শৃগালের জীবন অথবা সিংহের: টিপু সুলতান
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৫ মে, ২০১৪, ০১:৪৪:১৩ রাত
যখন পড়তে শিখেছি তখন একদিন আমার দাদা আমাকে সে সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রকাশিত একটি কার্টুন বই কিনে দিয়েছিলেন। বইটির নাম ছিল ”টিপু সুলতান”। তারপর মোটামুটি বড় হওয়ার পর পড়ি নসিম হিজাজির দুটি উপন্যাস। ”খুন রাঙ্গা পথ” (মুল উর্দু নাম মুয়াযযম আলি) এবং ” ভেঙ্গে গেল তলোয়ার”। এরপর বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত হয় বিখ্যাত টিভি সিরিজ "দি সোর্ড অফ টিপু সুলতান”। কিছুটা বিকৃত হলেও সেই সিরিজটিও অনেকটাই ইতিহাস সম্মত ছিল এবং সেটা তখন বিটিভির সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ছিল। এভাবেই জানতে পারি এই উপমহাদেশের সর্বশেষ প্রতিরোধ এর কথা ইউরোপিয় উপনিবেশবাদ এর বিরুদ্ধে। তার সেই অবিস্মরণীয় কথা
”শিয়ালের মত সহস্র বছরের জিন্দেগির চেয়ে সিংহের ন্যায় একদিনের জিন্দেগি উত্তম”"।
নিজেও তার জীবনে এই কথার প্রমাণ রেখে গেছেন তিনি। ঐতিহাসিকদের মতে তিনি হচ্ছেন শেষ কোন শাসক যিনি সরাসরি যুদ্ধে জীবন দিয়েছিলেন। দক্ষিণ ভারতের মহিশুর যা বর্তমানে কর্নাটক, কেরালা ও তামিলনাড়ুতে বিভক্ত সেখানের শাসক ছিলেন তিনি। একজন আধুনিক এবং বিজ্ঞান মনস্ক ব্যক্তি হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। উচ্চমানের রণকেীশলবিদও ছিলেন তিনি। যুদ্ধ জাহাজ এর ডিজাইনও করেছেন যা অত্যন্ত সফল যুদ্ধ জাহাজ হয়েছিল। তার চরম শত্রু বৃটিশরা তাকে বৃটেনের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ দশজন প্রতিদ্বন্দ্বী সেনানায়ক এর সম্মান দিয়েছে। তার লিখা একাধিক গ্রন্থ ও রয়েছে যার মধ্যে ”ফতহুল মুজাহিদিন” নামক একটি বই বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। যে বইটিতে তিনি আধুনিক যুগের যুদ্ধের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। সুলতান টিপু ছিলেন ভারত বর্ষে আধুনিক শাসন ব্যবস্থার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি একটি সংস্থা কায়েম করেন যেখানে মানুষ রাষ্ট্রীয় ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারত। যা ছিল অনেকটাই আধুনিক ষ্টক এক্সচেন্ঞ্জ ও বন্ড ব্যবস্থার পুর্বসুরি। নিজের মাতৃভাষা কানাড়ি ছাড়াও আরবি, ফার্সি, উর্দু, তুর্কি, ফরাসি এবং ইংরেজি ভাষাও জানতেন তিনি। মহিশুরে আধুনিক বিভিন্ন কারখানা বসিয়ে শিল্পায়নের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। যার মধ্যে ছিল বিশেষ ধরনের সিল্ক উৎপাদনের কারখানা। তার পিতার সময় প্রথম রকেট ব্যবহার করা হয় সামরিক কাজে। তিনি এই রকেট আর্টিলারির প্রভুত উন্নতি ঘটান। উইলিয়াম কনগ্রিভ যিনি সুলতান টিপুর পরাজয়ের সময় ভারতে কর্মরত ছিলেন তিনি এই টেকনলজি ইউরোপে নিয়ে যান। যার উপর আজকে মহাকাশ বিজ্ঞান ও কৃত্রিম উপগ্রহ ব্যবস্থা দাড়িয়ে আছে। ফরাসি বিপ্লব এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধ দুটির পিছনেই তার অবদান রয়েছে। ফরাসি বিপ্লবের পুর্বে সম্রাট চতুর্দশ লুই এর অত্যাচারে ফ্রান্স ত্যাগকারি অসংখ্য মানুষকে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি এবং তার পিতা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তিনি অর্থ সাহাজ্যও পাঠিয়েছিলেন। ফরাসি বিপ্লবের উদ্যোক্তা জ্যাকোবিন ক্লাব এর একজন সম্মানিত সদস্য করা হয়েছিল তাকে। পরবর্তিতে নেপোলিয়ান এর সাথে তার ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব ও গড়ে উঠে। আলমে ইসলাম এর প্রতি ছিল তার পূর্ণ আনুগত্য। তৎকালিন তুরুস্কের খলিফার দরবারে সার্বক্ষনিক দুত নিয়োগ করেছিলেন তিনি। তাকে খলিফা সুলতান উপাধি দেন। তার পুর্বে মুলত তিনি ব্যবহার করতেন সিরার নবাব ও মহিশুরের দলওয়াই বা প্রধান উপাধি। বিভিন্ন দেশে দুতাবাস এবং বানিজ্য মিশন স্থাপন করার মত আধুনিক চিন্তা করেছিলেন তিনি।
এই প্রজারঞ্জক বীর শাসককে একাকি লড়তে হয়েছিল ইংরেজদের বিরুদ্ধে। দুই শক্তিশালি প্রতিবেশি হায়দারাবাদ এবং মহারাষ্ট্র তাকে সহায়তা দুরে থাক উল্টা তারা সহায়তা করেছিল ইংরেজকে। হায়দারাবাদ এর নিজাম এবং মারাঠা সামন্তরা এভাবে সহায়তা না করলে বিশ্বের ইতিহাসই ভিন্ন রকম হতে পারত। নিজামের বিশ্বাসঘাতকতায় ১৭৯২ সালে পরাজিত হয়ে রাজ্যের পশ্চিম উপকুল সহ নিজের দুই শিশুপুত্রকে ইংরেজদের হাতে জামিন রাখতে বাধ্য হন টিপু সুলতান। কিন্তু তারপরও প্রস্তুতি নিতে থাকেন বৃটিশদের এই উপমহাদেশ হতে বিতাড়নের। কিন্তু ততদিনে তার ঘরের মধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে শত্রুর। বৃটিশরা তার প্রধানমন্ত্রী মির সাদিককে তাদের অনুচর এ পরিণত করে। দেওয়ান বা অর্থমন্ত্রী পন্ডিত পুর্নাইয়া যিনি ছিলেন তার পিতা হায়দার আলির বাল্যবন্ধু তিনিও জড়িয়ে পড়েন বৃটিশদের সাথে। ১৭৯৯ সালে তাদের বিশ্বাসঘাতকতায় বৃটিশ বাহিনী বিনা বাধায় চলে আসে তার রাজধানি সেরিঙ্গাপটম এর কাছে। কিন্তু তার পুরাতন বীর সেনাপতি গাজি খান ও সৈয়দ গাফফার তাদেরকে বাধা দেন দক্ষতার সাথে। কিন্তু তারা উভয়ই নিহত হন বিশ্বাসঘাতকদের হাতে। বিশ্বাসঘাতকরা গোপনে একটি ভাঙ্গা পাচিল এর পাশ থেকে সৈন্যদের সরিয়ে দেয়। এই সুযোগে আক্রমনকারি বাহিনী সেদিকে প্রবেশ করে। সুলতান টিপুর পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এই বীর যোদ্ধা পালিয়ে না গিয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে মোকাবিলা করেন তার শত্রুদের। শহীদ হয়ে তার জীবনের দর্শনকে সম্পূর্ণ করেন তিনি। সেই দিনটি ছিল ৪ঠা মে, ১৭৯৯ সাল।
সুলতান ফতেহ আলি টিপুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আল্লামা ইকবাল রচনা করেছিলেন একটি কবিতা। ”সুলতান টিপুর শেষ উপদেশ”।
অনাদি প্রভাতে মোরে জিব্রাইল বলেছিল ডেকে,
হৃদয়েরে মুক্ত কর বুদ্ধির এ দাসত্বের থেকে।
উর্ধ্বে উঠে দ্বন্দ্ব হতে একত্বের মাঝে রও বেঁচে,
সত্য ও মিথ্যার মাঝে মধ্য পথ নিয়ো নাক বেছে।
সে জায়গা যেখানে শহীদ হয়ে ছিলেন সুলতান ফতেহ আলি টিপু।
সুলতান টিপুরর নিজের ব্যবহৃত ফ্লিন্টলক মাস্কেট। যা ছিল সে সময় এর সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নির্দশন।
১৭৮০ সালে বৃটিশদের বিরুদ্ধে সুলতান টিপুর রকেট হামলার দৃশ্য। সমসাময়িক একজন বৃটিশ শিল্পির আঁকা।
বিষয়: বিবিধ
৫২৩৫ বার পঠিত, ৭৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য ধন্যবাদ।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
চমত্কার সুন্দর কথা বলেছেন তিনি, এই কথা এখনো বেচে আছে আমাদের হৃদয়ে,
ধন্যবাদ সবুজ ভাই অনেক কিছু জানতে পারলাম, বিশেষ করে তার কবরটা দেখেছি।
আপনি কি গিয়েছিলেন সেরিঙ্গাপটম। তাহলে একটি পোষ্টদিননা এই নিয়ে। মাদ্রাজ থেকে বাঙ্গালর যাওয়ার সময় সেরিঙ্গাপটম এর পাশ দিয়ে গিয়েছি কিন্তু সময় এর অভাবে সেখানে কিছু দেখা হয়নি।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
টিপু সুলতান এর একটি ডায়লগ এখনো মনে আছে। এক অত্যাচারী স্থানীয় শাসক বিভিন্ন অত্যাচার ও চরম নির্যাতন প্রমাণ হয়। টিপু সুলতান নির্দেশ দিলেন, “ একে কেল্লার প্রাচীরে নিয়ে ফাঁসি দিয়ে দেয়া হোক, যেন এর প্রজারা একে দেখে মুক্তির উল্লাসে আনন্দে মেতে উঠে।”
সর্বশক্তিমান আল্লাহ এ মহান যোদ্ধা ও শহীদকে বেহেশতে স্থান দিন।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর পোষ্টটির জন্য।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
নসীম হিজাজীর 'ভেঙ্গে গেল তলোয়ার' বইটি পড়ে নিজের জীবনে ব্যাপক প্রভাব পড়েছিল। আজকের দিনটিতে টিপু সুলতানের জন্য দোয়া করেছি। এটা সে কারণে করেছি যে, সে করুন ইতিহাস আমার জানা আছে। এভাবে সবাইকে জানতে হবে, জানাটা উচিত।
অনেক লেখক কষ্ট করে লিখে, মুহূর্তেই সেটি অন্য পাতায় চলে যায়। প্রয়োজনে প্রতিদিন কিছু পোষ্ট ষ্টিকি করা হউক। এতে লেখকেরা কদর পাবে। সবুজেরা আগামী দিনের জন্য রত্ম হিসেবে তৈরী হবে। কেননা সে ধরনের যোগ্যতা তার্ আছে। অনেক ধন্যবাদ।
"ভেঙ্গে গেল তলোয়ার" বইটি কিন্তু প্রথম আপনিই আমাকে দিয়েছিলেন।
মানুষের মধ্যে সাহসি কম নাই। কিন্তু যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে তারা ফুটে উঠে না।
এই কথার অর্থ যদি আমাদের বর্তমানের শাসকেরা বুঝত তা হলে কতই না ভাল হত,হত ভাগা এই জাতীর জন্য। আপনার লেখাটা পড়ে, নসীম হিজাজীর 'ভেঙ্গে গেল তলোয়ার' বইটির কথা মনে পরে গেল। বর্তমান ডিজে দুনিয়ার সন্তানেরা জানে না কে ছিল টিপু সুলতান,আর কে ছিল নসীম হিজাজী,আপনাদের মত লেখকদের এগিয়ে আসতে হবে নতুন প্রজন্মকে জানানোর জন্য। খুব সুন্দর লিখেছেন আপনি। আপনাকে মোবারক বাদ আজ এই দিনে ওনাকে স্বরন করার জন্য। দোয়া রইল তার জন্য। ষ্টিকি করার জন্য মডারেটরদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
আমরা যেমন জাতি, নেতারাও আমাদের তেমনি ...
অনেক অজান তথ্য জানলাম টিপু সুলতান সম্বন্ধে। ভালো লাগলো জেনে উনি সুলতান উপাধি পেয়েছিলেন খলিফা থেকে।
"সত্য ও মিথ্যার মাঝে মধ্য পথ নিয়ো নাকো বেছে" -আল্লাহ্ আমাদের ধৈর্য দান ও সাহায্য করুন, হুজুরের বয়ান ও বাঁচার আকুতি দেখে স্তম্ভিত হয়ে আছি।
আল্লাহতায়লা কুরআন শরিফেই বলেছেন যে তিনি কোন জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেননা যতক্ষন সা তারা নিযেই নিযের ভাগ্য পরিবর্তন করে।
চেতনা শব্দটি অপব্যবহারের কারনে তার অর্থ হারিয়ে ফেলেছে।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্যটির জন্য।
টিপু সুলতানের ক্ষেত্রে তেমনই ঘটনা ঘটেছিল, যদি ভ্রাত্বের বন্ধনে ঐক্যবদ্ধ হয়ে হায়দাবাদের নিজাম এবং কর্ণাটকের কর্ণধারা টিপু সুলতানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করতো তবে বিশ্ব ইতিহাস ভিন্নভাবে রচিত হতো, উপমহাদেশের মানচিত্রও ভিন্নরূপ নিতো।
সত্য নিয়ে লুকোচুরি
অশ্লীলতায় ছেয়ে গেছে দেশটা !
একটি সুন্দর লেখার জন্যে অনেক ধন্যবাদ ।
মিথ্যা যত বেশি বাড়বে। অশ্লিলতাও সেভাবেই বাড়বে।
ব্লগ কতৃপক্ষকে ধন্যবাদ পোষ্ট ষ্টিকি করার জন্য।
আর আমাদের চিন্তা ও মনকে চিরসবুজ থাকার খোরাক দিতে থাকেন (আমীন)
আমাদের বড় একটি সমস্যা হচ্ছে আমরা সবাই বড় হতে চাই। রবিন্দ্রনাথ যাদেরকে বলেছেন আধমরা।
ধন্যবাদ
আমিও সেই প্রত্যাশা করি।
তোমার লেখাটা পড়ে, সেই ফলকটি দেখে, আবার সেই অনুভূতিগুলো উথলে উঠল, কিছুতেই নিজেকে সম্বরণ করতে পারলাম না। অনেক কথা বলে ফেললাম, দুঃখিত।
ব্লগ তো কথা বলার ই জায়গা!!!
বিটিভির "বিলিভ ইট অর নট" অনুষ্ঠানটিতে টিপুস টাইগার এর উপর ডকুমেন্টরি টা দেখেছিলাম। এটি এখন ইংল্যান্ড এ। ইচ্ছা থাকা সত্বেয় সেরিঙ্গাপটম এ যেতে পারিনি। মানুষ যখন দ্বিন ও দুনিয়া কে আলাদা করে নেয় আর দুনিয়ার জন্য দ্বিনকে ভুলে যায় তখন সে আত্মকেন্দ্রীক হয়ে যায়।
ছোট বেলায় আমরা টিপু সুলতান খেলতাম বাড়ির ছেলে পেলেরা মিলে। টিপু সুলতান সম্পর্কে অল্প পড়েছিলামও। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে
আমরা ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশি অচেতন। সেটাই আমাদের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিকর।
মন্তব্য করতে লগইন করুন