১৭ই রমজান। বদর প্রান্তরে বিজয়ের দিন।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৬ জুলাই, ২০১৪, ০২:৩০:৫৯ রাত
আজকে ১৭ ই রমজান। বিশ্বের ও ইসলামের ইতিহাসের একটি গতিপ্রকৃতি নির্ধারনের দিন। আজকের দিনই বদর প্রান্তরে প্রথম বারের মত মুখোমুখি হয় ইসলাম ও কুফর এর সামরিক শক্তি। আর তাতে বিজয়ি হয়ে নব প্রতিষ্ঠিত মদিনা রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিশ্বের কাছে উপস্থাপিত হয়।
বদর মদিনার থেকে অল্প দুরে অবস্থিত চারদিকে পাহাড় ঘেরা একটি উপত্যকা। একটি ঝর্না থাকায় এখানে বেশকিছু গাছপালা ও খেজুর বাগান ছিল। কুরাইশ দের অন্যতম নেতা আবু সুফিয়ান তখন ব্যবসায়িক মুল্যবান মালামাল নিয়ে বর্তমান গাজা এলাকা থেকে মক্কা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। এই খবর মদিনাতে পেীছলে রাসুল (সাঃ) স্বয়ং নেতৃত্ব নিয়ে এই কাফেলাকে প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে বের হন। কারন এই কাফেলার আনা অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র মদিনা আক্রমনের উদ্দেশ্যেই আনা হচ্ছিল। এই খবর উক্ত কাফেলা এবং মক্কার অধিবাসি কুরাইশ দের কাছে পেীছে যায়। তারা এই কাফিলাকে রক্ষার উদ্দেশ্যে বিশাল এক বাহিনি গঠন করে এবং মদিনার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হয়ে যায়। তাদের পরিকল্পনা ছিল মদিনার উত্তর পুর্ব দিকে যদি মুসলিম বাহিনি কাফিলাকে আক্রমন করে তবে তারা দক্ষিন দিক থেকে মদিনার উপর আক্রমন করবে। রাসুল (সাঃ) এর সাথি বাহিনিতে মোট লোক ছিল ৩১৩ জন মাত্র। এর মধ্যে কেবল মাত্র দুইজন যুবায়ের ইবনে আওয়াম(রাঃ) এবং মিকদাদ বিন আসওয়াদ(রাঃ) ছিলেন ঘোড়সওয়ার। আর বাকি তিনশতের অধিক মানুষের জন্য ছিল ৭০ টি উট। রাসুল (সাঃ) এর প্রেরিত গুপ্তচর দের গতিবিধি আবু সুফিয়ান বুঝে নেন এবং মুল রাস্তা পরিহার করে সমুদ্র উপকুলের দিকে চলে যান। এই দিকে মক্কা থেকে ১৩০০ মানুষের একটি বাহিনি মদিনার পানে এগিয়ে যায়। আবু সুফিয়ান তার কাফিলা নিরাপদ হওয়ার খবর পাঠান। এই খবর পাওয়ার পর মক্কার বাহিনির মধ্যে বিরোধ এর সৃষ্টি হয়। তাদের একটি অংশ ফিরে যেতে উদ্যত হয়। কিন্তু ইসলামের চরম শত্রু আবু জেহেল জেদ ধরে যে তারা বদর প্রান্তর পর্যন্ত যাবে এবং তিনদিন অবস্থান করবে। বনু যোহরা গোত্রের নেতা আখনাস বিন শোরাইক এর নেতৃত্বে তার গোত্রের তিনশত জন ফিরে যায়। কিন্তু আবু জেহেল এর বাধার মুখে বাকিরা বদর এর দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য হয়।
এদিকে আবু সুফিয়ান কে অনুসরনরত মুসলিম বাহিনির কাছে মক্কা থেকে আগত কাফির দের গতিবিধি নিয়মিত সংবাদ পেীছত। রাসুল (সাঃ) তাদের বদর এর দিকে অগ্রসর হওয়ার সংবাদ পেয়ে একটি পরামর্শ সভার আহবান করেন। কারন বদর থেকে এই বাহিনির মদিনার জন্য হুমকি সৃস্টি করা সম্ভব ছিল। সেই সভায় মুহাজির দের পক্ষ থেকে হযরত আবুবকর(রাঃ), হযরত উমর (রাঃ) এবং হযরত মিকদাদ বিন উমর (রাঃ) এবং আনসার দের পক্ষ থেকে সা’দ বিন মায়াজ (রাঃ) বক্তব্য রাখেন এবং রাসুল (সাঃ) এর প্রতি পুর্ন আনুগত্য এবং সহায়তার আশ্বাস দেন। মদিনা সনদ অনুযায়ি আনসাররা যদিও মদিনার বাইরে রাসুল(সাঃ) কে সাহাজ্য করতে বাধ্য ছিলনা কিন্তু সা’দ বিন মায়াজ (রাঃ) প্রয়োজনে রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশে সমুদ্রে ঝাপিয়ে পড়ার ওয়াদা করেন।
