দয়ানন্দ স্বরস্বতি থেকে নরেন্দ্র মোদি। ভারতে হিন্দুতার উত্থান।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৭ মে, ২০১৪, ১২:১৩:৩৪ রাত
ভারতের ইতিহাসে দ্বিতিয় সর্বোচ্চ আসন জয় করে বিজেপি নেতৃত্বাধিন জোট দিল্লির ক্ষমতা দখল করেছে। ভারতের ৬৭ বছরের ইতিহাসে এবং দলের ১২৯ বছরে এইবারই কংগ্রেস সবচেয়ে বড় পরাজয় বরন করেছে। এমনকি ১৯৭৭ সালের পরাজয় ও এত খারাপ অবস্থা ছিলনা। অনেকদিন পর একটি দল ভারতের পার্লামেন্ট এর একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। যার ফলে বিজেপি সরকার গঠন ও নিতিমালা বাস্তবায়নে আঞ্চলিক দলগুলির উপর নির্ভরশিল হবেনা। আর বিজেপির এই বিজয়ের পিছনে রুপকার হিসেবে যার নাম আছে তিনি হচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি। ২০০২ সালে গুজরাটের নির্মম মুসলিম হত্যাকান্ডের রুপকার হিসেবে যার নাম বিশ্বের সবাই যানে। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসম্প্রদায়িকতার শ্লোগান কে মিথ্যা প্রমান করে ভারতের মানুষেরা এই ব্যাক্তির প্রতিই তাদের সমর্থন ব্যাক্ত করেছে। যদিও তার এই সমর্থন প্রধানত উত্তর ভারতেই সিমাবদ্ধ।
ভারতের হিন্দু জাতিয়তাবাদের ইতিহাস অতি প্রাচিন। বিশেষ করে বাংলা এবং মহারাষ্ট্রকেই এর জন্মদাতা হিসেবে ধরা হয়। এটা নিঃসন্দেহ সত্য যে বৃটিশ ওপনিবেশিকদের প্রতি শুরু থেকেই বাংলার হিন্দু শিক্ষিত শ্রেনি সমর্থন ব্যাক্ত করে আসছিল। ১৮৮৫ সনে বৃটিশ আইসিএস অফিসার হিউম এর চেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতিয় জাতিয় কংগ্রেস। ঠিক এই সময়ই স্বামী দয়াননন্দ স্বরস্বতি প্রতিষ্ঠা করেন আর্য সমাজ। যার উদ্দেশ্য ছিল ভারতের আর্য যুগের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা। ১৯০৬ সালে বঙ্গভঙ্গ বা পুর্ব বাংলা ও আসামকে নিয়ে নতুন প্রদেশ প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে হিন্দু শিক্ষিত শ্রেনি তাদের কায়েমি স্বার্থ রক্ষায় যে আন্দোলন গড়ে তুলে তার সমর্থনে বাংলায় গঠিত হয় সন্ত্রাসবাদি আন্দোলন। এই আন্দোলন সমসাময়িক ইউরোপ ও রাশিয়ার এনার্কিষ্ট ও নিহিলিষ্ট দর্শন দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই আন্দোলনের সদস্যদের কালি মুর্তির সামনে নিজের রক্ত বিসর্জন করে শপথ করতে হতো। এই আন্দোলনে কোন মুসলিমকে নেওয়া হতোনা এবং সত্যিতে মুসলিমরাই ছিল তাদের প্রতিপক্ষ। অনুশিলন ও যুগান্তর সমিতির নামে হিন্দু যুবকদের এই সন্ত্রাসবাদি আন্দোলন ১৯১১ সালে নতুন প্রদেশ বাতিল করে বাংলাকে এক রেখে বিহার ও আসামকে সতন্ত্র প্রদেশ হিসেবে সৃষ্টি করতে বাধ্য করে। আর্যসমাজ, মহারাষ্ট্রে বালগঙ্গাধর তিলক এর শিবাজি উৎসব ইত্যাদি যে হিন্দুত্ববাদি ধারার জন্ম দেয় সেটা প্রবল প্রভাব বিস্তার করে ভারতিয় কংগ্রেস এর উপর। কংগ্রেস এর উপর চাপ সৃস্টিকারি সংগঠন হিসেবে ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় হিন্দুসভা যা পরবর্তিতে হিন্দু মহাসভা নামে পরিচিত হয়। এর সংগঠক দের মধ্যে অন্যতম ছিলেন পন্ডিত মদনমোহন মালব্য এবং লালা লাজপত রায়। এরা উভয়ই কংগ্রেস এর প্রথম সারির নেতা ছিলেন। হিন্দু মহাসভা ধিরে ধিরে কংগ্রেস এর উপর তার প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হয়। এই হিন্দু মহাসভার সশস্ত্র শাখা হিসেবে ১৯২৫ সালে কেসব বলরাম হেডগেওয়ার প্রতিষ্ঠা করেন আরএসএস বা রাষ্ট্রিয় স্বয়ংসেবক সংঘ। ডাঃ হেডগেওয়ার কলকাতা মেডিকেল এর ছাত্র থাকাকালিন যুক্ত ছিলেন অনুশিলন সমিতির সাথে। তার সাথে আরো ছিলেন রাকেস সিনহা, এমএস গোলওয়ার সহ অনেকে।
আরএসএস ই প্রথম মুসলিমদের বিরুদ্ধে সংগঠিত দাঙ্গার সুচনা করে। ভারতের স্বাধিনতা আন্দোলনের অগ্রগতির সাথে সাথে কংগ্রেস এর উপর এই দুই সংগঠনের প্রভাব বৃদ্ধি পেতে থাকে। ইতঃমধ্যে মহাত্মা গান্ধি কংগ্রেস এর প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভুত হন। বিশুদ্ধ হিন্দুত্ববাদি গান্ধি প্রথমে এই সংগঠনগুলির প্রিয় থাকলেও তার কিছু নিতি যথা জাতপাতের বিলোপ এবং সামাজিক ন্যায়বিচার ইত্যাদি প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতদৈত্বতার সৃষ্টি হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে স্বাধিনতা লাভ করে। কিন্তু এই স্বাধিনতার সাথে সাথে আরএসএস এর উদ্যোগে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃস্টি হয়। ভারত ভাগের সাথে সাথে একসময় এর একক দুটি প্রদেশ পাঞ্জাব এবং বাংলাকেও বিভক্ত করা হয়। যদিও মুসলিম লিগ এই উভয় প্রদেশের বিভক্তির বিরুদ্ধে ছিল। শেষ মুহুর্তে বাংলা কংগ্রেস এর কিছূ নেতা বাংলাকে এক রেখে একটি স্বাধিন রাস্ট্র গঠন এর জন্য মুসলিম লিগ এর সাথে মিলিত হয়ে চেষ্টা করেন। কিন্তু কংগ্রেস এর হাই কমান্ড এই দাবি মানেনি। বরং তৎকালিন হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বলেন যে ভারত ভাগ হোক বা না হোক বাংলাকে অবশ্যই ভাগ করতে হবে।
১৯৪৮ সালে ৩০শে জানুয়ারি মহাত্মা গান্ধিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকান্ড এর সাথে জড়িতরা সকলেই ছিলেন আরএসএস এর সাথে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু তাদেরকে প্রচুর সহায়তা করেন তৎকালিন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রি সরদার বল্লভভাই প্যাটেল। এর প্রতিক্রিয়াতে আরএসএস কে সাময়িকভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। হিন্দু মহাসভাও কিছূটা সমস্যার মুখোমুখি হয়। এঅবস্থায় ১৯৫১ সালে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির নেতৃত্বে গঠিত হয় অখিল ভারত জনসংঘ। জনসংঘ নির্বাচনে সাফল্য লাভ করতে সক্ষম না হলেও তার প্রভাব বিস্তার করতে সমর্থ হয়। ১৯৬৪ সালে জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর ভারতিয় কংগ্রেস তার জনপ্রিয়তা হারাতে থাকে। এই জনপ্রিয়তা উদ্ধারে নেহরু কন্যা ইন্দিরা গান্ধিকে প্রধান মন্ত্রি করা হয়। পাকিস্তান ভাঙ্গা,সিকিম দখল এবং পারমানবিক বোমার অধিকারি হওয়া ইন্দিরা গান্ধিকে স্বৈরাচারি করে তুলে। তিনি ১৯৭৫ সালে কুখ্যাত জরুরি অবস্থা জারি করে ভারতের একক শাসক হয়ে উঠেন। ১৯৭৭ সালে ভারতে যখন নতুন নির্বাচন হয় তখন জনসংঘের সভাপতি ছিলেন লালকৃষ্ন আদভানি। জনসংঘ তখন কংগ্রেস বিরোধি একক দল মোরারজি দেশাই এর নেতৃত্বে জনতা পর্টিতে মিশে যায়। ৭৭ সালের নির্বাচনে প্রথমবারের মত দিল্লির ক্ষমতা হারায় কংগ্রেস। দেশাই মন্ত্রি সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রি হন জনসংঘ নেতা অটলবিহারি বাজপেয়ি এবং তথ্যমন্ত্রি হন লাল কৃষ্ন আদভানি। ১৯৮০ সালে জনতা পার্টি ভেঙ্গে গেলে প্রাক্তন জনসংঘ সদস্যরা গঠন করেন ভারতিয় জনতা পার্টি। ইন্দিরা গান্ধির মৃত্যুর পর অনুষ্ঠিত ১৯৮৪ সালের নির্বাচনে প্রথম অংশ গ্রহন করে দুই টি আসন পায় বিজেপি। ১৯৮৯ সনে অনুষ্ঠিত ৯ম লোকসভা নির্বাচন থেকে বিজেপি ভারতের গুরুত্বপুর্ন দল হিসেবে পরিনিত হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে লোকসভায় সর্ববৃহত দল হতে সমর্থ হলেও প্রয়োজনিয় সংখ্যক সদস্যের সমর্থন না পাওয়ায় ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময় তথা ১৩ দিনের জন্য সরকার গঠন করে বিজেপি। ১৯৯৮ সালে বিজেপি জোটবদ্ধ ভাবে সরকার গঠনে সমর্থ হয়। যা প্রথম অকংগ্রেসি সরকার হিসেবে তার মেয়াদ পুর্ন করতে সমর্থ হয়। কিন্তু ২০০৪ থেকে পরবর্তি দুটি নির্বাচনেই বিজেপি সরকার গঠনে ব্যার্থ হয়।
এই ব্যর্থতা থেকে উত্তরনে বিজেপি বেছে নেয় হিন্দুতা কে প্রতিষ্ঠিত করার আদর্শ। ২০০২ সালে গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির সরকারের সহায়তায় একটি বিরাট মুসলিম বিরোধি দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। কিন্তু এর পর আরো ভাল ভাবে নরেন্দ্রমোদি প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ি হন। নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রি পদে প্রার্থি করে ২০১৪ সালের নির্বাচনি প্রচারনা শুরু করে বিজেপি। আর সাফল্য পায় কল্পনাতিত। নরেন্দ্রমোদি হিন্দুতার পাশাপাশি ব্যবহার করেন তার গুজরাটের শিল্পায়ন বা উন্নয়ন এর সাফল্যের কথা। যদিও ভারতে গুজরাটে অশিক্ষা ও আত্মহত্যার হার সর্বোচ্চ। মিডিয়া এবং সাংস্কৃতিক ব্যাক্তিত্বদের পুর্ন সমর্থন পান মোদি। আন্তর্জাতিক ভাবে তার দাঙ্গাকারি বলে পরিচিতি সত্বেয় প্রায় ২০ বছর পর একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজেপি আত্ম প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছে।
অল্পদিন আগে প্রয়াত সাহিত্যিক তার ”এন্ড অফ ইন্ডিয়া” গ্রন্থে বিজেপির সাফল্য ভারতকে বিভক্তি ও সমাপ্তির পথে নিয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। এখন সারাভারতে একমাত্র দল হিসেবে বিজেপির আবির্ভাব কি ফলাফল বয়ে আনে তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে বিজেপির এই বিপুল সাফল্যজনক ফলাফলেও একটি বিষয় পরিস্কার যে ভারতে উত্তরভারত,দক্ষিন ভারত এবং পূর্বভারত এর মধ্যে বিভক্তি সুষ্পষ্ট।
বিষয়: বিবিধ
২৮১০ বার পঠিত, ১৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
আর তিনি যদি এসব বলেও থাকেন তাকে অন্ততঃ আপনার ধন্যবাদ দেয়া উচিত, কারন ৯০% হিন্দুর দেশে হিন্দু ধর্মের গুরত্বকে মুল্যায়ন করেছেন। নয় কি??
ধন্যবাদ সু্ন্দর মন্তব্যটির জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন