খুশবন্ত সিং। একজন বিতর্কিত কিন্তু উল্লেখযোগ্য মানুষের প্রতিকৃতি।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২০ মার্চ, ২০১৪, ০৩:৪৩:২৯ দুপুর
”খুশবন্ত সিং,বাস্টার্ড,ইন্ডিয়া”'। এই রকম ঠিকানা লেখা একটি চিঠি সাধারনভাবে ডাকবিভাগ ফেলে দেবে বা ফেরত পাঠিয়ে দেবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই চিঠিটি পেীছেছিল ঠিক তার প্রাপক এর কাছেই। কারন ভারতের ডাকবিভাগ জানত একজনই নামকরা খুশবন্ত সিং আছেন যাকে অনেকেই হারামজাদা বলে সম্বোধন করেন। সাহিত্যিক,সাংবাদিক খূশবন্ত সিং কেই যে চিঠিটা লিখা হয়েছে তারা বুঝে নিয়েছিলেন তারা।
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক,সাংবাদিক খুশবন্ত সিং এর জিবন ভরা বিভিন্ন রকম বৈপরিত্যে । নিজেকে নাস্তিক না হলেও অজ্ঞেয়বাদি হিসেবে দাবি করেন সবসময়। আবার একজন শিখ হিসেবে গর্ববোধ করার কথা প্রচার করেন নির্দ্বিধায়। গুরুদুয়ারায় প্রার্থনাতেও অংশ নিতেন মাঝেমধ্যে। নিজের আত্মজিবনিতে দাবি করেছেন তিনি বিশ্বাস করেন কেবল অহিংসা পরম ধর্ম এই বিষয়টিতে। নারী বিষয়েও সমান বিতর্কিত তিনি। কিন্তু তার স্ত্রীর সাথেই কাটিয়েছেন দির্ঘ জিবন। লেখায় যেীনতার উপস্থিতি তাকে প্রায়ই। কিন্তু অশ্লিলতার অভিযোগ অস্বিকার করে এসেছেন সবসময়। তার সম্পর্কে সাংবাদিক এমজে আকবরের মন্তব্য ”আরকোন মানুষ নিজের কুখ্যাতি কুড়াতে এত পরিশ্রম করেনি"”। সব মিলিয়ে সবসময় শিরোনামে থাকা একজন মানুষ হিসেবেই খ্যাত খুশবন্ত সিং।
খুশবন্ত সিং এর জন্ম পাঞ্জাবের হাদালিতে ১৫ আগষ্ট ১৯১৫ সালে। হাদালি বর্তমানে পাকিস্তানের অংশ। ছোট্ট এই গ্রামটির সবচেয়ে ধনি পরিবারের সন্তান খুশবন্ত সিং। পিতা শোভা সিং ও দাদা সুজন সিং ছিলেন ব্যবসায়ি । বৃটিশ সরকার দিল্লিতে রাজধানি স্থাপন করার জন্য যে বিশাল নতুন দিল্লি নির্মান কাজ শুরু করেছিলেন তার একজন প্রধান ঠিকাদার ছিলেন সুজন সিং ও শোভা সিং। দাদির তত্বাবধানে কেটেছে তার ছোটবেলা কারন মা বাবা দুজনেই দিল্লিতে থাকতেন। এই দাদিকে নিয়ে লিখেছিলেন একটি গল্প "পোট্রেট অফ এ লেডি" যা ছিল তার সবচেয়ে প্রিয় লেখা। পাঁচ বছর বয়সে দিল্লিতে চলে যান এবং ভর্তি হন তৎকালিন দিল্লির বেসরকারি আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মডার্ন স্কুল এ। এখানেই প্রথম তার ভবিষ্যত স্ত্রী কাভাল মালিক এর সাথে পরিচয় হয়। স্কুলে থাকতেই তার মধ্যে সাহিত্যিক প্রতিভার সম্ভাবনা দেখতে পেয়েছিলেন শিক্ষকরা। যদিও তার পিতা সেটা মানতে পারেননি এবং তিনি চেষ্টা করেছিলেন তার পুত্র যাতে আইনজিবি হয়। এন্ট্রান্স পাশ করার পর লাহোরের বিখ্যাত সেন্ট ষ্টিফেন্স কলেজে ভর্তি হন খুশবন্ত সিং। এখানে ভগত সিং এর ফাঁসি সহ বিভিন্ন ব্যাপারে তার মধ্যে জাতিয়তাবাদি চেতনার উন্মেষ ঘটে। উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে প্রথমে শান্তিনিকেতনে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। তবে শেষ পর্যন্ত লাহোর সরকারি কলেজ থেকে বিএ পাশ করে ইংল্যন্ড যান। কিংস কলেজের ছাত্র হন এবং ব্যারিস্টারি পাশ করে দেশে ফিরে আসেন। ইংল্যান্ড এ থাকতেই সিরিয়াস ভাবে লেখার শুরু। দেশে আসার পর লাহোর হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন এবং এই সময়ই বিয়ে করেন তার শৈশবের প্রেমিকা কাভাল মালিক কে। উকিল হিসেবে সাফল্য লাভ করতে ব্যর্থ হন। যদিও উত্তরাধিকার সুত্রে প্রাপ্ত সম্পদ এর জন্য তার বেশি আয়ের প্রয়োজন ছিলনা। ভারত স্বাধিন হওয়ার পর পররাষ্ট্র বিভাগে চাকরি নেন এবং লন্ডন ও কানাডাতে তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন। লন্ডনে দ্বিতিয়বার পোষ্টিং এর সময় সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছেড়ে দেওয়ার এবং সার্বক্ষনিক লেখক হিসেবে পেশা গ্রহন করার। লন্ডনেই তার প্রথম উপন্যাস “ট্রেইন টু পাকিস্তান” এর কাজ শুরু হয় এবং প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথেই লেখক হিসেবে তার খ্যাতি এবং কুখ্যাতি দুটাই ছড়িয়ে পরে। উপন্যাসটি পরে চলচ্চিত্রায়িত হয়। দেশে ফিরে তিনি প্রথমে অল ইন্ডিয়া রেডিও তে ইংরেজি ভাষার অনুষ্ঠানের প্রযোজক পদে চাকরি নেন। এরপর প্যারিসে ইউনেস্কোর সদর দপ্তর এর তথ্য কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি করেন কিছুদিন। ইউনেস্কো থেকে ফিরে এসে ভারত সরকারের পরিচালিত ম্যাগাজিন “যোজনা” তে সম্পাদক হিসেবে যোগদেন। যোজনা তে থাকতেই শিখ ধর্ম ও এর ইতিহাস নিয়ে বই লিখার প্রস্তাব পান এবং চাকরি ত্যাগ করে এই বিষয়ে গবেষনা শুরু করেন। দির্ঘ তিন বছর গবেষনা ও পর প্রকাশিত হয় তার মতে তার সেরা কর্ম ”হিষ্টরি অফ শিখস”"। এই বইটি একজন পন্ডিত ব্যক্তি হিসেবে তাকে খ্যাতি এনে দেয়। এই বই লিখার পর বোম্বে থেকে প্রকাশিত ”ইলাস্ট্রেটেড উইকলি অফ ইনিডয়ার” সম্পাদক পদে যোগ দেন তিনি। এখানে থাকতেই সাংবাদিক ও কলামিস্ট হিসেবে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। ভারতের রাজনিতির অন্দর মহলের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে উঠে তার। ইন্দিরা গান্ধির সাথে গড়ে উঠে ঘনিষ্ট সম্পর্ক। সঞ্জয় ও মেনকা গান্ধির সাথেও তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। ইন্দিরা গান্ধির মনোনয়নে তিনি রাজ্য সভার মনোনিত সদস্য ও হন। কিন্তু ১৯৮৪ সালে অমৃতসরে শিখদের স্বর্ন মন্দিরে কুখ্যাত "অপারেশন ব্লুষ্টার" এর পর তার সাথে কংগ্রেস ও ইন্দিরা গান্ধির সুসম্পর্ক সম্পুর্ন নষ্ট হয়ে যায়। ইলাস্ট্রেটেড উইকলি ছাড়ার পর তিনি কিছূদিন ইন্দিরা গান্ধির প্রকাশিত ম্যাগাজিন ন্যাশনাল হেরাল্ড সম্পাদনা করেন। এরপর কেকে বিড়লার মালিকানাধিন ”হিন্দুস্থান টাইমস” এর সম্পাদক হন। এরপর আর কোন নিয়মিত চাকরি তিন করেননি কিন্তু মৃত্যর আগেও কলামিষ্ট হিসেবে তার লেখা ৩০ টিরও বেশি ভাষায় অনুদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে।
খুশবন্ত সিং এর সাহিত্য কর্মের মধ্যে উপন্যাসগুলিই বেশি জনপ্রিয় যদিও ছোট গল্পও তার যথেষ্ট উন্নতমানের। তার নাম করা উপন্যাসগুলির মধ্যে রয়েছে ”দিল্লি” যে উপন্যাসে তিনি দিল্লি মহানগরির প্রায় হাজার বছরের ইতিহাসকে তুলে ধরেছেন। আরো রয়েছে ”আই শ্যাল নট হিয়ার দ্য নাইটএঙ্গেল”, ”বারিয়েল এট সি”ইত্যাদি উপন্যাস। ছোট গল্পের সংকলন রয়েছে কয়েকটি। এবং তার অতি জনপ্রিয় কলামগুলির সংকলন। তিনিই উপমহাদেশে কলাম এর শেষে চুটকি কেীতুক লিখা শুরু করেন। তার সেই কেীতুক গুলি নিয়ে দুটি কৈীতুক এর বই ও প্রকাশিত হয়েছে খুশবন্ত সিং জোকস নামে। লেখক হিসেবে তার সম্পর্কে প্রধান অভিযোগ হলো তার লেখায় অতিরিক্ত যেীনতার উপস্থিতি। যে সময় তিনি লিখা শুরু করেছিলেন সে সময় এর হিসেবে বাড়াবাড়ি মনে হলেও বর্তমান সামাজিক হিসেবে তার লেখায় যেীনতা যথেষ্ঠ ভদ্র বলেই মনে হবে। তার আত্মজিবনী ”ট্র,লাভ এন্ড লিটল ম্যালিস” এ তিনি তার জিবনের প্রধান ঘটনা গুলির খোলামেলা বর্ননা দিয়েছেন তবে সেগুলি চিত্রতারকাদের ন্যায় অশালিনতা থেকে মুক্ত। মেনকা গান্ধির মামলা কারনে বইটি প্রকাশিত হতে প্রায় পাঁচবছর দেরি হয়। তিনি নিজেও দাবি করছেন সমকালিন অ্যাংলো ইংলিশ অর্থাত ভারতিয় উপমহাদেশে জন্মগ্রহনকারি বা উপমহাদেশিয় বংশদ্ভুত যারা ইংরেজিতে সাহিত্য রচনা করে থাকেন তাদের তুলনায় তার লেখা ভারতিয় নৈতিক মানে অনেক উন্নত ও অশ্লিল নয়। যদিও উপন্যাস ও কলাম এর জন্য বেশি বিখ্যাত কিন্তু তিনি তার জিবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম মনে করতেন তার লিখা শিখ জাতির ইতিহাস কে।
১৯৭৪ সালে পদ্মভুষন খেতাবে ভুষিত হন খুশবন্ত সিং কিন্তু ”অপারেশন ব্লুষ্টার" এর প্রতিবাদে ফিরিয়ে দেন সেই খেতাব। ২০০৭ সালে আবার পদ্মবিভুষন খেতাব লাভ করেন। ২০১০ সালে তার শেষ উপন্যাস ”দি সানসেট ক্লাব” প্রকাশিত হয়। স্ত্রী কাভাল মালিক এর মৃত্যুর পর বয়সের কারনে কিছুটা লেখা কমিয়ে দিলেও এই সময়ই তার শেষ গবেষনা গ্রন্থ”এন্ড অফ ইন্ডিয়া” প্রকাশিত হয় যেখানে তিনি গুজরাটের মুসলিম নিধন এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত ভেঙ্গে যাওয়ার আশংকা ব্যাক্ত করেছেন।
সারা জিবন ভোগি জিবন যাপন করলেও খুশবন্ত সিং নিজেকে গান্ধিবাদি দাবি করতেন। শতায়ু পুরন করার বছর দেড়েক আগে আজ ২০ এ মার্চ ২০১৪ তিনি মৃত্যুবরন করেছেন।
তার পুত্র রাহুল একজন সাংবাদিক এবং কন্যা মালা দয়াল।
খুশবন্ত সিং এর প্রায় সকল উপন্যাস এর ই বাংলা অনুবাদ পাওয়াযায়। এর প্রায় সবগুলিই অনুবাদ করেছেন সাংবাদিক আনোয়ার হোসা্ইন মঞ্জু। মজার ব্যাপার হচ্ছে ভারতে তার কোন উপন্যাস অনেক ভাষায় অনুদিত হলেও বাংলায় অনুবাদ হয়নি। খুশবন্ত সিং অনেকবার বাংলাদেশে এসেছেন। কবি জসিমুদ্দিন এর সাথে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল। সৈয়দ আলি আহসান এর সাথেও তার ঘনিষ্টতা ছিল। তার সম্পর্কে সৈয়দ আলি আহসান একটি মজার ঘটনা উল্লেখ করেছেন।
ম্যানিলাতে সাহিত্যিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন "পেন" এর একটি সম্মেলনে একজন সাহিত্যিক বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেন যে জিবন যেন একটি ফুটবল খেলা যে খানে আমরা প্রত্যেকে একটি করে বল বহন করছি। সুরসিক খুশবন্ত সিং দাড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন যে বক্তা ভুল বলেছেন আমরা একটি করে নয় বরং দুটি করে বল বহন করি।
বিষয়: বিবিধ
১৮৮৮ বার পঠিত, ৩৭ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
তবে, ইসলামী ইতিহাস নিয়ে যেসব উপন্যাস তিনি লিখেছেন সবগুলোতে তিনি ইসলাম ধর্মকে প্রায় হেয় করেছেন। কেননা তিনি ইসলামী ইতিহাস গুলো যোগাড় করেছেন ভারতীয় তথ্যবিকৃত সমাজ থেকে। তিনি যদি এসব ইতিহাস কোন মুসলিম থেকে নিতেন নতুবা অন্তত খৃষ্টানদের রচিত ইতিহাস অনুসরণ করতেন তাহলে তার সাহিত্যের গ্রহণ যোগ্যতা বহুগুনে বৃদ্ধি পেত। মুসলমানদের পক্ষে তার লিখনী ছিল একপেশে।
তিনি নিযে অজ্ঞাবাদি ছিলেন তাই স্বাভাবিক ভাবেই তিনি ধর্মবিরোধিতা করেছেন। তবুও আমার মনে হয় সমসাময়িক ভারতিয় খ্যতিসম্পন্ন লেখক দের মধ্যে তিনিই সবচেয়ে বেশি উদার ছিলেন। বিশেষ করে তার দিল্লি উপন্যাসে সম্রাট আওরঙ্গজেব এর চরিত্রটি অন্যান্য লেখকদের তুলনায় অনেক বেশি ইতিহাস সম্মত করে লিখেছেন।
ধন্যবাদ।
সাটানিক ভার্সেস বইটি প্রকাশ করার আগে তাঁর মতামত চাইলে তিনি বইটি প্রকাশ না করার পরামর্শ দিয়েছিলেন পেংগুইন সাংস্হাকে । ৯৯ বছর বয়সের খুশবন্ত সিংয়ের মৃত্যুতে আমরাও শোকাবহ । ব্যঙ্গধর্মী লেখার স্টাইলের কারনেই তিনি বেশি জনপ্রিয়।
আনোয়ার হোসা্ইন মঞ্জুর অনুদিত ”দিল্লি” উপন্যাসটা পড়েছিলাম, ওখানে মুসলমান রাজাদেরকে ভিলেন হিসাবে তুলে ধরার চেষ্টা লক্ষ্যনিয় , অবশ্য এটাও ঠিক যে ঐ রাজারাও ইসলাম থেকে অনেক দুরে সরে গিয়েছিল ।
পোস্টের জন্য আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ।
ধন্যবাদ।
যারা সৃষ্টিশিল তাদের কাছ থেকে অবশ্যই শিখার বিষয় আছে। খুশবন্ত সিং নিজেও তাই বিশ্বাস করতেন। তিনি অজ্ঞাবাদি হলেও সব ধরনের লেখক দের লেখাই পড়তেন বলে লিখেছেন। তার বিভিন্ন লেখায় আল্লামা ইকবাল সহ অনেক মুসলিম দার্শনিক এর উদ্ধিৃতি পাওয়া যায়।
তার সব বই পড়া বলে তেমন কষ্ট আসলে হয়নি।
তার লেখায় পড়ার মত অনেক কিছুই থাকত।
অনেক ধন্যবাদ মন্তব্য করার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন