নজরুল এবং ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২৫ মে, ২০১৪, ১১:০৭:২০ রাত
৪৯ বেঙ্গলি রেজিমেন্ট নামক একটি পদাতিক রেজিমেন্ট গঠিত হয়েছিল এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেছিল সেটা বোধহয় আমাদের ইতিহাস থেকে একেবারেই মুছে যেত। যায়নি তার প্রধান কারন হলো এই পল্টন এর সাথে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের সকল মানুষের হৃদয়ে স্থান পাওয়া একটি নাম। কাজি নজরুল ইসলাম। ৪৯ নং বেঙ্গল রেজিমেন্ট যাকে বাঙ্গালি পল্টন নামে সমসাময়িক পত্রপত্রিকাতে সম্বোধন করা হতো। এই বাঙ্গালি পল্টন ছিল কবি নজরুল এর কবি হয়ে উঠার জায়গা। নজরুল কবি এবং সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন তার এই পল্টন জিবনেই। সেই সঙ্গে তার নিজেরও বিভিন্ন ভাষা শিখা এবং আন্তর্জাতিক সাহিত্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ও সুযোগ হয়েছিল এই পল্টন জিবনে। নজরুলের কথা সাহিত্যে তার এই পল্টন জিবনের স্মৃতি খুবই প্রভাব বিস্তার করেছে। নজরুল ছাড়াও আরো কয়েকজন খ্যাতনামা বাঙ্গালি সাহিত্যিক এই পল্টনের সাথে জড়িত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কথা-সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম এবং কবি সুফি জুলফিকার হায়দার। সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম এর ”পল্টন জিবনের স্মৃতি” এই পল্টনের ইতিহাস জানার জন্য এখনও প্রধান প্রাথমিক উৎস।
মেকলের নিতি অনুসারে ভারতে বৃটিশরা মার্শাল রেস ও নন-মার্শাল রেস নামে বিভিন্ন জাতিকে বিভক্ত করে। এর পিছনে কোন বৈজ্ঞানিক যুক্তি ছিলনা। ছিল বৃটিশদের কুখ্যাত ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি। বাঙ্গালি জাতিকে(এ লেখায় বৃটিশ ভারতের বাংলা প্রদেশের অধিবাসি অর্থে বাঙ্গালি ব্যবহার করা হয়েছে) নন মার্শাল রেস হিসেবে ধরা হয় এবং সশস্ত্রবাহিনিতে বাঙ্গালিদের নিয়োগের অযোগ্য ঘোষনা করা হয়। ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে প্রয়োজনিয় সৈনিক এর অভাব দেখা দেয় এবং তৎকালিন পত্রপত্রিকাতে বাঙ্গালিদের নিয়োগের জন্য দাবি উঠে। ১৯১৪-১৫ সালে একটি স্চ্ছোসেবক আধাসামরিক বাহিনি "বেঙ্গল এম্বুলেন্স কোর" গঠিত হয়। এটি মুলত মেডিকেল কোর এর একটি ইউনিট ছিল। এর সদস্যদের বেতন সাধারন মানুষের চাঁদায় গঠিত একটি ফান্ড থেকে দেয়া হতো। মেডিকেল ও নার্সিং প্রশিক্ষন ছাড়াও যুদ্ধক্ষেত্রে মেডিকেল সহায়তা দেয়ার প্রয়োজনে কিছু সামরিক প্রশিক্ষন ও তাদের দেয়া হতো। এই সেনাদল মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ ক্ষেত্রে সাফল্য লাভ করে। বিখ্যাত ”কুত উল আমারা”(সাদ্দাম হোসেনের এর জন্মভুমি আল কুত শহর) যুদ্ধে এই ইউনিট এর অনেকে জেনারেল টাউন্ডসেন্ড এর সাথে আত্মসমর্পন করে ও তুর্কি বাহিনির হাতে বন্দি হয়। এই ইউনিট এর সাফল্য একটি নিয়মিত পদাতিক সৈন্যদল গঠনের দাবিতে দৃঢ করে। ১৯১৬ সালে তৎকালিন বৃটিশ ভারতিয় সরকার একটি বাঙ্গালি পল্টন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ি প্রথমে একটি কোম্পানি এবং তারপর নিয়মিত রেজিমেন্ট গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয়। সৈনিক জিবনে প্রথমবারের মত সুযোগ হিসেবে অনেক উচ্চ শিক্ষিত ওসম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষ ও তখন সাধারন সৈনিক হিসেবে এই পল্টনে যোগ দেন। যার মধ্যে ঢাকার নবাব খাজা হাবিবুল্লাহ বাহদুর এবং কুমার অধিক্রম মজুমদার ছিলেন। সুভাস চন্দ্র বসু ও চেষ্টা করেছিলেন তবে দৃষ্টিশক্তির পরিক্ষায় উত্তির্ন হতে পারেননি। রিক্রুটমেন্ট এর পর নৈীশেরা সেনানিবাসে এর প্রশিক্ষন শুরু হয়। পরে এই ইউনিটকে করাচিতে স্থানান্তর করা হয়। প্রশিক্ষন এবং একটি পুর্ণাঙ্গ ব্যাটালিয়ন গঠন এর পর ১৯১৭ সালে এই পল্টন কে মেসোপটেমিয়া অর্থাত বর্তমান ইরাকে প্রেরন করা হয়। এই্ ব্যাটালিয়ন ইরাকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত অবস্থান করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির পর কুর্দিস্থান অভিযানেও এই ইউনিট অংশ নেয়। কিন্তু বিভিন্ন কারন দেখিয়ে ১৯২০ সালে এই রেজিমেন্ট ভেঙ্গে দেয়া হয়। এরপর দ্বিতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইন্ডিয়ান পাইওনিয়ার কোর গঠিত হওয়ার আগে বাঙ্গালিদের সৈনিকবৃত্তি গ্রহন বেশ কঠিন ছিল।
কবি কাজি নজরুল ইসলাম ১৯১৭ সালে রানিগঞ্জ শিয়ারশোল হাই স্কুল এর দশম শ্রেনির ছাত্র থাকার সময় তার বন্ধু সাহিত্যিক,চিত্রপরিচালক শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় সহ ফোর্ট উইলিয়াম এ বাঙ্গালি পল্টনে যোগ দিতে যান। শৈলজানন্দর মতে বিদ্রোহি এ্ তরুন পৃথিবিকে দেখার ও দেশকে বিদেশি শাসন থেকে মুক্ত করার উদ্দেশ্যেই সেনাবাহিনিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। নজরুল নির্বাচিত হন। শৈলজানন্দ ব্যার্থ হন। নজরুল করাচিতে প্রশিক্ষন নেন। ইতমধ্যে ১ম ব্যাটালিয়ন পুর্ন হওয়ার কারনে অবশিষ্ট সৈনিকদের করাচিতে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়। নজরুল সেখানেই রয়ে যান। পরবর্তি ব্যাটালিয়ন তৈরির জন্য প্রচুর রিক্রুট ও প্রশিক্ষন দেয়া হলেও মধ্যপ্রাচ্যে ১৯১৭ সালে যুদ্ধের চাপ কমে যাওয়ায় তা আর গঠন করা হয়নি। এই করাচি বাস নজরুলের জিবনে অনেক প্রভাব ফেলে। তিনি এখানে আরবি,ফার্সি ও উর্দু ভাষা শিক্ষা লাভ করেন। সেনাবাহিনিতে বিতরন করা বই থেকে আধুনিক সাহিত্য পড়ার সুযোগ পান। করাচি থেকেই ”সওগাত”,”বঙ্গিয় মুসলিম সাহিত্য পত্রিকা” সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকাতে লেখা পাঠাতেন তিনি। নিজের কাজেও দক্ষ ছিলেন তিনি। সহযেই তিনি ল্যান্স নায়েক.নায়েক হয়ে হাবিলদার হন। কোয়ার্টার মাষ্টার হাবিলদার হিসেবে প্রমোশন হয় তার। এই পদ এখনও বাংলাদেশ সহ পৃথিবির প্রায় সকল সেনাবাহিনির কোম্পানি পর্যায়ে আছে। ১৯২০ সালে পল্টন ভেঙ্গে দেয়ার সিদ্ধান্তের পর ১৯২১ সালের প্রথম দিকে অবসর পেয়ে তিনি কলকাতায় আসেন। ততদিনে তিনি হাবিলদার কবি কাজি নজরুল ইসলাম নামে খ্যাত হয়ে গিয়েছেন।
দির্ঘদিন এই বাঙ্গালি পল্টন এবং এখানে কাজি নজরুল ইসলামের জিবন নিয়ে প্রয়োজনিয় গবেষনা হয়নি। নজরুল বিশেষজ্ঞ ও বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপক ১৯৯৪ সালে “মেসোপটেমিয়ায় নজরুল” নামের একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। যেখানে কয়েকটি তথ্যের উপর নির্ভর করে তিনি দাবি করেন নজরুল ইরাকে গিয়েছিলেন। যদিও সাম্প্রতিক মুহাম্মদ লুৎফুল হক এর গবেষনায় এটা প্রমানিত হয়েছে যে নজরুল মেসপটেমিয়াতে জাননি। নজরুল এর সমসাময়িক হলেও আরেক বিখ্যাত সাহিত্যিক মাহবুবুল আলম এর সাথে তার পল্টনে পরিচয় হয়নি। কারন মাহবুবুল আলম নজরুলের আগে যোগদেন এবং নজরুল করাচি পেীছার আগেই ইরাকে চলে যান। ফিরে আসেন ১৯২১ সালের শেষের দিকে। ততদিনে নজরুল অবসর নিয়েছেন। তিনিও নজরুল যুদ্ধের পুরো সময় করাচিতে ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেছেন। নজরুলের ”ব্যাথার দান” ও ”রিক্তের বেদন” এর উপন্যাস ও ছোটগল্পে ইরাক ও ভার্দুন এর যে বর্ননা দেয়া হয়েছে তা নজরুল তার কোন সহকর্মির কাছ থেকেও জানতে পারেন। নজরুল যে পদে কর্মরত ছিলেন সেই কোয়ার্টার মাষ্টার হাবিলদার এর দায়িত্ব সৈনিকদের খাবার এবং বিভিন্ন জিনিস এর ব্যবস্থাপনা। বিভিন্ন সময় সাময়িকভাবে পল্টনের ছাউনিতে আশ্রয় নেয়া অন্য পল্টনের সৈনিকদের জন্যও খাবার এর ব্যবস্থা করা এই পদাধিকারির দায়িত্বের মধ্যে পরে। সুতারাং এটা অসম্ভব নয় যে ফ্রান্স ও ইরাকের যুদ্ধে অংশগ্রহনকারি পাঞ্জাব বা বেলুচ রেজিমেন্ট এর কারো কাছ থেকে শুনে নজরুল ঘটনাগুলি তার সাহিত্যে রুপায়ন করেছেন।
৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন এর প্রায় ৯৮ বছর পার হলেও দির্ঘদিন এর ইতিহাস নিয়ে কোন গবেষনা হয়নি। এর জন্য প্রয়োজনিয় উপকরন পাওয়া ও দুস্কর। একমাত্র প্রতক্ষদর্শির বিবরন যেটা পাওয়া যায় তা কথাশিল্পি মাহবুবুল আলম এর ”পল্টন জিবনের স্মৃতি” সেটাও অনেক দিন আউট অফ প্রিন্ট।
অতিসম্প্রতি ২০১২ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনির সাবেক অফিসার লেঃকর্নেল(অবঃ) মুহাম্মদ লুৎফুল হক ”বাঙ্গালি পল্টন” নামে একটি বই রচনা করেছেন। যেখানে এই পল্টনের ইতিহাস এর একটি রুপরেখা পাওয়া যায়। তবে এই গবেষনা প্রথানত এই রেজিমেন্ট টি গঠন এর ঘটনাগুলি নিয়ে সিমাবদ্ধ। কার্যক্ষেত্রে এর ইতিহাস সম্পর্কে প্রয়োজনিয় তথ্যের অভাবে বেশি আলোচনা করা যায়নি। এ্কই লেখক নজরুলের সামরিক জিবন সম্পর্কে ও একটি ছোট বই লিখেছেন।
৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং কবি কাজি নজরুল এর সামরিক জিবন সম্পর্কে এখনও অনেক তথ্য অনুদঘাটিত রয়েছে। আমরা আশা করি কোন নিরলস গবেষক আমাদের এই ব্যাপারে পুর্নাঙ্গ তথ্য প্রদান করবেন।
আমি বিদ্রোহি রণক্লান্ত
আমি সেইদিন হব শান্ত
যবে উৎপিড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবেনা
অত্যাচারির খড়গ-কৃপান ভিম রণভুমে রণিবে না .....
তথ্যসুত্র:
বাঙ্গালি পল্টন-মুহাম্মদ লুঃফুল হক, প্রথমা প্রকাশনি।
পল্টন জিবনের স্মৃতি,পল্টনে,রংবেরং-মাহবুবুল আলম। শেষ দুটি বই কোঅপারেটিভ বুক সোসাইটি থেকে প্রকাশিত।
ছবিঃ সৈনিকের পোষাকে নজরুল এর এই বহু পরিচিত ছবি টি "সওগাত" পত্রিকার অফিসে তোলা। সম্ভবত নজরুল এসময় ছুটিতে কলকাতা এসেছিলেন। অবসর নেয়ার পর ইউনিফর্ম ও র্যাংক সহ পোষাক তার কাছে থাকার কথা নয়। অন্যদিকে যুদ্ধচলাকালিন সময়ে ছুটিতে থাকলেও ইউনিফর্ম পরে থাকাই নিয়ম। ছবিতে নজরুলের ডানহাতে হাবিলদার পদের র্যাংক চিন্হ সুস্পস্ট।
বিষয়: বিবিধ
১৯৭৪ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ।
আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের জাতিয় কবির একটি পুর্নাঙ্গ জিবনি প্রনয়ন এর কোন উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি।
নজরুল কে ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে এই জন্যই যে যাতে করে বাংলাদেশ এর পরিবর্তে আমরা মহান ভারত!! এই চেতনায় আবিষ্ট হই।
মন্তব্য করতে লগইন করুন