রাসুল (সাঃ) এরপর সবাইকে নিয়ে বদর প্রান্তরের দিকে অগ্রসর হন। তিনি হযরত আলি(রাঃ),যুবায়র বিন আওয়াম(রাঃ) এবং হযরত সা’দ বিন আবি ওয়াক্কাস (রাঃ) এর সমন্বয়ে একটি তথ্য সংগ্রহকারি দল আধুনিক পরিভাষায় যাকে রিকনিস্যান্স পেট্রোল বলা হয় তা প্রেরন করেন। এই দলটি কুরাইশ দের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে আনে। তাদের অবস্থান ,সংখ্যা ও নেতাদের সম্পর্কে প্রয়োজনিয় তথ্য পাওয়ার পর বদর প্রান্তরে অবস্থান গ্রহন করেন মুজাহিদরা। প্রাথমিক অবস্থান এ থাকার সময় হযরত খাব্বাব ইবনে মুনযির(রাঃ) রাসুল ( সাঃ) কে অন্য একটি অবস্থান গ্রহন এর পরামর্শদেন যাতে করে বদর এর প্রধান ঝর্না এবং অন্য পানির উৎস গুলি তার নিয়ন্ত্রনে থাকে। রাসুল (সাঃ) এ পরামর্শ গ্রহন করেন এবং এমন একটি অবস্থান গ্রহন করেন যে যার ফলে বদর এর সকল পানির উৎসই তার নিয়ন্ত্রনে চলে আসে। হযরত সা”দ বিন মায়াজ(রাঃ) এর পরামর্শে যুদ্ধ ক্ষেত্রের একধারে একটু উঁচু পাহারের উপর রাসুল (সাঃ) এর জন্য বিশেষ অবস্থান তৈরি করা হয় যেখান থেকে সমগ্র যুদ্ধ ক্ষেত্র নজরে আসত। একে আধুনিক পরিভাষায় কমান্ড পোষ্ট বলা হয়। একদল আনসার সাহাবি রাসুল(সাঃ) এর দেহরক্ষি হিসেবে নিয়োজিত হয়। যুদ্ধের পুর্বে আল্লাহতায়লা এই প্রান্তরে বৃষ্টি বর্ষন করেন। যার ফলে মুসলিম অবস্থানে মাটি শক্ত হয় অন্যদিকে কাফির দের অবস্থান কর্দমাক্ত হয়ে যায়। রাসুল (সাঃ) ১৭ ই রমজান রাত্রের মধ্যেই যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত সামরিক সমাবেশ করেন। অন্যদিকে সেই রাত্রে কাফিরদের শিবিরে বিরোধের সৃষ্টি হয়। ওতবা ইবনে রবিয়া ও হাকিম বিন হিযাম যুদ্ধ না করেই ফিরে যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। কিন্তু আবু জেহেল এর তিব্র প্রতিবাদ করে এবং ওতবার প্রতি ভিত হওয়ার অপবাদ আরোপ করে কারন তার পুত্র হযরত হুজাইফা(রাঃ) অনেক আগেই ইসলাম গ্রহন করেছিল। আবু জেহেল কযেকজন কবিকে সকলকে উত্তেজিত করার জন্য নিযুক্ত করে যাতে যুদ্ধ বিরোধিরা কোন প্রচারনা চালনর সুযোগ না পায়।
পরদিন সকালে উভয় বাহিনি মুখোমুখি হয়। রাসুল (সাঃ) প্রথমে আল্লাহর কাছে সাফল্যের ও সহায়তার জন্য দোয়া করেন এবং এরপর বাহিনিকে সুসংবদ্ধ ভাবে কাতার বন্দি করেন। তিনি নির্দেশ দেন আক্রমনকারিরা এগিয়ে এলে তাদের প্রতি তির নিক্ষেপ করতে তবে এই বিষয়ে খেয়ার রাখতে যেন তাদের তির অপচয় না হয়।
যুদ্ধের প্রথমে আসওয়াদ বিন আবদুল আছাদ মাখযুমি নামের একজন দুর্বত্ত স্বভাবের কাফির মুসলিমদের তৈরি পানির হাউজ থেকে পানি পান করার কসম করে এগিয়ে আসে। হযরত হামজা(রাঃ) তাকে আক্রমন করে হত্যা করেন। এরপর কুরাইশদের পক্ষ থেকে ওতবা ইবনে রবিয়া তার ভাই শায়বা ইবনে রবিয়া, এবং তার পুত্র ওয়ালিদ বিন ওতবা ময়দানে এগিয়ে আসে এবং দন্দযুদ্ধের জন্য আহবান জানায়। তিন জন আনসার তাদের মুকাবিলায় এগিয়ে গেলে ওতবা তাদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে অস্বিকার করে এবং মুহাজির দের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতে চায়। রাসুল (সাঃ) এর নির্দেশে হযরত হামজা(রাঃ) হযরত আলি (রাঃ) এবং হযরত উবায়দা ইবনে হারিস(রাঃ) অগ্রসর হন। হযরত হামজা (রাঃ) শায়বার সাথে হযরত আলি (রাঃ) ওয়ালিদ এর সাথে এবং হযরত ওবায়দা (রাঃ) ওতবার সাথে দন্দ যুদ্ধে লিপ্ত হন। হযরত আলি এবং হামজা (রাঃ) তাদের প্রতিদন্দিদের শ্রিঘ্রই পরাজিত ও হত্যা করেন। হযরত ওবায়দা আহত হন। হযরত আলি ও হামজা (রাঃ) ওতবাকে পরাজিত ও নিহত করে ফিরে আসেন তাকে সাথে নিয়ে। এই যুদ্ধ চলার সময়ই রাসুল (সাঃ) আবারও দোয়া করেন। কাফির বাহিনি সর্বাত্মক হামলা শুরু করে। রাসুল (সাঃ) সিজদায় দোয়ার এক পর্যায়ে মাথা তুলেন এবং বলেন যে ” হে আবুবকর,খুশি হও জিবরাইল এসেছেন।” এই সময় আল্লাহর নির্দেশে একদল ফিরিশতা মুসলিম বাহিনিকে সহায়তার জন্য বদর প্রান্তরে অবতরন করে। এরপর রাসুল(সাঃ) জবাবি হামলার নির্দেশ দেন এবং শহিদদের জান্নাতের সুসংবাদ দেন। প্রচন্ড আক্রমনের মুখে কাফিররা পরাজিত হয়ে পিছিয়ে যেতে থাকে। এইসময় কাফিরদের প্রধান নেতা আবু জেহেল শেষ চেষ্টায় তার অবশিষ্ট সমর্থকদের একত্র করে হামলা চালাতে চেষ্টা করলেও দুই আনসার কিশোর মা’য ইবনে আমর জামুহ এবং মাউ’জ ইবনে আফরা তাকে হত্যা করে। তার মৃত্যুতে কাফির রা নেতৃত্বহিন হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যায় বা আত্ম সমর্পন করে।
বদর প্রান্তরে এই যুদ্ধে ১৪ জন মুসলিম শহিদ হয়। আর কাফিরদের পক্ষে নিহত হয় ৭০ জন এবং সমপরিমান বন্দি হয়। নিহত ও বন্দিদের মধ্যে মক্কার প্রধান ব্যাক্তিদের অনেকেই ছিলেন। এই যুদ্ধে বন্দিদের ব্যাপারে রাসুল(সাঃ) যে উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন তা পৃথিবির ইতিহাসে অনন্য। সকর বন্দিকে উত্তম খাবার পরিবেশন করা হয়েছিল। তাদের নির্দৃষ্ট মুক্তিপনের বিনিময়ে মুক্তি দেয়া হয়েছিল। এমনকি শিক্ষিত বন্দিদের দশজন করে শিশুকে শিক্ষা দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কেবল মাত্র দুজন নজর বিন হারেস ও ওকবা বিন আবু মুইত কে হত্যা করা হয় কারন তারা ছিল যুদ্ধঅপরাধি।
বদরও প্রান্তরে এই বিজয় ছিল আল্লাহর এক নিয়ামত। মহান আল্লাহতায়লা পবিত্র কুরআন এর সূরা আনফালে এই যুদ্ধের পর্যালোচনা ও মুল্যায়ন করেন। এই যুদ্ধ পৃথিবীর ইতিহাস এর গতি প্রকৃতি নির্ধারন কারি যুদ্ধ সমূহের একটি। এই যুদ্ধে রাসুল (সাঃ) যে কেীশল অবলম্বন করেছিলেন তা আজো শিক্ষনিয় এবং প্রয়োগযোগ্য। পৃথিবির সকল উচ্চ সামরিক শিক্ষায়তনগুলিতে এখনও এই যুদ্ধের ইতিহাস পড়ান হয়।
বিষয়: বিবিধ
১৪৭১ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
A PHP Error was encountered
Severity: Notice
Message: Undefined offset: 9368
Filename: views/blogdetailpage.php
Line Number: 764
মন্তব্য করতে লগইন করুন