ডি-ডে এর সত্তর বছর পুর্তি এবং ইতিহাসের দায়।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৬ জুন, ২০১৪, ০৪:৩৭:৪৩ বিকাল
ডি-ডে শব্দটি সামরিক পরিভাষায় কোন অভিযান এর জন্য নির্ধারিত সময় কে বুঝায়। কিন্তু ইতিহাসের একটি দিনের সাথে এখন এই শব্দটি একাত্ম হয়ে গিয়েছে। সেই দিনটি হলো ৬ই জুন ১৯৪৪। সেই দিন দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এলাইড অর্থাত মার্কিন নেতৃত্বাধিন মিত্রশক্তি এক্সিস তথা মুলত জার্মানির নিয়ন্ত্রনে থাকা উত্তর ও পশ্চিম ইউরোপের ভুমিতে অবতরন করে। এই দিনটিকে দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির শুরু এবং জার্মানির পরাজয়ের শুরু হিসেবেই দেখা হয়। যদিও এর আগেই জার্মানি আফ্রিকা,সিসিলি ও ইতালিতে পরাজিত হয়েছে। ডি-ডের আগেই ইতালি আত্মসমর্পন করেছিল এবং জাপান এর পক্ষে জার্মানির সাথে কোনরকম সহযোগিতা দেয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। সুতারাং কেবলমাত্র হিটলারের নেতৃত্বাধিন জার্মান রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে এ ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র,বৃটেন,ফ্রান্স এর কেন্দ্রিয় নেতৃত্বে আরো অনেকগুলি রাষ্ট্রের মিলিত অভিযান। ফ্রান্স জার্মানির দখলে আসার পরেই হিটলার ফ্রান্সের উত্তর উপকুলে ইংলিশ চ্যানেল এর কূলে একটি দুর্ভেদ্য প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। ডি-ডের সময় এই প্রতিরক্ষা লাইনে ৫০ টির বেশি ডিভিশন ছিল যার মধ্যে বেশ কয়েকটি সাঁজোয়া বা প্যাঞ্জার ডিভিশন ও ছিল। এই ফ্রন্ট এর নেতৃত্বে ছিলেন জার্মানির শ্রেষ্ঠ দুইজন সেনানায়ক ফিল্ড মার্শাল ফিল্ড মার্শাল গার্ড ভন রুনষ্টেড এবং ফিল্ড মার্শাল আরউইন রোমেল। এই প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কে পরাজিত করে ফ্রান্সকে মুক্ত এবং এরপর জার্মানিকে পরাজিত করার জন্য পরিকল্পনা প্রনয়ন করা হয় দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে। ১৯৪৪ সালে বৃটেন এর মাটিতে এই জন্য নিয়োজিত মার্কিন সৈন্যদের পরিমান দাড়ায় বৃটিশ সৈন্যদের দ্বিগুন। অন্যদিকে বেশিরভাগ বৃটিশ সৈন্যই তখন নিয়োজিত ছিলেন আফ্রিকা ও ভারতে উপনিবেশ রক্ষার কাজে।
ডি-ডে এর লক্ষ স্থল নির্ধারন করা হয় ফ্রান্সের নরমান্ডিতে। নরমান্ডি এর পুর্বেও কয়েকটি বড় যুদ্ধের ক্ষেত্র হয়েছিল। এই জন্য যে পরিমান সৈনিক ও সরঞ্জাম জড়ো করা হয়েছিল তা ইতিহাসের সর্বোচ্চ। এই অভিযানের প্রধান নিয়োজিত হন মার্কিন জেনারেল আইসেনহাওয়ার। অন্যান্য সেনানায়ক দের মধ্যে ছিলেন বৃটিশ ফিল্ডমার্শাল বার্নাড মন্টোগোমারি, এয়ার মার্শাল আর্থার টেডার, অ্যাডমিরাল বার্ট্রাম র্যামসে, মার্কিন জেনারেল জর্জ প্যাটন,জেনারেল ওমর ব্রাডলি এবং ফ্রি ফ্রান্স এর নেতা শার্ল দ্য গল। এই অভিযানের আরো অংশ নেয় ফ্রান্সের অভ্যন্তরের মুক্তিযোদ্ধারা যাদেরকে ফ্রেঞ্চ রেজিষ্টেন্স বলা হতো। এই অভিযানে তাদের অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ন ভূমিকা ছিল। তারা প্রথম অবতরনকারি কমান্ডোদের জন্য নিরাপদে অবতরন নিশ্চিত করে এবং রেললাইন,ব্রিজ ইত্যাদি উড়িয়ে দিয়ে জার্মানদের সহায়তায় অতিরিক্ত বাহিনি আসার পথ রুদ্ধ করে দেয়। অভিযানের জন্য মার্কিন,বৃটিশ,কানাডিয় এবং ফরাসিদের ভিন্ন ভিন্ন এলাকা ভাগ করে দেয়া হয় যাতে কোন রকম পারস্পরিক প্রতিযোগিতা জনিত সমস্যা না হয়। কমান্ডো দের প্যারাসুটের মাধ্যমে অবতরন এবং কিছু গুরুত্বপুর্ন পয়েন্ট দখলের মাধ্যমে অভিযানের সুচনা হয়। এরপর বোমারু বিমানের বোমাবর্ষন এবং নেীবাহিনির গোলাবর্ষন এর মাধ্যমে জার্মান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কে দুর্বল করে সৈনিকেরা নরমান্ডি উপকুলের পাচটি সৈকত যে সৈকতগুলিকে এখন সেই অভিযানের কোডনেম অনুসারে উটাহ,ওমাহা,গোল্ড, জুনো ও সোর্ড নামে ডাকা হয় সেই সৈকতগুলিতে অবতরন করে। প্রচুর হতাহত সত্বেয় ২৪ ঘন্টার মধ্যেই অবতরনকারি বাহিনি শেরবার্গ বন্দর সহ উপকুলিয় অঞ্চল দখল করতে সক্ষম হয়। হিটলার দ্রুত প্রতি আক্রমন করতে সক্ষম না হওয়ায় মিত্রবাহিনি এই সামান্য উপকুলিয় অঞ্চল কে কেন্দ্র করে অভিযান চালিয়ে ফ্রান্স মুক্ত করতে সক্ষম হয়।
৬ই জুন ডি-ডে তথা নরম্যান্ডি ল্যান্ডিং ফ্রান্স,বেলজিয়াম সহ জার্মানির দখলিকৃত এলাকা মুক্ত করতে এবং রাশিয়ার উপর থেকে জার্মানির চাপ কমাতে সাহাজ্য করেছিল। কিন্তু হিটলার ও জার্মানিকে পরাজিত করার একক কৃতিত্ব মিত্রবাহিনিকে দেয়া হয়ে থাকে। যদিও জার্মানিকে পরাজিত করার পিছনে ইঙ্গ-মার্কিন বাহিনির থেকে মার্শাল জর্জি ঝুকভ এর নেতৃত্বাধিন সোভিয়েট সেনাবাহিনি তথা রেডআর্মির অবদান অনেক বেশি। কিন্তু মার্কিন প্রভাবিত মিডিয়া এই জন্য সোভিয়েট ইউনিয়ন এর অবদান কে একেবারেই কম করে দেখিয়ে এসেছে এবং এখনও তাই করছে।
আজকে ডি-ডের ৭০ তম বার্ষিকি উপলক্ষে বৃটেন ও ফ্রান্সে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজিত হচ্ছে। ফ্রান্সের অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা যোগ দিয়েছেন। এই অনুষ্ঠান গুলির একটি বিশেষ উল্লেখযোগ্য যে মার্কিন ও ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান ছাড়া এই অনুষ্ঠানে বিশেষ সন্মানের সাথে আর যারা আছেন তারা হচ্ছেন এই ডি-ডের অভিযানে অংশগ্রহনকারি প্রাক্তন সৈনিকেরা এবং নিহতদের পরিবারবর্গ। সেই সঙ্গে কয়েকজন ধর্মিয় নেতা। অনুষ্ঠানটিকে অসাম্প্রদায়িক! করার কোন লক্ষন দেখা যাচ্ছেনা। ইংল্যান্ড এর অনুষ্ঠান টিও অনুষ্ঠিত হচ্ছে ওয়েস্টমিনিষ্টার চ্যাপেল এ।
ডি-ডে নিয়ে অনেক বই রচিত হয়েছে এবং নির্মিত হয়েছে চলচ্চিত্র। এর মধ্যে আইরিশ সংবাদিক কর্নেলিয়াস রায়ান এর লিখা ”দি লংগেস্ট ডে” এবং এই বই অনুসরন করে নির্মিত একই নামের চলচ্চিত্র উল্লেখযোগ্য। এছাড়া আরো অনেক মুভিই এই দিনটির ঘটনাগুলিকে কেন্দ্র করে নির্মিত হয়েছে।
আমি খুব ছোট থাকতেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে মুভি অফ দ্য উইক অনুষ্ঠানে ”দি লংগেষ্ট ডে” ছবিটি দেখি। তখন সব কিছু না বুঝলেও ভাল লেগেছিল। পরে অনেক সময় চিন্তা করেছি আমাদের মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে এই ধরনের কোন মুভি কেন নির্মিত হয়নি? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত প্রায় সকল মুভিরই প্রধান কাহিনি দেখেছি নারি ভিত্তিক এবং আবেগ আশ্রিত। সেখানে যোদ্ধাদের জিবন কিংবা যুদ্ধের কাহিনির স্থান অতি সল্প। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এর অবস্থাও তাই। মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানি তার এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত যত বই পরেছেন কোনটাতেই সত্য নাই। আছে শুধু মুক্তিযুদ্ধের রুপকথা।
আমরা আর কতদিন অপেক্ষায় থাকব সেই বই আর মুভিটির জন্য যেখানে রুপকথার আবেগ,নারি নির্যাতনের নামে সুরসুড়ি আর রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য কাউকে ছোট করার বদলে সত্য ইতিহাস কে ঐতিহাসিকের নির্লিপ্ততায় উপস্থাপন করা হবে।
বিষয়: বিবিধ
৪৮৫৯ বার পঠিত, ২৮ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
রিপু মুক্ত হতে পারব।
অবশ্য এটা আর হতেও পারবনা।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
কিছু জানতে পারলাম
লিখে যান আপনার
মতো
||
ধন্যবাদ।
মানুষ স্বভাবতই নিরপেক্ষ হতে পারেনা। কিন্তু একজন ঐতিহাসিক ইতিহাস গবেষনায় নির্লিপ্ত হবেন। উদাহরন হিসেবে স্যার যদুনাথ সরকার এর কথা বলা যায়। তিনি তার আওরঙ্গজেব এর ইতিহাসে সিদ্ধান্ত হিসেবে আওরঙ্গজেবের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু ঐতিহাসিক ধারাক্রম এর বিবরন দিয়েছেন পুর্ণ নিরপেক্ষভাবে।
ইতিহাস অধ্যয়ন ও শিক্ষার জন্য আর পাতিহাস খাওয়ার জন্য এটা মনে রাখা প্রয়োজন।
আমাদের মু্ক্তিযুদ্ধ নিয়ে এ ধরনের কাহিনী নিয়ে ছবি নির্মিত না হওয়ার কারণ হচ্ছে যারা মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের ধারণা ছিল না দেশকে আসলে স্বাধীন করার জন্য পাকিস্তানীদের থেকে আলাদা করা হচ্ছে নাকি অন্য কোন দেশের আশ্রিত পরাধীন হওয়ার জন্য পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়ার জন্য যুদ্ধ করছে? আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আসলে কি জন্য কি কারণে সংঘঠিত হয়েছি তার প্রকৃত কারণ নির্ণয় করা গেলেই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কালজয়ী মুভি অথবা ডকুমেন্টরী নির্মিত করা সম্ভব।
ইতিহাস গবেষনায় দৃষ্টিভঙ্গি থাকতে পারে কিন্তু ঘটনা পরম্পরা তে মিথ্যা থাকতে পারবেনা।
আপনার বাছাইকৃত লেখা গুলো এক সাথে করে একটি বই বের করলে কিন্তু চমৎকার হবে!
একই প্রসঙ্গে কিংবা প্রয়োজনিয় ডিটেইল লেখা তো নাই। তাই বই এর ব্যাপারে এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন