জেরুসালেম এর চারটি ঐতিহাসিক দিন।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১২ জুলাই, ২০১৪, ১০:৩৩:৫৬ রাত
লিখাটি কয়েক বছর আগে লিখা ও অন্য একটি ব্লগে প্রকাশিত। তবে এখনও প্রাসঙ্গিক। যারা ইসরাইলের গাজায় বোমা বর্ষনের চেয়ে হামাসের প্রতিরক্ষা মুলক রকেট হামলা যা শুধু সামরিক টার্গেটে সেটা নিয়ে বেশি ব্যস্ত তাদের জন্য কিছু শিক্ষা ও আছে এতে। ইসরাইল কি আদেী কোন বৈধ রাষ্ট্র?
১. মাস,এপ্রিল,৬৩৭ সাল।আরবের তপ্ত মরুর বুকে পথ চলে কেবল একজন সহযাত্রি সেবক কে নিয়ে জেরুসালেম শহরের উপকণ্ঠের মুসলিম বাহিনীর ঘাঁটিতে উপস্থিত হলেন হযরত উমর (রাঃ)।অবরুদ্ধ জেরুসালেম এর নেতৃবৃন্দ কেবল মাত্র খলিফার সাথেই সন্ধি চুক্তি সাক্ষর ও আত্মসমর্পন করার শর্ত দিয়েছেন। যুদ্ধ করে জেরুসালেম দখল করা মুসলিম বাহিনীর পক্ষে সম্ভব হলেও রক্তপাত এড়ানোর জন্য এই তপ্ত মরুর মধ্যে দিয়ে সাত-আটদিন চলে হযরত উমর (রাঃ)জেরুসালেম এর নেতৃবৃন্দের শর্তানুযায়ি এসেছেন।উমর(রাঃ)জেরুসালেম এর নেতৃবৃন্দের সাথে সন্ধিচুক্তিতে সাক্ষর করলেন এবং শহরের চাবি তার হাতে স্থানান্তরিত করা হলো। সন্ধির শর্ত অনুযায়ি সকল ধর্মের অধিবসিকে জেরুসালেমে বসবাসের অধিকার ও নিরাপত্তা প্রদান করা হলো। কেউ যদি শহর ত্যাগ করতে চায় তবে তার সম্পদ সহ ত্যাগ করার অধিকার দেয়া হলো। সকল ধর্মস্থান নিজনিজ ধর্মের নিয়ন্ত্রনে থাকলো। অমুসলিম দের উপর শুধূমাত্র জিযয়া কর আরোপ করা হলো। তাও কেবল মাত্র সমর্থ পুরুষ মানুষদের উপরে। বিজয়ি মুসলিম সৈন্যরা শান্তি ও নিরবতার সাথে শহরে প্রবেশ করল।হযরত উমর (রাঃ)শহর পরিদর্শন করতে গেলেন।খৃষ্টান ধর্মনেতাদের আমন্ত্রনে তিনি ”চার্চ অফ রেসারেকশন”নামের শহরের প্রধান গির্জা পরিদর্শন করছিলেন।এমন সময় নামাজের সময় হলো।খৃষ্টান ধর্মনেতা প্যাট্রিয়ার্ক সোফার্নিয়াস তাকে গির্জার ভিতরেই নামাজ পড়ার আমন্ত্রন জানালেন। কিন্তু উমর(রাঃ)বাইরে গিয়ে উঠানে নামাজ আদায় করলেন।বিস্মিত সোফার্নিয়াস এর কারন জানতে চাইলে হযরত উমর(রাঃ)জবাব দিলেন যে তিনি যদি গির্জার ভিতরে নামাজ পরতেন তাহলে একে মুসলিমরা গির্জার মধ্যে নামাজ পড়ার জন্য খলিফা অনুমতি দিয়েছেন বলে ধরে নিতে পারত এবং এত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ হবে। অন্যদিকে এই যুক্তিতে পরবর্তিতে মুসলিমরা গির্জাটিকে মসজিদেও পরিবর্তিত করতে পারে। এই ছিল সন্ধির মর্যাদা এবং শুধু রক্তপাত এড়ানোর জন্যই খোদ খলিফা মরুভুমির মধ্যে দির্ঘ সফর করেছিলেন।
২.১৫ই জুলাই,১০৯৯ খ্রিষ্টাব্দ। খ্রিষ্টান ক্রুসেডারদের হাতে অবরুদ্ধ জেরুসালেম আত্মসমর্পন করল এই শর্তে যে সকল মুসলিম ও অন্য ধর্মাবলম্বিদের নিরাপদে শহর ত্যাগ করতে দেয়া হবে। দুপুরে খ্রিষ্টান নেতা গডফ্রে দ্য বুইলোঁ প্রবেশ করলেন শহরে। আর প্রবেশ করেই আদেশ দিলেন শহরের সকল মুসলিম ও ইহুদি অধিবাসিদের হত্যা করতে। তিনদিন ধরে চলল এই রক্তের খেলা। শহরের সত্তর হাজার মুসলিম ও ইহুদি এবং কিছু সংখ্যক ভিন্নমতাবলম্বি খ্রিস্টানদেরও হত্যা করা হলো। আল-আকসা মসজিদ, উমর মসজিদ, এমনকি খ্রিষ্টান ধর্মিয় পবিত্রস্থানে আশ্রয়ে নেয়া সকল মুসলিমকে,নারী,শিশু,বৃদ্ধ নির্বিশেষে হত্যা করা হলো। একজন ক্রুসেডার "জেষ্টা ফানকোরাম" এর লেখায় রয়েছে টেমপল মাউণ্ট যা হযরত সুলায়মান (আঃ)কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত এবং সকল ধর্মেই পবিত্র স্থান বলে স্বিকৃত সেখানে এতবেশি লোককে হত্যা করা হয়যে তার মেঝেতে ক্রুসেডারদের হাঁটু পর্যন্ত রক্ত জমে যায়। এই বিশ্বাসঘাতকতা ও হত্যা কে ক্রুসেডে অংশগ্রহনকারীদের জন্য পাপ নয় বলে ঘোষনা দেন স্বয়ং পোপ।
৩.২রা অক্টোবার,১১৮৭ খ্রিস্টাব্দ। ৮৮ বছর পর জেরুসালেমের উপকন্ঠে পেীছেছে গাজী সালাহউদ্দিন এর নেতৃত্বাধিন মুসলিম বাহিনী। শহরের অধিনায়ক বেলিয়ান অফ ইবলিন আত্মসমর্পনের জন্য আলোচনা করতে আসলেন। মুক্তিপন দেয়ার শর্তে সকল অধিবাসিকে নিরাপত্তা দেয়ার কথা দিলেন সালাহউদ্দিন। আত্মসমর্পন করল জেরুসালেম।সালাহউদ্দিন এর নেতৃত্বে শহরে প্রবেশ করল মুসলিম বাহিনী। খৃষ্টানরা ভয় পাচ্ছিল সালাহউদ্দিন তাদের মত সন্ধির শর্ত ভঙ্গ করেন কিনা। কিন্তু না। শান্ত,সু-শৃঙ্খলভাবে মুসলিম বাহিনী প্রবেশ করল শহরে। একজন অধিবাসির গায়েও হাত তোলা হয়নি সেদিন। যারা মুক্তিপন দিতে পেরেছে তাদেরকে তাৎক্ষনিক মুক্তি দেয়া হয়েছে।যখন কেবলমাত্র দরিদ্ররা অবশিষ্ট থাকল তখন সালাহউদ্দিন নিজের সম্পদ থেকে তাদের মুক্তিপন আদায় করে সকলকে মুক্তি দিয়ে দিলেন।
৪.১১,ডিসেম্বর,১৯১৭। ৯ই ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে জেরুসালেম এর মেয়র বে আল হুসাইনি জেরুসালেম এর আত্ম সমর্পনের দলিলে সাক্ষর করেন। গাজী সালাহউদ্দিন কর্তৃক জেরুসালেম বিজয়ের পর আবার খৃষ্টানদের দখলে চলে গেল জেরুসালেম। যদিও জেরুসালেম দখলকারী মিত্রবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত ছিল শরিফ আল হুসাইন এর নেতৃত্বাধিন আরব মুসলিম সৈন্যদল যাদের কে তুর্কি শাসন হতে মুক্তি দেয়ার এবং জেরুসালেম কে তাদের নিয়ন্ত্রনে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে খিলাফতের সাথে বিশ্বাস ঘাতকতা করতে ষড়যন্ত্রের ফাঁদে ফেলেছিলেন ইংরেজ টি.ই লরেন্স। ১১,ডিসেম্বর ১৯১৭ সালে দুপুর বেলা মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক বৃটিশ জেনারেল লর্ড এলেনবি তার সহযোগি ফ্রান্স,যুক্তরাষ্ট্র,ও ইতালিয় সামরিক কমান্ডার দের সাথে খালি পায়ে প্রবেশ করেন জেরুসালেমে। নগরীর জাফা গেইট অতিক্রম করে তিনি এর মাটিতে চুম্বন করেন এবং বলেন যে আজকে ক্রুসেড এর সমাপ্তি ঘটল।এলেনবি পবিত্র স্থানগুলি রক্ষায় প্রহরী হিসেব বৃটিশ ও স্কটিশ সৈন্যদের নিয়োজিত করেন। শুধু ইহুদি ধর্মাবলম্বিদের জন্য নিযুক্ত করা হয় বৃটিশ সেনাবাহিনির ইহুদি সৈনিক দের নিয়ে গঠিত বাহিনি ”জিউইশ লিজিয়ন” এর সৈনিকদের।কিন্তু তার সাথি আরবদের কোন অধিকার না দিয়ে তাদেরকে প্রেরন করেন সম্মুখবর্তি ফ্রন্টে। আর জেরুসালেম কে শরিফ হুসাইন এর নিয়ন্ত্রনে দেয়ার পরিবর্তে তাকে মুসলিম ও ইহুদি দুই ভাগে বিভক্ত করে মুসলিম অংশের নিয়ন্ত্রন রাখেন নিজের হাতে আর ইহুদি অংশের নিয়ন্ত্রন দেয়া হয় ইউরোপিয় ইহুদিদের হাতে।আর সকল মুসলিম সমর্থবান পুরুষদের আটক করে পাঠান হয় বন্দিশিবিরে। সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারগুলির সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা হয়।
এই চারটি দিনের ঘটনাগুলির বৈপরিত্ত কি আমাদের চোখ খুলে দেয়না? জানায় না কারা প্রকৃতপক্ষে মানবতাবাদী।
বিষয়: বিবিধ
১৪৩২ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক অনেক ধন্যবাদ।
আর সবুজ ভাইয়ের জন্য যাযাকাল্লাহ
একতার অভাব আর আত্মবিশ্বাস এর ঘাটতি মুসলিম জাতির এই অবস্থার কারন।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন