সপ্নের শহিদ মিনার এবং তার বিকৃতি।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৪ অক্টোবর, ২০১৪, ১২:০৯:৪৮ দুপুর
শহিদ মিনার।
শব্দটি শুনলে এখন চোখের সামনে যেটা ভেসে উঠে সেটা কি এর প্রকৃত সপ্নদ্রস্টাদের চোখে ভেসে উঠেছিল?
১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির পরদিনই মেডিকেল কলেজ চত্বরে এই ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি চিন্হ হিসেবে একটি ১০ ফুট উঁচু স্তম্ভ নির্মিত হয় যা ২৬ ফেব্রুয়ারি আযাদ সম্পাদক সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দিন উদ্বোধন করেন। কিন্তু সেই দিন রাত্রেই সেই শহিদ মিনার ভেঙ্গে দেওয়া হয়।
১৯৫৪ সালে পূর্বপাকিস্তানে প্রথম বারের মত দেওয়া হয় প্রাদেশিক পরিষদের সাধারন নির্বাচন। সেই নির্বাচনে সকল মুসলিম লিগ বিরোধি দল একত্রিত হয়ে গঠন করে যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে ম্যানিফেষ্ট রচনার দায়িত্ব পান সাহিত্যিক,সাংবাদিক, রাজনিতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ। ভাষা আন্দোলনের অগ্রসৈনিক আবুল মনসুর আহমদ একুশে ফেব্রুয়ারিকে শোক দিবস ঘোষনা এবং শহিদ মিনার নির্মান ও বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠাকে যুক্তফ্রন্টের বিখ্যাত একুশ দফা ম্যানিফেষ্ট এর অন্তর্ভুক্ত করে একে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনি ওয়াদাতে পরিনিত করেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সারা পূর্ব পাকিস্তানে নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু বিভিন্ন কারনে এই মিনারের কাজ শুরু করতে ১৯৫৭ সাল হয়ে যায়। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করেন। তার আমলেই ১৯৬৩ সালে এই শহিদ মিনারের নির্মান সমাপ্ত হয়। শহিদ মিনারে ডিজাইনার ছিলেন শিল্পি হামিদুর রহমান এবং তত্বাবধায়ক ছিলেন ভাস্কর নভেরা আহমদ।
কিন্তু এই শহিদ মিনারের সপ্নদ্রষ্টাদের সপ্ন কি বাস্তবায়িত হয়েছে এই স্থাপনাতে? আবুল মনসুর আহমদ ১৯৬৬ সালের ২১ এ ফেব্রুয়ারি লিখা প্রবন্ধ যা তার বিখ্যাত "বাংলাদেশের কালচার" গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে "আমার সপ্নের শহিদ মিনার" এ সুস্পষ্ট ভাবে লিখেন যে এই শহিদ মিনার তার সপ্নের শহিদ মিনার নয়। মিনার উচ্চতা জ্ঞাপক। তিনি লিখেছেন তার চিন্তা ছিল শহিদ মিনার হবে কুতুব মিনার বা আইফেল টাওয়ার এর মত একটি স্তম্ভ। মিনার শব্দটির উৎপত্তি নার বা আগুন থেকে। সমুদ্রে জাহাজের পথপ্রদর্শনের জন্য যে সুউচ্চ লাইট হাউস বা বাতিঘর স্থাপন করা হয় তাই আরবিতে মিনার। কিন্তু বর্তমান স্থাপনাটিকে তিনি বলেছেন এটি মিনার হয়নি হয়েছে চাতাল!
বর্তমান শহিদ মিনারের কনসেপ্ট টি কেউ যদি ভালভাবে পর্যবেক্ষন করেন তা হলে দুর্গা পূজার সময় প্রতিমা স্থাপন এর সাথে এর মিল সহজেই খুজে পাবেন। শহিদ মিনারের বেস এবং সম্মুখের অংশকেও সেই নিয়মে এখন বেদি বলা হয়। বেদি শব্দটি ব্যবহৃত হয় মুলত কোন দেবতার উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য বা বলি দেওয়ার যায়গা বুঝাতে।
শহিদ মিনার
দুর্গা মন্ডপ
এই ছবি থেকে স্পষ্ট যে এই শহিদ মিনারের মুল সপ্ন দ্রষ্টাদের ইচ্ছার প্রতি কোন মর্যাদা না দিয়ে কেউ শুধু নিজের লালিত মানসিকতাকে দেশের সকল মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। যারা না দেশের গনমানুষের সাথে সম্পৃক্ত না তাদের প্রতিনিধি।
শুধু কনসেপ্ট ই নয় শহিদ মিনারের বিভিন্ন অংশ সম্পর্কেও আবুল মনসুর আহমদ মন্তব্য করেন " এই সব শিল্পি কার পরামর্শে জানিনা,একটা ফান্ডামেন্টাল ভুল করিয়াছেন। তারা চারুশিল্পের কাছে বিরাটত্ব, বিউটির কাছে ম্যাজিস্টি,ফাইননেস এর কাঝে গ্র্যান্ডার সেক্রিফাইস করিয়াছেন্। স্থপতির হাতুড়ি-বাটালির কাজে লাগাইয়াছেন এরা চিত্রশিল্পির তুলি"। আবুল মনসুর আহমদ একে আরো বলেছেন এটা আর্টের এমন অপপ্রয়োগ হয়েছে যে এটা আর্টের পরিবর্তে ডার্ট তথা আবর্জনার সৃষ্টি করেছে।
আইয়ুব খানের আমলে নির্মিত এই শহিদ মিনারকে যারা অতিপবিত্রস্থান বলে গন্য করছেন তাদের অজ্ঞানতা ও ভন্ডামি সহজেই ধরা পরে আবুল মনসুর আহমদ এর লিখায়।
মন্দিরে যেমন শুদ্র ঢুকলে তা অপবিত্র হয় (মাত্র কিছুদিন পূবে ভারতে একজন প্রাদেশিক দলিত শ্রেনির মন্ত্রি একটি মন্দির পরিদর্শন করার পর তা আবার পবিত্র করতে হয়েছে!)। মরহুম অধ্যাপক পিয়াস করিমের লাশ শহিদ মিনারে যারা আনতে দিতো চায়না তারা তাদের এই স্থাপনাকে সেইরকম মন্দির ই মনে করে। তারা এখনও সেই বর্ণাশ্রম এর প্রাচিন মতবাদেই সিমাবদ্ধ। এই মিনার ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি হতে পারেনা। ভাষা সৈনিকদের এর সপ্নের শহিদ মিনার অতিতের স্মৃতি বাহক ছিলনা, ছিল জাতির ভবিষ্যতের পথ নির্দেশক আসমান ছোঁয়া অঙ্গুলি নির্দেশ।
কয়েকটি মিনার যা শহিদ মিনারের আদর্শ হওয়ার কথা ছিল।
কুতুব মিনার
ন্যাশনাল মনুমেন্ট,ওয়াশিংটন।
বিষয়: বিবিধ
১৭৩২ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
এই শহীদ মিনার শব্দটির মধ্যে একটি আরবী শব্দ (বিদেশী) আছে। তাই নাম পরিবর্তন করার জন্য প্রস্তাব করছি।
হযরত নুহ(আঃ) এর এক পুত্র কাফির ছিল। হযরত লুত(আঃ) স্ত্রীও। আবুল মনসুর আহমদ এর ঘরে মুশরিক পয়দা হলেও সেই জন্য দুঃখিত হওয়া যায় কিন্তু তাকে দোষ দেওয়া যায়না।
কারন এভাবে আমাদের অনেক কিছুকেই ধ্বংস ও বিক্রয় করা হয়েছে পেীত্তলিকতার কাছে।
মন্তব্য করতে লগইন করুন