষে নেওয়া কখনই সম্ভব হবেনা। বরং এর ফলে তার প্রতি এবং ইসলাম এর প্রতি অন্যদের সহানুভুতি বৃদ্ধি পাবে। এছাড়া এই চুক্তির বড় ফাক ছিল যে এই মুসলিমরা মদিনা ব্যাতিত অন্য কোথাও আশ্রয় নিলে তাদের কর্মকান্ডের দায় হতে মুসলিমরা ছিল মুক্ত। এই ধারাটিও প্রকৃতপক্ষে ইসলামের জন্য কল্যানকর ই হয়েছিল। এই চুক্তির পর আবু বাছির সাকাফি মদিনায় আশ্রয় নিতে এলে কুরাইশ রা তাকে ফেরত চায়। রাসুল (সাঃ) চুক্তি মোতাবেক তাকে ফেরত পাঠান। কিন্তু মাঝপথে তিনি কুরাইশ প্রহরিদের হত্যা করে পালিয়ে যান। তিনি সমুদ্র উপকূল এর কাছে কুরাইশদের সিরিয়া গামি বানিজ্য কাফেলার পথের পাশে লুকিয়ে থাকেন। মক্কা থেকে আবু জানদাল বিন সুহাইল সহ আরো বেশ কয়েকজন মুসলিম পালিয়ে গিয়ে তার সাথে মিলিত হন। তারা সেখানে ঘাঁটি তৈরি করেন এবং কুরইশদের সিরিয়াগামি বানিজ্য কাফিলার উপর আক্রমন ও লুট করতে থাকেন। তারা কুরাইশ দের জন্য প্রচন্ড ক্ষতির কারন হয়ে যান অথচ চুক্তি অনুসারে তাদের কর্মের জন্য কোন দায় আল্লাহার রাসুল মুহাম্মদ(সঃ) ও তার সরকারের ছিলনা। এই অবস্থায় শেষ পর্যন্ত কুরাইশ রাই রাসুল (সাঃ) কে এই অনুরোধ করে যে তিনি যেন তাদের মদিনায় ডেকে নেন। এবং তারা নিজেরাই চুক্তির এই অংশটি পরিবর্তন করে যে এরপর মক্কার কেউ ইসলাম গ্রহন করে মদিনাতে গেলে তারা কোন আপত্তি করবেনা।
হুদায়বিয়ার সন্ধি এই ভাবে আল্লাহতায়লার প্রদত্ত ”সুস্পষ্ট বিজয়” হিসেবে পরিগনিত হয়। অথচ হযরত উমর (রাঃ) এর মত মানুষ ও চুক্তি সম্পাদন এর পর এই চুক্তির ফলাফল নিয়ে সংশয় ও বিষাদগ্রস্ত ছিলেন। তিনি রাসুল(সাঃ) এর কাছে গিয়ে তার মনের কথা জানান এবং এটাও প্রশ্ন করেন যে রাসুল (সাঃ) নিজে যেখানে কাবা শরিফ জিয়ারত এর সপ্ন দেখেছেন সেখানে তারা উমরাহ করতে পারলেন না কেন। রাসুল (সাঃ) জবাব দেন যে তিনি সপ্নে কাবা শরিফ জিয়ারত করতে দেখেছেন কিন্তু সেই বছরই এটা হবে বলে দেখেননি। তিনি এটাও বলেন যে আল্লাহপাক অবশ্যই সাহাজ্য করবেন এবং অবশ্যই সবাই বায়তুল্লাহ তওয়াফ এর সুযোগ পাবেন। হযরত উমর (রাঃ) এরপরও সংশয়গ্রস্ত ছিলেন যতক্ষন না সুরা ফতেহ এর আয়াতগুলি নাজিল হয়। পরবর্তি কালে এই সংশয় এর জন্য তিনি লজ্জিত ছিলেন এবং এই ভুল এর কাফফারা হিসেবে অনেক নেক আমল তথা সাদকা,রোজা এবং ক্রিতদাসমুক্তি দেন।
এই চুক্তির আরেকটি বিষয় হচ্ছে যে কাফির রা কেন চুক্তি ও আলোচনায় বসল এবং রাসুল (সাঃ) কেন এই চুক্তিতে উপনিত হলেন? যদিও তারা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি ছাড়াই মক্কার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন কিন্তু হযরত উসমান (রাঃ) এর শাহদাত এর গুজব শুনে সকলেই রাসুল(সাঃ) এর কাছে শপথবদ্ধ হয়েছিলেন যে তারা যে তারা কোন অবস্থাতেই যুদ্ধের ময়দানে অল্লাহর রাসুল(সাঃ) কে ছেড়ে যাবেননা। বাইয়াত এর রিজোয়ান এর এই শপথ কারিদের উপর আল্লাহতায়লা নিজে সন্তষ্ট ছিলেন বলে আয়াত নাজিল করেন। অর্থাত সেই সময় তার সাথে প্রায় চোদ্দশত জিবন উৎসর্গকারি সৈনিকদের একটি বাহিনি ছিল। অন্যদিকে তিনি সামরিক কেীশলগত দিক দিয়ে অত্যন্ত ভাল একটি অবস্থায় ছিলেন। কুরাইশদের বির যোদ্ধাদের অনেকেই ইতঃপূর্বে সংগঠিত যুদ্ধগুলিতে নিহত হয়েছিল। যারা জিবিত ছিল তারা আগেই খালিদ বিন ওয়ালিদ এর নেতৃত্বে রাসুল (সাঃ) এর আগমন কে বাধা দিতে সানিয়াতুল মারার এ উপস্থিত হয়েছিল। তাদের পিছনে আরো সাহাজ্যকারি বাহিনিও প্রেরিত হয়েছিল। কিন্তু রাসুল(সাঃ) অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সানিয়াতুল মারার থেকে প্রধান রাস্তা ধরে না এসে দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম করে মক্কার নিকটবর্তি হুদায়বিয়ায় উপস্থিত হন। এই দিকে খালিদ (রাঃ) এর বাহিনি সহ কুরাইশ দের প্রেরিত বাহিনি গুলি এই পথ পরিবর্তনে বিভ্রান্ত হয়ে সিদ্ধান্ত হিনতায় ভুগছিল। যার ফলে রাসুল(সাঃ) তার সাহাবিদের নিয়ে যখন মক্কার কয়েক মাইল এর মধ্যে হুদায়বিয়াতে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন কুরাইশদের মূল বাহিনি মক্কা থেকে শতাধিক মাইল দুরে। অন্যান্য সাহাজ্যকারি বাহিনিও ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। যার ফলে মক্কা ছিল তখন মুসলিম দের আক্রমন এর জন্য উন্মুক্ত এবং প্রতিরক্ষা বিহিন প্রায়। রাসুল(সাঃ) এর সমর কেীশল এর প্রয়োগে শত্রু বাহিনি বিভ্রান্ত ও ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল কোন যুদ্ধ ছাড়াই। এই অবস্থায় নিরাপত্তার স্বার্থে কাফির দের রাসুল (সাঃ) এর সাথে আলোচনা ও চুক্তি করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিলনা।
এই অবস্থায় রাসুল(সাঃ) মক্কা আক্রমন না করে কুরাইশদের সাথে আলোচনা এবং চুক্তিতে উপনিত হলেন কেন? এই প্রশ্নও কারো মনে আসতে পারে। সামরিক দিক দিয়ে অত্যন্ত সুবিধাজনক অবস্থানে থেকে এবং সাথে জিবন উৎসর্গকারি বির যোদ্ধা বাহিনি থাকলে এই অবস্থায় যে কেউই মক্কা আক্রমন ও দখল করে নিতেন। কিন্তু রাসুল (সাঃ) তা করেননি কারন তার উদ্দেশ্য শুধু বিজয় লাভ বা মক্কা দখল ছিলনা। তার উদ্দেশ্য ছিল আল্লাহর দেয়া নবুয়তের দায়িত্ব পালন করা। তার মিশন ছিল শান্তি ও নিরাপত্তা কায়েম এবং সকল ফিতনার মুলোচ্ছেদ। তিনি যদি আক্রমন করতেন তা হলে একটি দির্ঘস্থায়ি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আশংকা ছিল। কিন্তু তিনি তার পরিবর্তে শান্তি এবং মানবতাকেই প্রাধান্য দিলেন। চুক্তির আলোচনার সময় তিনি বারবারই বলেছিলেন যে তার উদ্দেশ্য কেবল মাত্র বায়তুল্লাহ জিয়ারত করা। তিনি কোন রকম এর হুমকিও দেননি। কিন্তু তার অবস্থান এর কারনে ভিত হয়ে কুরাইশরা নিজেরাই চুক্তি তে উপনিত হতে চাইল এবং এর মাধ্যমে একটি বিরাট বিজয় এর সম্ভাবনার সৃস্টি হলো। এর মাধ্যমে তিনি যে নৈতিক বিজয় লাভ করলেন সেটাই পরবর্তি তে ইসলাম কে প্রতিষ্ঠিত করল।
আল্লাহতায়লা সূরা ফতেহ তে এই জন্যই হুদায়বিয়ার সন্ধি কে "সুস্পষ্ট বিজয়" বলে বলেছেন। কারন এই চুক্তির পরবর্তি সময়ে ইসলাম দ্রুত বিস্তার লাভ করে এবং এরপর বিনা যুদ্ধেই মক্কা সহ আরবের অধিকাংশ অঞ্চল ইসলামের ছায়ায় চলে আসে।
বিষয়: বিবিধ
১৭৯৭ বার পঠিত, ১৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
চমৎকার বিশ্লেষণ, ১ম পর্বের চেয়ে এই পর্বটি আর চমৎকার হয়েছে। অনেক গুলো বিষয় সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেছেন ফলে পাঠক পড়িবা মাত্রই বুঝিবে।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
প্রথম পর্ব ছিল শুধু ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরন। সেখানে কোন বিশ্লেষন করা হয়নি।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
আমিন।
আমিন।
মঙ্গলময় আপনাকে আরও সুন্দর সুন্দর বিষয়ে লিখার জন্য মনোনীত করুণ এবং সর্বাবস্থায় ভালো রাখুন এই দোয়া রইলো।
আমিন।
এজন্যই আল্লাহপাকই সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ কেীশলি।
অনেক ধন্যবাদ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন