কাজী জাকির হুসাইন। নিভৃতচারি এক প্রানি ও পরিবেশ বিজ্ঞানি।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২১ জুন, ২০১৪, ১০:৪৫:৩৭ রাত
আমাদের দেশে অনেকেই আছেন যারা নিজেদের বিজ্ঞানি পরিচয় দিয়ে বিশাল একটি ভক্ত গোষ্ঠি তৈরি করেছেন। তার সেই ভক্ত গোষ্ঠির সহায়তায় বিভিন্ন উপদেশ আমাদেরও কে বিভিন্ন সময় বর্ষন করে থাকেন তারা। কিন্তু আমাদের দেশের সত্যিই এমন কয়েকজন বিজ্ঞানি ছিলেন যারা সম্পুর্ন নিরবে নিভৃত্বে চালিয়ে গিয়েছেন তাদের গবেষনা। অবদান রেখেছেন দেশের এবং সারা বিশ্বের জন্য। কারন বিজ্ঞান এর অবদান কখনও একটি দেশের বা গোষ্ঠির মধ্যে সিমাবদ্ধ হতে পারেনা। তাদের কখনও প্রয়োজন হয়নি বিভিন্ন ঘটনার অবতারনা করে নিজেকে দেশপ্রেমি হিসেবে প্রমানের। তেমনই একজন নিভৃতচারি বিজ্ঞানি হচ্ছে পক্ষিতত্ববিদ, প্রানি বিজ্ঞানি এবং পরিবেশবিদ কাজী জাকির হুসাইন। তিনি ছিলেন আমাদের দেশের প্রানিবিজ্ঞান এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিষয়ের পুরোধা। তাকে বলা হয় বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রানি সংরক্ষন আন্দোলনের অগ্রনায়ক। তিনি বিজ্ঞানচর্চা ও অধ্যাপনার পাশাপাশি ছড়াকারও ছিলেন।
এই বিজ্ঞানির জন্ম ১৯৩১ সালে কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে। গ্রামিন পরিবেশে পালিত হওয়ায় শৈশব থেকেই প্রকৃতি ও পরিবেশ এর সাথে ছিল তার নিবিড় মিতালি। ১৯৪৬ সালে চাঁদপুর জিএইচই হাইস্কুল থেকৈ মেট্রিক পাশ করার পর ঢাকায় যান। ঢাকা কলেজ থেকে আইএসসি পাশ করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি লাভ করেন ১৯৫০ সালে। উল্লেখ্য তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জিববিদ্যায় কোন অনার্স কোর্স ছিলনা। তিনি ১৯৫১ সালে তৎকালিন পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান এবং লাহোর সরকারি কলেজ থেকে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিনে ১৯৫৩ সালে প্রানি বিজ্ঞান বিষয়ে মাষ্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। এখানে তিনি প্রথম স্থান সহ বিশ্ববিদ্যালয় এর স্বর্ন পদক ও অর্জন করেন। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর যোগদেন এবং তার ই চেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রানি বিদ্যায় অনার্স কোর্স চালু হয় এবং বিভাগটি গড়ে উঠে। ১৯৫৬ সালে তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ইংল্যান্ড এ যান এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।এখানে থাকার সময় ১৯৬২ সালে তিনি বৃটিশ গায়না হয়ে বর্তমান ব্রাজিল এ আমাজন নদির উজানে যেখানে তখনও কোন জনবসতি ছিলনা সেখানে একটি এক্সপেডিশন বা অভিযানে যাওয়ার সুযোগ পান। অক্সফোর্ডে তার বিষয় ছিল অর্নিথোলজি বা পক্ষিবিষয়কবিজ্ঞান। তিনি আমাজন নদির উজানের কাইটোয়ার ফলস যা পৃথিবির অন্যতম উচ্চতম জলপ্রপাত সেখানে ক্যাম্প করেন এবং বিভিন্ন অভিযান এ অংশনেন এবং নমুনা সংগ্রহ করেন। প্রায় আড়াই মাস তিনি এই গবেষনায় যুক্ত ছিলেন। তিনি ছাড়া এই অঞ্চলে আর কোন বাংলাদেশি অভিযাত্রি গিয়েছেন কিনা জানা নাই।
দেশে ফিরে তিনি পুনরায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। প্রানিবিদ্যা বিভাগ এর চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্বপালন করেন ১৯৬৭ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত। এই বিভাগটি তিনি নিজের হাতে গড়ে তুলেছিলেন বললেও অত্যুক্তি হবেনা। তিনিই এই বিভাগে রির্সাচ ডিগ্রি চালু করেন এবং গ্রুপ ভিত্তিক মাষ্টার্স কোর্স চালু করেন যা বিশেষজ্ঞ তৈরিতে অবদান রাখে। ”ওয়াইল্ড লাইফ বায়োলজি” বিষয়টি বাংলাদেশে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত করার একক কৃতিত্ব তারই। এছাড়াও জিববিজ্ঞান বিষয়গুলির সাথে পরিবেশ সংক্রান্ত শিক্ষা সংযুক্ত করার উদ্যোগও নিয়েছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে তার স্বাভাবিক অবসর জিবন শুরু হলেও তাকে সুপারনিউমারারি অধ্যাপক হিসেবে আরো সাত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুক্ত রাখা হয়। ২০০৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমিরিটাস হিসেবে নিযুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপনার বাইরেও তিনি বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠনের এবং সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন কোর্স এর ক্লাস নিতেন। তার অধিনে এক ডজন এর অধিক পিএইচডি এবং আরো বেশি এমফিল গবেষনা হয়েছে। ৭০টির মত তার নিজস্ব গবেষনা কর্ম বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল এ প্রকাশিত হয়েছে।
শুধু প্রানিবিদ্যা ও পক্ষিতত্বের শিক্ষকই নন বরং পরিবেশ ও প্রানি সংরক্ষন এর ক্ষেত্রেও তিনি ছিলেন অগ্রদুত। দেশের উন্নয়ন এর নামে বিদেশি জাতের মাছ,মুরগি এবং তথাকথিত উন্নত জাতের বৃক্ষরোপন এর ত্রিব্র বিরোধি ছিলেন তিনি। তিনি ”বাংলাদেশ প্রানিতত্ব সমিতি” এবং ”বাংলাদেশ পক্ষি সংরক্ষন সমিতি” এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। বিদেশি রেইনট্রি,ইউক্যালিপটাস,মেহগনি ইত্যাদি যখন সরকারি উদ্যোগে লাগান হচ্ছিল তখনই তার ত্রিব্র প্রতিবাদ করেছিলেন তিনি। তিনি বলেছিলেন এই গাছগুলি আমাদের স্বাভাবিক পরিবেশ এবং পাখি ও বন্য প্রানির উপর খারাপ প্রভাব ফেলবে। তার সেই আশংকা এখন সত্য হয়েছে। উ্ন্নত জাতের নামে আফ্রিকান মাগুর সহ বিদেশি মাছ চাষের ও বিরোধি ছিলেন তিনি। যদি তার পরামর্শ তথাকথিত সরকারি বিশেষজ্ঞরা গ্রহন করত তাহলে এখন দেশের পরিবেশ এই ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখিন হতোনা।‘বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইন-১৯৭৩’ জারি জন্য বাংলাদশে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা ছিল।কাজী জাকির হুসাইস ছিলেন প্রাণবিজ্ঞিানী, পক্ষীপ্রেমিক এবং বন্যপ্রাণী ও পরিবেশ বিষয়ে পরার্মশদাতা ও দিশারী। এ দেশের বিশেষত বন্যপ্রাণী সংরক্ষণএর পথ তিনি প্রদর্শন করে গিয়েছেন। উল্লখ্যে, বাংলাদশের জাতীয় পাখি হিসেবে দোয়েলকে নির্ধারনেও তার বড় ভূমিকা ছিল।
তিনি একজন ভাল লেখক ও ছড়াকার ও ছিলেন। বিশেষ করে ছোটদের জন্য ছড়ায় পরিবেশ সচেতনতামুলক অনেক সুন্দর রচনা আছে তার। বাংলা ও ইংরেজিতে তার বিশটির অধিক বই আছে যার কয়েকটি জিববিজ্ঞান ও পক্ষিতত্ব বিষয়ে আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রে পাঠ্য বই হিসেবে স্বিকৃত। তার আমাজন এর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ”হারান হিয়ার নিকুঞ্জ পথে কুড়াই ঝড়া ফুল” গ্রন্থটি। তার আরেকটি অভিনব গ্রন্থ হচ্ছে ”নজরুলের গানে ও কবিতায় পাখিদের আনাগোনা"”। এই বইটিতে তিনি জাতিয় কবি কাজি নজরুল ইসলামের গান ও কবিতায় পাখিদের ব্যবহার নিয়ে বিশেষ আলোচনা করেছেন। জাতিয় কবি হিসেবে কবি নজরুল ইসলাম এর প্রতি তার শ্রদ্ধা ছিল অপরিসিম। ইংরেজিতে ” Birds of Bangladesh" তার একটি অতিগুরুত্বপুর্ন বই। এই বইতে বাংলাদেশের বর্তমান ও বিলুপ্ত পাখিদের সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।
অধ্যাপক কাজী জাকির হুসা্ইন ই আমাদের সামনে প্রথম উপস্থাপন করেন তথাকথিত সভ্য! শ্বেতাঙ্গ রা কিভাবে উত্তর আমেরিকা ও এশিয়ার সম্বৃদ্ধ প্রানি সম্পদ ধ্বংস করেছে। তিনি উদাহরন হিসেবে দেখিয়েছিলেন আমেরিকার আদিবাসি তথা রেড ইন্ডিয়ান রা আমেরিকান বাইসন এর সাথে কিভাবে সহাবস্থান করত। তারা তাদের মাংস,হাড়,শিং চামড়া সবই ব্যবহার করত কিন্তু শিকার করত নিয়ন্ত্রিত ভাবে। অন্যদিকে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক রা স্রেফ বাইসনের জিহবার কাবাব এর জন্য একটি পুরা বাইসন নষ্ট করত। যার ফলে বর্তমানে ইয়েলোষ্টোন ন্যাশনাল পার্ক ছাড়া উত্তর আমেরিকার কোথাও আর বাইসন এর অস্তিত্ব নাই।
অশীতিপর বললে যা বোঝায়, প্রফসের হুসাইন তেমন ভগ্নস্বাস্থ্য ও শয্যাশায়ী ছিলেন না মোটেও। জীবনের শেষ মুর্হূত র্পযন্ত র্কমব্যস্ততায় কেটেছে তার। কিছুটা অসুস্থ হলেও ‘আদবিাসী’ ইস্যুতে যে চক্রান্ত জাতীয় ও আর্ন্তজাতিক র্পযায়ে চলছিলে তার ওপর বিশ্লেষণর্ধমী নিবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক কাজী জাকির হুসাইন। মৃত্যুর আগের দিনও পত্রিকার জন্য কলাম লিখে ছিলেন তিনি।
প্রফেসর কাজী জাকির হোসেন ১৯৯০ সালে জাতিসংঘের গ্লোবাল এনভায়রনমেন্টাল এচিভমেন্ট এর জন্য সন্মাননা লাভ করেন। ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। ২০১০ সালে বন্যপ্রানি সংরক্ষনে বঙ্গবন্ধু পুরুস্কার লাভ করেন।
২১জুন ২০১১ সালে এই মহান শিক্ষাবিদ ইন্তেকাল করেন।
কাজী জাকির হোসেন ছিলেন একজন প্রকৃত বিজ্ঞানি এবং পরিবেশবাদি। তিনি তথাকথিত পরিবেশবাদিদের মত কখনই ছিলেননা যারা পরিবেশ এবং মানুষের জিবন সম্পর্কে কিছু না জেনেই শিকার নিষিদ্ধ করার দাবি তুলে কিংবা অথিতি পাখির নামে অতিষ্ট করে তুলে। তিনি ছিলেন একজন বিজ্ঞানি যিনি পরিবেশ ও প্রান রক্ষায় সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা কেই একমাত্র পথ বলে মনে করতেন। এমন ভাবে পরিবেশ রক্ষার সমর্থক তিনি ছিলেননা যাতে মানুষের জিবনযাপনের ক্ষতি হয়। কখনই নিজের আদর্শকে বিসর্জন দেননি কোন কিছুর জন্য্। তাই আমাদের মতান্ধ মিডিয়াতে তিনি বাঞ্ছিত বা প্রিয়মুখ ছিলেননা। কিন্তু প্রতক্ষ ও পরোক্ষ অনেক ছাত্রছাত্রি ও পাঠককে তিনি উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন দেশ ও পৃথিবীর পরিবেশ সম্বন্ধে।
আজকে তার তৃত্বিয় মৃত্য বার্ষিকি তে আমরা তাকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরন করি।
বিষয়: বিবিধ
১৭৪৭ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সত্যিই তিনি ছিলেন আমৃত্যু জ্ঞানের অন্বেষক।
নিঃস্বার্থে মানা মানুষ গুলো পর্দার আড়ালে থাকে আর থাকতেও ভালবাসে। তাই খবর পাইনা।
পেলেও দুদিনের জন্য মনে থাকে।
আল্লাহ উনাকে জান্নাত নসিব করুক এই দোয়া করি।
নাঙ্গলকোটের কোথায় জানেন কি? আমার বাড়ি থেকে নাঙ্গলকোট খুব বেশি একটা দূর নয়। দেখে আসতাম।
এ বিশিষ্ট জীববিজ্ঞানী আমার দেশী লোক। খুব নিরহংকারী, আত্মপ্রচারবিমুখ ছিলেন।
তার লিখাগুলো খুবই চিত্তাকর্ষক। বিজ্ঞানের অনেক মজাহীন বিষয়কে তিনি মজাদার ভঙ্গিতে উপস্থাপন করতে পারতেন। সেজন্য অমনোযোগী ছাত্রও তাঁর পাঠের উপকারীতা থেকে বঞ্চিত হতনা। যারা তাঁর আর্টিক্যাল পড়েছেন তারা বুঝতে পারবেন একজন সাধারণ মানুষের কাছে বিজ্ঞানের জটিল বিষয়টি তিনি কত সহজ ভাবে বুঝিয়েছেন।
চিরকাল সৎ ও ধার্মীক এই শিক্ষাগুরুকে স্মরণ করিয়ে দেবার জন্য ব্লগার সবুজ কে ধন্যবাদ না দিয়ে পারলাম না। আল্লাহ এই বিদ্ব্যান ব্যক্তিকে ক্ষমা করুন এবং জান্নাত নসীব করুন।
পরিবেশ বিষয়ে তার সহজসরল লিখা আমার মত অনেক সল্পজ্ঞানিকে শিক্ষিত ও অনুপ্রানিত করেছে এই বিষয়ে। তিনি তথাকথিত পরিবেশ বাদিদের মত মুখ সর্বস্ব ছিলেননা। ইউক্যালিপটাস,একাশিয়া জাতিয় গাছ লাগানর প্রতিবাদ করায় সরকারি প্রশাসন এর কাছে তিনি অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু কোন কিছুর স্বার্থেই শিক্ষা ও আদর্শকে বিসর্জন দেননি।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
আপনাকে ধন্যবাদ সবুজ ভাই ।
আল্লাহ তিনাকে ক্ষমা করুন আমিন।
ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন