নালন্দা। ইতিহাস ও অপবাদ।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৬ অক্টোবর, ২০১৪, ১১:৫৪:১৭ রাত
নালন্দা নামটির সাথে শিক্ষিত ব্যাক্তি মাত্রই পরিচিত। উপমহাদেশের প্রাচিন সভ্যতার ইতিহাসে নালন্দা কে বলা হয়েছে সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। বর্তমানে পাটনা শহরের একশত মাইল পূর্বে এর ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। বেীদ্ধ ধর্মের দর্শন প্রচার ও শিক্ষা দেওয়ার জন্য নালন্দাতে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তথা বিহার প্রতিষ্ঠিত হয় গুপ্ত বংশের শাসনামলে। নালন্দা কে উদন্তপুর বিহার ও বলা হয় নালন্দার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় চৈনিক শিক্ষার্থি ও পর্যটক ইয়াজিং এর লিখায় যিনি ৬৭৩ খ্রিষ্টাব্দে এই বিহারে শিক্ষার উদ্দেশ্যে আসেন।
৭৫০ খ্রিস্টাব্দে বেীদ্ধ ধর্মাবলম্বি গোপাল বাংলা সহ ভারতের পুর্বাঞ্চলের রাজা হন। পাল রাজবংশ প্রায় ৪০০ বছর বাংলা ও বিহার সহ ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চল শাসন করে । নালন্দা এই সময় পাল রাজাদের সহায়তায় এশিয়ার একটি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ হয়ে উঠে। পাল রাজবংশের সবচেয়ে বিখ্যাত রাজা দেবপাল নালন্দাকে বেীদ্ধ ধর্মের প্রধান কেন্দ্রে পরিনিত করেন। সমগ্র এশিয়া থেকে শিক্ষার্থিরা তখন এখানে আসতেন। চিনা পর্যটক ও শিক্ষার্থিদের বিবরন থেকে জানা যায় এই সময় এখানে একসাথে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার শিক্ষার্থি সম্পুর্ন আবাসিক ব্যবস্থায় পড়াশুনা করতেন। এই বিহারের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল এর পাঠাগার ও বই এর সংগ্রহ। ধর্মকুঞ্জ নামে তিনটি বড় দালানে অবস্থিত এই পাঠাগারটি একই সঙ্গে আর্কাইভ এর কাজ ও করত। এই পাঠাগার এ গ্রন্থতালিকা ও গ্রন্থগুলির অনুলিপি করার জন্য কর্মচারি নিযুক্ত ছিল।
পাল আমলেই নালন্দার বিশ্ববিদ্যালয় ভবন নির্মিত হয়। বর্তমান ধ্বংসাবশেষ থেকে দেখা যায় প্রায় ১৪ হেক্টর জায়গার উপর নির্মিত এই স্থাপনাতে প্রায় দশটি মন্দির ছিল। ছিল শ্রেনিকক্ষ এবং ধ্যানকক্ষ। শিক্ষক ও ছাত্রদের আবাসিক ব্যাবস্থার সাথে পানির জন্য পুকুর এবং বাগান ও এর মধ্যে ছিল। সমগ্র এলাকাটি ঘেরা ছিল উঁচু প্রাচির দিয়ে এবং একটি মাত্র দরজা ছিল এর মধ্যে প্রবেশ করার জন্য। বেীদ্ধ শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্জন প্রার্থনার বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সেই কারনে বেীদ্ধ বিহার গুলি নির্মিত হয়েছে এই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে যে নির্বান কামনায় অধ্যয়ন ও ধ্যানরত শিক্ষার্থির উপর যেন বাইরের পরিবেশের কোন প্রভাব না পরে। বাংলাদেশের কুমিল্লার ময়নামতি বা নওগাঁর পাহাড়পুর বিহার যারা দেখেছেন তারা সহযেই বুঝতে পারবেন একটি বেীদ্ধ বিহারের গঠন কি রকম হয়। এই গঠন এর সাথে কিল্লা বা দুর্গের গঠন এর পুর্ন মিল রয়েছে। সেই সময় প্রয়োজনে বেীদ্ধ বিহারগুলিকে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার ও করা হয়েছে। তিব্বত ও নেপালের ইতিহাস এ এর যথেষ্ট প্রমান আছে। বিশেষ করে তিব্বত এর বেীদ্ধবিহারগুলি যাকে সাধারনত গুমফা বলা হয় বিভিন্ন সময় সেগুলিকে দুর্গ ও অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহারের প্রমান ভ্রমনকারিদের লিখায় পাওয়া গেছে।
খ্রিষ্টাব্দ একাদশ শতকের দিকে পাল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়। দক্ষিন ভারতের কর্নটক থেকে আগত হিন্দু বিজয় সিংহ পূর্ববঙ্গকে কেন্দ্র করে একটি হিন্দু রাজ্য স্থাপন করেন। বিজয় সেন এবং তার উত্তরাধিকারি বল্লাল সেন ও লক্ষন সেন বেীদ্ধদের সমূলে উচ্ছেদ করার নিতি গ্রহন করেন। বেীদ্ধদের জোড় করে পুনরায় নিচ শ্রেনির হিন্দুতে পরিনিত করা হয় এবং অন্য অঞ্চল থেকে ব্রাম্মনদের আমদানি করে তাদেরকে সমাজের প্রধান বর্ন হিসেবে জোড়পুর্বক স্থাপন করা হয়। ১১৯৩ সালে লক্ষন সেন প্রথমবার নালন্দা আক্রমন করেন। পাল রাজাদের পতনের সাথে এই বিহারের পতন ঘটতে শুরু করে। তবে তখনও এই বিহারের বিরাট লাইব্রেরির একটি অংশ বর্তমান ছিল। ১১৯৭ সালে বখতিয়ার খিলজি নালন্দা আক্রমন করেন। কিছু ঐতিহাসিক এই মন্তব্য করেছেন যে বখতিয়ার খিলজি অশিক্ষিত ছিলেন বিধায় এই বিদ্যালয়টি ধ্বংস করেন। তিনি কয়েক হাজার ভিক্ষু কে হত্যা ও পুড়িয়ে মারেন এমনকি এই অভিযোগ ও কেউ কেউ করেছেন যে বখতিয়ার খিলজি নালন্দার লাইব্রেরিতে আগুন লাগিয়ে দেন যা নাকি কয়েক মাস(!) ধরে জ্বলছিল এবং চারশত বছরের সংগৃহিত পুস্তকভান্ডার এভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির মত এই অপবাদ টিও এখনও মুসলিম জাতি এবং বখতিয়ার খিলজির উপর অনেকেই আরোপ করে থাকেন।
এটা সত্যি যে বখতিয়ার খিলজি সত্যই নালন্দা আক্রমন করেছিলেন এবং পুরোহিত ও ভিক্ষুদের হত্যাও করেছিলেন। এই ঘটনার বিবরন পরবর্তি তে ঐতিহাসিক মিনহাজ -ই-সিরাজ জুরজানি তার ”তাবকাত-ই-নাসিরি” গ্রন্থে দিয়েছেন। তার সেই গ্রন্থ থেকে ঘটনাটুকু উদ্ধৃত করছি। এটি অনুবাদ করেছেন ঐতিহাসিক আবুল কালাম মুহাম্মদ যাকারিয়া।
” বিশ্বস্ত ব্যাক্তিগন এমন বর্ননা করেছেন যে দুইশত অশ্বারোহি সৈন্য সহ তিনি বিহার দুর্গাভিমুখে যাত্রা করেন ও অতর্কিতে আক্রমন করেন। দুর্গদ্বারে উপস্থিত হওয়ার পর প্রবল আক্রমন শুরু হয়। স্বিয় শক্তি ও সাহসের বলে (মুহাম্মদ বখতিয়ার) এই দুর্গদ্বার ভেদ করে অভ্যন্তরে প্রবেশ করলে তার সৈন্যগন দুর্গ অধিকার করেন এবং অনেক দ্রব্য লুন্ঠন করে হস্তগত করেন। এ স্থানের অধিকাংশ অধিবাসি ব্রাম্মন ছিলেন। তাদের মস্তক মুন্ডিত ছিল। তাদেরকে হত্যা করা হয়। সেখানে অনেক গ্রন্থ ছিল। যখন বহুসংখ্যক গ্রন্থ মুসলিমদের দৃষ্টিতে পড়ল তখন উপস্থিত ব্যাক্তিগনকে গ্রন্থে লিখিত বিষয়ের পাঠেদ্ধার এ আহব্বান করা হলো এবং এক ঘোষনা প্রচার করা হলো। যখন পুস্তকের মর্মোদ্ধার করা হলো তখন জানা গেল যে সমগ্র নগর ও দুর্গ নিয়ে এটি ছিল একটি মাদ্রাসা(শিক্ষায়তন)। হিন্দুদের ভাষায় মাদ্রাসা কে বিহার বলা হয়। ”
মিনহাজের বর্ননাতে নালন্দা কে কিল্লায়ে বিহার তথা বিহার দুর্গ বলে অভিহিত করা হয়েছে। প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে এটি সুস্পষ্ট যে নালন্দা বিহারটি চারিদিকে উঁচু প্রাচির দারা ঘেরা ছিল এবং এর প্রবেশ পথ ও ছিল মাত্র একটি। ঘটনার প্রায় চল্লিশ বছর পর মিনহাজ প্রত্যক্ষদর্শির কাছ থেকে ঘটনার বিবরন সংগ্রহ ও লিপিবদ্ধ করেন। সুতারাং তিনি লিখার আগেই জানতেন যে এটি কোন কিল্লা বা দুর্গ নয় বরং বিহার। তিনি প্রথমেই বখতিয়ার এর ভুল উল্লেখ করতে পারতেন। এছাড়া বখতিয়ার খিলজিকে বাধা দেওয়া হয়েছিল যার জন্য তিনি বলপ্রয়োগ করেছিলেন। ইতিপূর্বে করা আলোচনায় এটিও স্পষ্ট যে এই বেীদ্ধ বিহারগুলি প্রয়োজনে দুর্গ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। বখতিয়ার খিলজির বিরুদ্ধে এই মন্তব্য করা হয়েছে যে তিনি নাকি বেীদ্ধ ধর্মের মূলোচ্ছেদ এর জন্য চেষ্টা করেছিলেন। অথচ তার অনেক আগেই বেীদ্ধ ধর্ম ভারতের মাটিতে সম্পুর্ন ক্ষমতাহিন হয়ে গিয়েছিল । ভারতের তখন সংগঠিত রাজশক্তি ছিল হিন্দুরা। দিল্লি থেকে বাংলা পর্যন্ত কোন শক্তিশালি বেীদ্ধ সাম্রাজ্য ছিলনা যে বেীদ্ধদের মূলোৎপটনে একজন মুসলিম সেনাপতি তার সময় ও শক্তি নিয়োগ করবে।এটাও উল্লেখযোগ্য যে বখতিয়ার খিলজি মাত্র দুইশত সৈনিক নিয়ে আক্রমন করেছিলেন। বখতিয়ারকে বাধা দেওয়া এটিও প্রমান করে যে এই বিহারে শুধু ভিক্ষু বা শ্রমনরাই ছিলেননা। এটা অনুমান করে নেওয়া যায় বিহার সিমান্তে কোন হিন্দু বা বেীদ্ধ সামন্ত রাজাকে তাড়া করতে গিয়ে বখতিয়ার এই বিহারটি আক্রমন করেছিলেন। বখতিয়ার বিহারের অধিবাসিদের হত্যা করলেও আশেপাশের কারো ক্ষতি করেননি। মিনহাজের পরবর্তি বর্ননায় এটিও স্পষ্ট যে বখতিয়ার ঘোষনা দিয়ে গ্রন্থগুলির মর্ম উদ্ধারে সক্ষম কাউকে আহব্বান জানান এবং তাদের কাছ থেকেই জানতে পারেন এটি একটি বিহার।এই গ্রন্থগুলি বখতিয়ার নষ্ট করেছিলেন বা জ্বালিয়ে দিয়েছিলেন জাতিয় কোন উল্লেখ কোন সমকালিন বর্ননাতে পাওয়া যায়না।
বর্তমানে এই বিহারের ধ্বংসাবশেষ এ দেখা যায় যে এই স্থাপনা টি নির্মিত ছিল পাথর ও পোড়া লাল ইট দিয়ে। যদি বখতিয়ার সত্যিই বিহার এবং এর গ্রন্থালয়ে আগুন লাগিয়ে দিতেন এবং কয়েক মাস ধরে সেই আগুন জ্বলত তবে এটিই স্বাভাবিক যে এই ইটগুলি তখন পুড়ে ঝামা হয়ে যেত। কিন্তু যে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শনগুলি এই বিহারের ধ্বংস স্তুপে পাওয়া গেছে তাতে এটি পুড়ে যাওয়ার কোন চিহ্ন নাই। পরিত্যক্ত হয়ে কালের বিবর্তনে এই বিশাল স্থাপনাটির উপর মাটির আস্তরন পরে এবং গাছপালা গজায়। ১২৩৫ সালে তিব্বতি লামা বা ভিক্ষু চেং লো সা-বা নালন্দায় আসেন। তিনি লিখেছেন যে রাহুল শ্রিভদ্র নামে একজন নব্বই বছর বয়সি ভিক্ষুকে তিনি ৭০ জন শিক্ষার্থি কে শিক্ষা দিতে দেখেছেন। এর পরেও প্রায় ১৪০০ শত খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত স্থানিয় বেীদ্ধ সমাজের সহায়তায় এই বিহার চালু ছিল। কিন্তু বেীদ্ধ ধর্মাবলম্বিদের সংখ্যা হ্রাসের সাথে সাথে স্বাভাবিক ভাবেই এর সমাপ্তি ঘটে এবং এটি পরিত্যক্ত হয়। বিহারের পাটনা , বাংলার লাখনেীতি ও সোনারগাঁতে নতুন শিক্ষা কেন্দ্র তৈরি হয়। নবদ্বিপেও হিন্দু ধর্মাবলম্বিদের শিক্ষায়াতন তৈরি হয়। নালন্দা শিক্ষার্থির অভাবে স্বাভাবিক ভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। যে কারনেই তা হয়ে থাকুক। বখতিয়ার খিলজি নালন্দা ধ্বংসের জন্য কোনভাবেই দায়ি নন এবং গ্রন্থ পোড়ানর মত কোন কাজ তিনি করেননি।
প্রথম ছবিটি নালন্দা পুরাকির্তির বর্তমান অবস্থা।
নিচের ছবিটি বিহারের গঠন এর চিত্র।
তথ্যসুত্র:-
তবকাত ই নাসিরি-মিনহাজ ই সিরাজ (অনুবাদ-মোহাম্মদ যাকারিয়া)।
বাংলার ইতিহাসের দুশ বছর- সুখময় মুখোপাধ্যায়।
বাংলার ইতিহাস সুলতানি আমল-ডঃ আবদুল করিম।
উইকিপিডিয়া সহ ইন্টারনেট ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকা।
বিষয়: বিবিধ
২৩৮২ বার পঠিত, ৩৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
i didn't mention that in any line.
thank you.
ইতিহাস মনে রাখার দরকার নাই তবে জেনে রাখা জরুরি!
উত্তমভাবে যুক্তি খণ্ডন করার জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ । তারপরও আমি মনে করি এ বিষয় নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন আছে ।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
আমরা আমাদের ইতিহাস সম্পর্কে অজ্ঞ এবং অনেক ক্ষেত্রেই মিথ্যা প্রচারের মুখে হিনমন্য হয়ে থাকি।
এখানে আমন্ত্রণ-
http://www.bdmonitor.net/blog/blogdetail/detail/1838/President/55252#.VEI8kVdXv2n
সমস্যা হইল আমাদের দেশের মিডিয়াগুলি যে এই ধরনের সত্য কথা ছাপাইতে হিনমন্যতায় ভুগে। তেমনি পাঠকরাও বিশ্বাস করতে হিনমন্যতায় ভুগে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন