শফিউদ্দিন সরদার। বাংলা ভাষার নসিম হিজাজি।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০১ মে, ২০১৪, ০৪:২৫:১৫ বিকাল
দৈনিক ইনকিলাবে প্রতি শুক্রবার প্রকাশিত হত সাহিত্যপাতা। একদিন সেই পাতায় চোখ বুলাতে গিয়ে গিয়ে সুন্দর অক্ষরে লিখা একটি শিরোনাম চোখে পড়ল। ”বারো পাইকার দুর্গ"”। নামটার অভিনব্ত্ব আকর্ষন করল। পড়তে শুরু করলাম ধারাবাহিক উপন্যাসটির সেই কিস্তি। সেই কিস্তিতে ছিল একটি ষড়যন্ত্রের কাহিনি। বাংলার সুলতান রুকুনউদ্দিন বারবক শাহ এর আমলের কথা। কিছু হিন্দু সভাসদ ষড়যন্ত্র করছেন সুলতানের বিরুদ্ধে। এই উপন্যাসটি পড়ার আগে রুকুনউদ্দিন বারবক শাহ এর নাম শুনিনি। মনে করেছিলাম এটাও উপন্যাসের একটি রাজা রানির মত কাল্পনিক চরিত্র। প্রথম পড়াতেই যে আকর্ষন পেয়েছিলাম তাতে সবসময় অপেক্ষায় থাকতাম পরবর্তি কিস্তির জন্য। এই উপন্যাস এর মাধ্যমে পরিচয় হলো বাংলার ইতিহাসের এক অজানা অধ্যায় সুলতান রুকুনউদ্দিন এর শাসন কাল এবং বির মুজাহিদ শহিদ শাহ ইসমাইল গাজির কথা। নসিম হিজাজির কয়েকটি বই পড়েছিলাম আগেই। কিন্তু বাংলায় এই মানের ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনা হয়েছে তা জানতে পেরে আরো পড়ার জন্য নেশা জেগে উঠল। লেখকের নামটিও মনের মধ্যে গেঁথে গেল। শফিউদ্দিন সরদার।
বাংলাভাষায় গত পঞ্চাশ বছরে ঐতিহাসিক উপন্যাস খুব কমই লিখা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কেউকেউ লিখেছেন কিন্তু তাদের বেশিরভাগ লিখাই বিকৃত তথ্য আর মুসলিম বিদ্বেষ এ ভর্তি। সেই বিকৃত ইতিহাসের বিপরিতে সঠিক ইতিহাস নিয়ে ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় কলম হাতে নেন এই শিকড় সন্ধানি সুসাহিত্যিক। এক অতি কঠিন সিদ্ধান্ত নেন তিনি। বাংলাদেশে মুসলিম শাসনের আটশত বছরের ইতিহাস কে উপন্যাসে রুপ দিয়ে পরবর্তি প্রজন্মের কাছে উপস্থাপন করবেন। আল্লাহর অশেষ রহমতে তার সেই সপ্ন সফল হয়েছে।
শফিউদ্দিন সরদার এর জন্ম নাটোর এর হাটবিলা গ্রামে। অল্প বয়সেই পিতৃহারা হন। পিতৃ সম্পদথেকেও বঞ্চিত হন অসৎ কিছু মানুষের ষড়যন্ত্রে। কিন্তু কোন কিছুই তার প্রতিভাকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। কঠোর জিবন সংগ্রামে দিন মজুরের কাজ করে তিনি চালিয়ে গিয়েছেন তার লিখাপড়া।অষ্টম শ্রেনিতে পড়ার সময় মাকেও হারান তিনি। কিন্তু তাতেও দমে না গিয়ে ১৯৫০ সালে মেট্রিক পাশ করেন। এসময় ভাল ছাত্র হওয়ায় তাকে সাহাজ্য করার ইচ্ছায় একজন অবস্থাপন্ন ব্যাক্তি তার সাথে তার মেয়েকে বিয়ে দেন কিন্তু বন্যা ও অন্যান্য করনে সেখান থেকেও বেশি সাহাজ্য পাননি তিনি। রংপুর কারমাইকেল কলেজে থেকে আই,এ পাশ করেন শিক্ষকতা এবং দিনমজুর এর কাজ করে। এরপর ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইএ পরিক্ষায় বৃত্তি লাভ করায় তার পক্ষে তা সম্ভব হয়। প্রথমে ইতিহাসে এবং তারপর ইংরেজি সাহিত্যে মাষ্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেন। সেই সঙ্গে যুক্ত থাকেন বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কার্যক্রম এর সাথে। লন্ডন থেকে ডিপ্লোমা ইন এডুকেশন ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। নাটোর সরকারি কলেজ,রাজশাহি ক্যাডেট কলেজ সহ বিভিন্ন কলেজে অধ্যাপনা করেন তিনি। অধ্যক্ষের দায়িত্বও পালন করেছেন বিভিন্ন কলেজে। প্রথম শ্রেনির ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ছয় বছর। মাঝে কিছুদিন রাজনিতির সাথেও জড়িত ছিলেন এবং ১৯৯১ সালের সংসদ নির্বাচনে প্রার্থি হয়েছিলেন। তার জিবন সংগ্রাম ও সংঘাতে মুখরিত এবং বিচিত্র বর্নিল অভিজ্ঞতায় সম্বৃদ্ধ। যার ছাপ তার লিখায় এসেছে বারবার। আদর্শ আর মুল্যোবোধ এর ব্যাপারে কখনও আপোষ করেননি বলে লন্ডন থেকে ডিগ্রি নিয়ে আসার পরও সেচ্ছায় কিছুদিন কৃষক এর জিবন যাপন করেছিলেন তিনি।
শফিউদ্দিন সরদার তার ছাত্র জিবন থেকেই সাহিত্যের সাথে সংযুক্ত। সেই সঙ্গে একজন দক্ষ অভিনেতা ও ছিলেন। মঞ্চনাটকের নিয়মিত শিল্পি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশে বেতারের তালিকাভুক্ত নাট্যকার এবং অভিনেতা ও উপস্থাপকও ছিলেন। তার লিখা নাটকগুলি এখনও জনপ্রিয়। তার আরেকটি বড় কাজ রাজশাহির চলনবিল অঞ্চলের প্রায় হারিয়ে যাওয়া লোকগিতি কে উদ্ধার করা।
সাহিত্যে শফিউদ্দিন সরদার প্রধানত পরিচিত তার ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলির জন্য। যদিও তার নাটক এবং বেশ কিছু রম্য রচনাও আছে জনপ্রিয় এবং অত্যন্ত উন্নতমানের। তার রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট যে শব্দগুলি কলকাতার ভাষার চাপে আমাদের সাহিত্য থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল সেই মুসুলমানি শব্দগুলির প্রয়োগ। গল্পকার শাহেদ আলি ছাড়া আর কেউ বাংলাদেশে এই কাজ করতে সাহস পাননি। বাংলার আটশত বছরের ইতিহাসকে তিনি তার উপন্যাস গুলির মাধ্যমে যেভাবে তুলে ধরেছেন শুধু সে জন্য হলেও তিনি থাকবেন চিরস্মরনিয়।
২০০৬ সালে তাকে চট্টগ্রামে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা এবং চাদের হাটের উদ্যোগে একটি সম্বর্ধনা দেয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অথিতি ছিলেন মরহুম বিজ্ঞানি ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম। তিনি তার বক্তব্যে বলেছিলেন যে তার কোন লিখা ঐই অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়ার আগে তিনি পড়েননি কিন্তু এখন পড়ে তিনি বুঝেছেন বাংলায় তার মত ভাষার প্রয়োগ খুব কমই আছে। তিনি তার কয়েকটি রচনা থেকে উদ্ধৃত করে এই রচনার মুল্য যে অনেক তা বলেন।
আজকে ১লা মে তার ৮৯ তম জন্মদিনে আমরা তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি এবং তার জন্য আল্লাহতায়লার কাছে হায়াত কামনা করছি।
তার প্রধান প্রকাশিত রচনা গুলি হচ্ছে
১.বখতিয়ারের তলোয়ার (ইখতিয়ারউদ্দিন বিন বখতিয়ার এর বঙ্গ বিজয় এর উপর)।
২.গেীড় থেকে সোনারগাঁ(বাংলায় স্বাধিন মুসলিম সালতানাত এর উদ্ভব)।
৩.যায় বেলা অবেলায়(ইলিয়াস শাহি বংশের আমলে বাংলার উন্নতি এবং রাজা গনেশের ষড়যন্ত্র)।
৪.বিদ্রোহি জাতক (রাজা গনেশের আমল এবং মুসলিম শাসনের পুনপ্রতিষ্ঠা)।
৫.বর পাইকার দুর্গ( ইলিয়াস শাহি বংশের দ্বিতিয় শাসনকাল এবং শাহ ইসমাইল গাজির নেতৃত্বে বাংলায় জনসেবা এবং বাইরের আক্রমন এর বিরুদ্ধে জিহাদ)।
৬.রাজ বিহঙ্গ( আলাউদ্দিন হুসেন শাহ এর শাসন কাল)।
৭.শেষ প্রহরী( কররানি বংশের ইতিহাস এবং কালাপাহাড় সঠিক ইতিহাস)।
৮.প্রেম ও পুর্ণিমা( নবাব শায়েস্তা খানের আমল এবং বাংলায় ইউরোপিয় ষড়যন্ত্রের উদ্ভব)।
৯.বিপন্ন প্রহর ( বাংলায় স্বাধিন নবাবির আমল এবং ইংরেজদের সাহাজ্যে হিন্দু অভিজাত শ্রেনির ষড়যন্ত্র)।
১০.সূর্যাস্ত ( নবাব সিরাজউদ্দেীলা এবং পলাশি)।
১১.পথহারা পাখি (মিরকাশিম এবং ফকির মজনু শাহ এর স্বাধিনতা পুনউদ্ধারের চেষ্টা)।
১২.বৈরি বসতি( সাইয়েদ আহমদ বেরেলভি এর জিহাদ এবং বাংলায় তিতুমির এবং নিল বিদ্রোহ)।
১৩.অন্তরে প্রান্তরে(হাজি শরিয়তুল্লাহ এর সংগ্রাম এবং বাংলার মুসলিমদের মধ্যে নব জাগরনের উন্মেষ)।
১৪.দাবানল (১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধিনতা সংগ্রাম)।
১৫.ঠিকানা ( বাংলায় মুসলিম দের পুনঃউত্থান এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা)।
১৬.ঝড়মুখি ঘর (বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা)।
এছাড়াও তার বেশ কয়েকটি সামাজিক উপন্যাস ও নাটক রয়েছে।
১.দখল(উপন্যাস)।
২. অপুর্ব অপেরা(উপন্যাস)।
৩.চলন বিলের পদাবলি(উপন্যাস)।
৪. পাষানি(উপন্যাস)।
৫.চারচাদের কেচ্ছা(রম্য রচনা)।
৬.রামছাগলের আব্বাজান (রম্য রচনা)।
৭.গাজি মন্ডলের দল(নাটক)।
৮.সুর্যগ্রহন(নাটক)।
৯.বনমানুষের বাসা(নাটক)।
১০.রুপ নগরের বন্দি (শিশুতোষ রচনা)।
১১. সুলতানার দেহরক্ষি (শিশুতোষ রচনা)।।
১২ পরিরাজ্যেও রাজ কন্যা(শিশুতোষ রচনা)।
আরো অনেক অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত রচনাও রয়েছে তার যার মধ্যে বেশকিছু কবিতা বেতার নাটক ও আছে। বেশকিছু পাঠ্য পুস্তক এর প্রনেতাও তিনি।
বিষয়: বিবিধ
৪৩৭৮ বার পঠিত, ৪৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পোষট দিয়ে আবার প্রথম পাতায় থেকে চেক করার জন্য ঢুকতে ঢুকতেই পড়ে মন্তব্য করে ফেললেন।
মন্তব্য করার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমিন।
আমি এই মহান লেখকের রুহের মাগফিরাত কামনা করি।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত তিনি আল্লাহর রহমতে জিবিত আছেন।
সুন্দর মন্তব্যটির জন্য ধন্যবাদ। আসলেই অনেক নিন্ম শ্রেনির কমিউনিষ্ট বা নাস্তিক্যবাদি লেখক তাদের ডুগডুগির জোড়ে হিরো হয়ে যান। অথচ শফিউদ্দিন সরদার এর মত একজন শিকড় সন্ধানি সাহিত্যিককে আমরা প্রাপ্য সন্মান দিতে পারিনি।
উনি ব্লগার না ভাই!
উনি একজন উচ্চমানের সাহিত্যিক। তার বই চট্টগ্রামের দিদার মার্কেট এর রিফা বুকস এবং আন্দরকিল্লাতে পাবেন।
বইটিতে বাংলাদেশের অনেক বাস্তব চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছিল ।
খুব ভাল লাগল একজন লেখককে আজকের এ স্মরণীয় দিনে উপস্থাপন করার জন্য। এসব ক্ষণজম্মা মানুষগুলোকে এ জাতির নতুন প্রজম্ম চেনেনা। যারা পরিচয় করিয়ে দেবার কথা, তারা তাদের বাপ দাদার চৌদ্দ গোষ্ঠীর পরিচিতি নিয়ে ব্যস্ত। একজন অকুতভয় দেশপ্রেমিক লেখক জাতির শ্রেষ্ট বিবেক। সে মানুষগুলোই আজ বড় অবহেলিত। ধনবাদ আপনাকে। ভাল লাগল পড়ে।
তার নেক হায়াত কামনা করছি।
আর তার লিখা বই সংগ্রহ করবো ইনশাআল্লাহ।
তিনার শব্দ সিলেকশন অসাধারণ। একটু মনে আছে"রুখো রুখো ইসকো রুখো এটা ক্ষেপে গেছে বাঁচাও বাঁচাও "
তিনার সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর জন্য ধন্যবাদ।
সত্যিই শফিউদ্দিন সরদারের শব্দ ব্যবহার বিশেষ ধরনের। ডঃ জামাল নজরুল ইসলাম ও তার প্রসংশা করেছিলেন এই জন্য।
উনার সাথে যোগাযোগ করার কোন ব্যবস্থা থাকলে আমাকে ঠিকানায় জানাবেন দয়া করে।
এমনকি যাদের ইসলামি সহ অন্যান্য সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ আছে তাদের কাছ থেকেও আমি তার নাম শুনলাম না !!
সত্যিই আমরা গুণির কদর করতে জানি না। ইসলামের প্রতি ভালবাসা সম্পন্ন সাহিত্যিকদের কদর করতে না পারায় আজকে ইসলামের ইতিহাস, সৌন্দর্য্য মানুষের সামনে তুলে ধরবে সেই মানের সাহত্যিক আমাদের মাঝে নেই :(
এই অসাধারণ ঔপন্যাসিকে আমাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেবার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
শফিউদ্দিন সরদার বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ লেখকদের অন্তর্ভুক্ত। সেটা আমরা মানি আর নাই মানি। অনেকেই আছেন যারা ইসলামি সাহিত্য বলতে কেবল ধর্মিয় বই ই বুঝেন। অথচ কাব্য,উপন্যাস ইত্যাদি ও এর অন্তর্ভুক্ত। নজরুল তা একটি বিখ্যাত প্রবন্ধে বলেছিলেন বিশ্ব সাহিত্যের একটি ইসলামি ঢং আছে। সে সাজে তার সেীন্দর্যের হানি হয়না।
কিন্তু আমাদের হিনমন্যতাবোধ আমাদের কে আমাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের থেকে দুরে রাখছে।তার বই পড়ুন ও প্রচার করুন।
অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্যটির জন্য।
তিনি লিখে চলেছেন আমাদের স্বিকিৃতির আশা না করেই।
-Musa Al Hafiz
মন্তব্য করতে লগইন করুন