লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়ার ধ্বংস এবং হাইপেশিয়ার হত্যা।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৬ মে, ২০১৪, ০২:৩৭:০৪ রাত
লাইব্রেরি অফ আলেকজান্দ্রিয়া। এই নামটির সাথে পরিচিত অনেকেই। বর্তমান মিশরের উত্তর অংশে নিল নদের মোহনায় ভুমধ্যসাগরের তিরে অবস্থিত সুন্দর শহর আলেকজান্দ্রিয়া। যাকে আরবিতে ইস্কানদারিয়া ও বলা হয়। এই শহরটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে মনে করা হয় গ্রিক বির সম্রাট আলেকজান্ডার কে। প্রকৃতপক্ষে এই শহরটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন তারই এক সেনাপতি টলেমি সুটার যিনি পরবর্তিতে টলেমি ১ম নামে মিসরের শাসক হয়ে উঠেন। এই শাসক মিশরকে পৃথিবির শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিনিত করার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আলেকজান্দ্রিয়াতে প্রতিষ্ঠা করেন এই লাইব্রেরি। টলেমির বংশ প্রায় খ্রিষ্টপুর্ব ৩০০ সন থেকে খ্রিষ্টপুর্ব ৩০ সন পর্যন্ত শাসন করে মিশর। এই বংশের শেষ শাসক ক্লিওপেট্রা রোমান শাসক অক্টেভিয়ান এর আক্রমনের মুখে পরাজিত হয়ে আত্মহত্যা করেন। টলেমি আলেকজান্দ্রিয়াতে যে লাইব্রেরির সাথে যে সংগ্রহশালা স্থাপন করেন তা ছিল আধুনিক যাদুঘরের পূর্বপুরুষ। টলেমি এই লাইব্রেরির উন্নয়নে প্রচুর অর্থ ব্যয় করে প্রাচিন পান্ডুলিপি এবং প্যাপিরাস স্ক্রোল সংগ্রহ করে একে সম্বৃদ্ধ করে তুলেন। এটি হয়ে উঠে প্রাচিন বিশ্বের জ্ঞানিদের জন্য একটি বিশ্ববিদ্যালয়। লাইেব্রেরিটি সম্পর্কে যতটুক জানা যায় এখানে পাঠাগার ছাড়াও লেকচার হল,ডাইনিং,বাগান এবং মন্দির ছিল যা আধুনিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মতই। লাইব্রেরিটি ছিল গ্রিক শিল্পের দেবি মিউসেস এর প্রতি উৎসর্গিকৃত। প্রাচিন গনিতবিদ ইউক্লিড,আর্কিমিডিস, ইরিসতথনিস এর মত ব্যাক্তিরা এই লাইব্রেরি ব্যবহার করে শিক্ষা ও জ্ঞান লাভ করেছেন। প্যাপিরাস এর স্ক্রোল বা পুঁথি এবং পার্চমেন্ট এর লিখা অসংখ্য জ্ঞানের গ্রন্থ ছিল এই লাইব্রেরিতে। যার কোন হিসাব এখন আর পাওয়া যায়না। দ্বিতিয় টলেমি যিনি খ্রিস্টপুর্ব ২৪৬ সালে মৃত্যবরন করেন তার সময় যখন এই প্রতিষ্ঠানের প্রায় শৈশব সেসময় এখানে পাঁচলক্ষেরও বেশি পুঁথি ছিল বলে বলা হয়েছে। এরিস্টটল এর ছাত্র ডিমিট্রিয়াস ছিলেন এই লাইব্রেরির প্রথম পরিচালক। এই লাইব্রেরিতে শুধু গ্রন্থ সংগ্রহই করা হতোনা বরং বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করার ও ব্যবস্থা ছিল। মিশরে টলেমি বংশের শাসন পর্যন্ত এই লাইব্রেরি তার মর্যাদা বজায় রাখতে সমর্থ হয়।
খ্রিষ্টপুর্ব ৪৮ সালে জুলিয়াস সিজার তার ক্ষমতার দন্দের এক পর্যায়ে নেীযুদ্ধের সময় এই লাইব্রেরিতে আগুন ধরে যায়। সেই দিন থেকেই এর ধ্বংসের শুরু। তবুও অনেক সমস্যার মধ্যেই আরো প্রায় চারশত বছর এই লাইব্রেরি টিকে থাকে। ৩৯১ খ্রিষ্টাব্দে রোমান সম্রাট থিউডিয়াস খৃষ্টধর্ম বিরোধি সকল গ্রন্থ ধ্বংস করার আদেশ দেন। আলেকজান্দ্রিয়ার খৃষ্টিয় ধর্মগুরু তথা পেট্রিয়ার্ক থিউফিলাস এই আদেশ এর সাথে সকল ইহুদি এবং প্যাগান বা প্রকৃতিপুজারিদের হত্যার আদেশ ও জারি করেন। আলেকজান্দ্রিয়ার রাজপথে সেদিন বহ্নুৎসব করে ধ্বংস করা হয় ছয় শতাব্দির সঞ্চিত জ্ঞান কে। একটি সামান্য অংশ যা সিরামপিয়াম নামে পরিচিত ছিল কিছু গনিতের গ্রন্থ সহ গনিতবিদ থিওন রক্ষা করেন।
থিওন এর বিদূষি কন্যা ছিলেন হাইপেশিয়া। হইপেশিয়া এথেন্স এ শিক্ষা লাভ করেন এবং ৪০০ খ্রিস্টাব্দে সিরামপিয়াম এ দর্শন এর শিক্ষা দিতে শুরু করেন। এই বিদূষি নারিকে সমসাময়িক অনেক খৃষ্টান ঐতিহাসিক মুর্তিপুজারি বলে দাবি করেছেন। তবে আধুনিক ঐতিহাসিক দের মতে তিনি একজন আস্তিক তবে দর্শনবাদি ছিলেন। একজন উচ্চশিক্ষিতা হিসেবে সেই সময় এর খৃষ্টধর্ম তার সকল প্রশ্নের জবাব দিতে সক্ষম ছিলনা। হাইপেশিয়া প্রাচিন গ্রিক এরিস্টটল এবং প্লেটোর দর্শন এর উপর ভিত্তি করে তার শিক্ষার্থিদের শিক্ষা দিতেন। তৎকালিন মিশরের শাসক ছিলেন অরিস্টিস এবং পেট্রিয়ার্ক ছিলেন সিরিল। সিরিল একজন গোঁড়া খৃষ্টান ছিলেন। তিনি আলেকজান্দ্রিয়া থেকে উচ্ছেদ করেন ইহুদিদের। দর্শন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার কেন্দ্র সিরামপিয়াম হয় তার পরবর্তি লক্ষ। সিরিল এর নেতৃত্বে খৃষ্টান উগ্রবাদিরা তার বিরুদ্ধে শয়তানের উপাসনা এবং যুবকদের বিভ্রান্তকরার অভিযোগ আনে। কিন্তু হাইপেশিয়া ছিলেন এই ধরনের অশালিন অভিযোগের উর্দ্ধে। সাধারন মানুষ তার বিরুদ্ধে এই অভিযোগগুলি বিশ্বাস করেনি। অরিস্টিস রোমান সাম্রাজ্যের সাথে ইরানের যুদ্ধের সুযোগ নিয়ে স্বাধিন হওয়ার প্রয়াস নেন। কিন্তু তাতে ব্যার্থ হন। সিরিল এই সুযোগে হাইপেশিয়ার বিরুদ্ধে অরিস্টিসকে সহায়তা দেয়ার অভিযোগ আনেন এবং খৃষ্টান জনতাকে খেপিয়ে তুলেন। তার মৃত্যুর দিন হাইপেশিয়া যখন রথে চড়ে সিরামপিয়াম থেকে বের হয়ে আসেন তখন উগ্র খৃষ্টানজনতা তাকে ঘেরাও করে এবং রথ থেকে টেনে বের করে আনে। তাকে প্রকাশ্যে বিবস্ত্র করে এবং শয়তান এর উপাসনার অভিযোগে তাকে পুড়িয়ে মারতে উদ্যত হয়। তিনি অনেক কষ্টে একটি গির্জায় আশ্রয় নেন। কিন্তু সেই পবিত্র স্থানে একজন সেইন্ট! এর গদার আঘাতে মৃত্যুবরন করেন। হাইপেশিয়াকে শুধু হত্যা করেই সমাপ্ত হয়নি এই বিভৎসতার। তার দেহকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করা হয় এবং হাড় থেকে মাংস আলাদা করে প্রদর্শন করা হয়। শেষে তার দেহাবশেষ পুড়িয়ে ফেলা হয় এবং তাকে ধর্মেও শত্রু হিসেবে অভিশপ্ত ঘোষনা করা হয়। সৈয়দ আমির আলি তার ”স্পিরিট অফ ইসলাম ” গ্রন্থে এই ঘটনার ফলাফল এর সম্পর্কে লিখেছেন ”এই ভয়ংকর রোমহর্ষক কাজের উস্কানি দিয়েছিল যেই দানব,খ্রিষ্টান জগতে সে পেয়েছে শুদ্ধাত্বা ধর্মপুরুষের সন্মান , আর দেখা গেল হাইপেশিয়ার রক্তের প্রতিশোধ গ্রহন করেছে আমরু অর্থাত আমর বিন আস (রাঃ) এর তরবারিমাত্র”। হাইপেশিয়ার মৃত্যুর সাথে আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির শেষ চিহ্ন সিরামপিয়াম ও ধ্বংস করা হয়। দুঃখের বিষয় এখনও অনেক লেখক হাইপেশিয়াকে একজন মুর্তিপুজারি কিংবা উচ্চশ্রেনির ক্ষমতা লোভি নারি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করেন। তাকে এমনকি কেউ কেউ দেহব্যবসায়ি এবং উলঙ্গ নৃত্যকারি হিসেবে সাহিত্য ও চিত্রকর্মে চিত্রিতও করেছেন।
আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির ইতিহাস থেকে এটা সুষ্পষ্ট যে এই লাইব্রেরি ধ্বংস হয় ইসলামের আবির্ভাবের প্রায় দুইশ বছর পুর্বে। অথচ এখনও কিছু তথাকথিত ঐতিহাসিক এবং মুসলিম নামধারি ব্যক্তি এর জন্য দায়ি করেন হযরত উমর (রাঃ) এবং মিশর বিজয়ি মুজাহিদ আমর বিন আস(রাঃ) কে। তারা এতটাই মিথ্যা আরোপ করেছেন হযরত উমর (রাঃ) এর উপর যে তিনি নাকি আমর বিন আস (রাঃ) কে চিঠিতে নির্দেশ দেন যে এই বইগুলি যদি কুরআন এর বিরুদ্ধে হয় তাহলে ধ্বংস কর আর যদি না ও হয় তাহলে কুরআন থাকতে এগুলির প্রয়োজন নাই।এই বিষয়টিকে অনেকে সত্য বলে মনে করে থাকেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে এর প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায়্ ১৩০০ সালের দিকের কারো কারো লিখায় অথচ মিশর মুসলিমরা জয় করেছিল ৬৪২ খ্রিষ্টাব্দে! ৭০০ বছর পর কেউ হঠাৎ এই তথ্য আবিস্কার! করলেন যখন খৃষ্টান রাষ্ট্রগুলি সম্মিলিত ভাবে ক্রুসেড এ লড়ছিল ইসলামকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে।
আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি প্রকৃতপক্ষে ধ্বংস হয়েছিল খৃষ্টান উগ্রবাদিদের হাতে আর সেটা সমাপ্ত হয়েছিল ৪১৫ খৃষ্টাব্দের মধ্যেই। বরং ইসলামের সাথে মিশরের কায়রো ও ফুসতাত এ আবার নতুন করে জ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছিল। এবং এটাই সত্যি যে হাইপেশিয়ার রক্তের প্রতিশোধ নিয়েছিল আমর বিন আস (রাঃ) এর তরবারি।
বিষয়: বিবিধ
২১৪৭ বার পঠিত, ২২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ। অনেক কিছু জানা হল। পড়ে ভাল লাগল।
এই মিথ্যাকে কয়েকজন তথাকথিত মুক্তমনা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে।
এসব বিকৃত ও ধ্বংসাত্মক কাজ তো মুসলমানেরা করে না ।
পৃথিবীর ইতিহাসের বড় বড় ম্যাসাকার হয়েছে অমুসলিমদের হাতেই
এটাই সত্য যে ইতিহাসের বড়বড় ধ্বংসের ঘটনাগুলি অমুসলিমদের হাতেই ঘটেছে। কিন্তু এক শ্রেনির মুসলিম ও আছে যারা এই দোষগুলি মুসলিমদের উপর আরোপ করতে চায়।
যাইহোক অনেক নতুন কিছু জানতে পারলাম। আসলে মুসলমানদের হাতে যা কিছু এসেছে তার সবকিছুর নিরাপত্তা পেয়েছে। অপরদিকে উগ্র সাম্প্রদায়িক গোষ্টীগুলোর হাতে শুধু ধ্বংসই হয়েছে সব কিছু।
ধন্যবাদ সুন্দর লেখাটি উপহার দেয়ার জন্য।
অনেক রাত্রে ঘুমিয়েও খুব সকালে উঠে গেলেন!
আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি ছিল প্রাচিন বিশ্বের এক জ্ঞান ভান্ডার। এই লাইব্রেরির হারিয়ে যাওয়া গ্রন্থগুলি পুনউদ্ধার শুরু হয়েছিল মুসলিমদের হাতেই।
আপনাকে অনেক ধন্যবাদ সুন্দর এই তথ্য গুলো শেয়ার করার জন্য।
ইতিহাস বিকৃতির মহোৎসব চলছে আজ বিশ্বজুড়ে। বাংলাদেশে সেটারা মাত্রা আরো খানিকটা বেশি। সেদিন নবম-দশম শ্রেণীর ইতিহাস বইটা পড়লাম আগ্রহ নিয়ে। পাতায় পাতায় ইতিহাস বিকৃতি।
খুনী কর্নেল তাহেরকে বীর হিসেবে তুলে ধরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এর চরিত্র হনন করা হয়েছে নগ্ন ভাষায়, যে গুলো কোনো ঐতিহাসিকদের ভাষা হতে পারেনা।
শুধু তাই নয়, বখতিয়ার খিলজীকে লুন্ঠনকারী হিসেবে চিত্রিত করার অপপ্রয়াস ছিল সেখানে।
যে দেশের পাঠ্যবইতে দেবদেবির নামে উৎসর্গিকৃত পশু হালাল বলা হয় সেই দেশে ইতিহাস সঠিক লিখা হবে আশা করাই বোকামি।
সুন্দর পোস্ট!
ধন্যবাদ তোমাকে
ইতিহাস চর্চায় ঐতিহাসিক এর নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্যই প্রভাব বিস্তার করে কিন্তু তাতে মূল ঘটনাটি এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে একাডেমিক অসততা।
মন্তব্য করতে লগইন করুন