বিস্মৃত এক বীর শহিদ
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১১:৪৪:৩৬ সকাল
উপরের ছবিটি কার?
আমাদের প্রিণ্ট কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে এই ছবিটি কখনও ছাপা কিংবা দেখান হয়ে থাকলেও এখন তা মনে নাই বোধ হয় কারোরই। আমাদের পত্রিকা গুলি প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোন না কোন ভারতিয় চিত্রাভিনেত্রির ছবি আর তাদের নিয়ে রসাল গল্পও ছাপায়। দেশি মডেল বা অভিনেতা-অভিনেত্রিরাও বাদ যায় না। শুধু স্বাধিনতা বা জাতিয় দিবসে ছাপা হয় কয়েকজন তথাকথিত বুদ্ধিজিবির সাথে কয়েকজন শহিদের ছবি। যে বুদ্ধিজিবিরা যুদ্ধ অপরাধের বিচারের দাবিতে গলা ফাটান কিংবা কলম বা কি-বোর্ড। কিন্তু সাহস করেননা আদালতে যেতে। যারা চট্টগ্রামে দশট্রাক অস্ত্র মামলা নিয়ে দেশের সশস্ত্রবাহিনীর প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শনেও পিছপা হননা। কিন্তু তারা ভুলে যান কত সহস্র সৈনিক দেশের একটি অংশের নিরাপত্তার জন্য প্রতিদিন নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে আত্মিয়-স্বজন কি স্ত্রী-পরিবারের সান্নিধ্য ছেড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরন্য আর সুউচ্চ পর্বতের মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন নিজেদের জীবন।
উপরের ছবিটি তাদেরই একজন লেফটেন্যান্ট গাজী মুহাম্মদ মুশফিকুর রহমান বীর উত্তম শহিদ এর। যিনি দেশের নিরাপত্তা ও অখন্ডতা রক্ষা করতে গিয়ে অল্প বয়সেই বিলিয়ে দিয়েছেন নিজের জীবন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর একমাত্র বীর উত্তম পদক প্রাপ্ত বীর যোদ্ধা(যদিও আরেকজনকে কিছুদিন আগে এই পদক দেয়া হয়েছে কিন্তু তিনি কোন যুদ্ধে নিহত হননি)।
শহিদ লেফটেন্যান্ট মুসফিক সাতক্ষীরা জেলার পারুলিয়া গ্রামের সন্তান। জন্ম ৩০ শে নভেম্বর ১৯৬৬ ইংরেজি। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও ১৯৮৬ সালে কমিশন পান। বাংলাদেশ সেনাবহিনীর সবচেয়ে পুরান আর্টিলারি বা গোলন্দাজ বাহিনীর ইউনিট ১ম ফিল্ড রেজিমেন্ট এর নিযুক্ত হন তিনি। ১৯৮৯ সালের আগষ্ট মাসে তার ইউনিট মোতায়েন ছিল ২৪ আর্টিলারি ব্রিগেড এর অধিনে খাগড়াছড়ি জেলার বাগাইহাট এলাকায়। তার দায়িত্ব ছিল দুর্গম ইউনিয়ন লক্ষিছড়ির ক্যাম্প অধিনায়ক হিসেবে। তার রেজিমেন্ট এর তৎকালিন অধিনায়ক লেফট্যানান্ট কর্নেল মইনউদ্দিন খবর পান যে শান্তিবাহিনীর একটি চাঁদা আদায়কারি দল অস্ত্র সহ চেলাছড়া এলাকায় এসেছে। গোপনিয়তার কারনে সেই দুর্গম এলাকায় রেজিমেন্ট সদর থেকে কোন সেনাদল পাঠান দুরহ ছিল তাই তিনি লেঃ মুশফিককে তাদের বাধা দেওয়ার দায়িত্বদেন। খবর প্রদানকারি সোর্স ৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ তারিখে সন্ধাবেলা লেঃ মুসফিক এর কাছে পেীছায়। তার সাথে আলোচনা সেরে রাত সাড়ে নয়টা বাজে তিনি অভিযানে অংশগ্রহনের জন্য প্রয়োজনিয় জনবল কে প্রস্তুত করে ব্রিফ করেন। রাত সাড়ে দশটা বাজে লেঃ মুসফিক সহ ১৭ জন সেনা সদস্যের একটি দল এবং পথ প্রদর্শক সোর্স টার্গেট এর উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। গোপনিয়তা ও নিরাপত্তার জন্য সাধারন চলাচলের রাস্তা পরিহার করে দুর্গম পার্বত্য চট্টগ্রামের কঠিন পথে অনেকগুলি ছড়া ও পাহাড় পার হয়ে অপিরিসীম মনোবল আর কষ্ট সহিষ্নুতার পরিচয় দিয়ে ঘন আঁধার রাত্রে প্রায় চার ঘন্টা হাঁটার পর টার্গেট চেলাছড়া এলাকায় উপস্থিত হয় সেনাদলটি। পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে বিশেষ করে কাসালং রিজার্ভ ফরেষ্ট এলাকায় বনের ভিতর দিয়ে রাত্রেবলা পথ চলার কষ্ট যাদের অভিজ্ঞতা নাই তারা চিন্তাও করতে পারবেন না। টার্গেট এলাকায় পেীছা মাত্রই লেঃ মুসফিক পুর্ব পরিকল্পনা অনুসারে তার দলটিকে তিনভাগে বিভক্ত করেন। তার নিজের নেতৃত্বে থাকে ৬ জনের একটি দল যারা পাহাড়ের উপরে শান্তিবাহিনীর মুল ঘাঁটিতে আক্রমন চালাবে। হাবিলদার মেজবাহ এর নেতৃত্বে থাকে ৫ জনের আরেকটি দল যারা একই পাহাড়ের নিচের দিকের আরেকটি সম্ভাব্য টার্গেট আক্রমন করবে। এবং অবশিষ্ট ৬ জন থাকবে পাহাড়ের নিচে হাবিলদার নজরুল এর নেতৃত্বে যারা রিজার্ভ এবং পশ্চাত নিরাপত্তার কাজ করবে। অন্যদলগুলিকে প্রয়োজনিয় নির্দেশ দিয়ে নিজ দল নিয়ে পাহাড়ে আরোহন শুরু করেন লেঃ মুসফিক। অন্ধকার রাতে দুর্গম পাহাড় বেয়ে টার্গেট এ পেীছতে প্রায় চল্লিশ মিনিট সময় লাগে। অন্ধকারের জন্য টার্গেট ঘরটিও দৃষ্টি গোচর হচ্ছিলনা। সম্ভাব্য অবস্থানের কাছে এসে লেঃ মুসফিক এর সময়োপযোগি সিদ্ধান্ত অনুযায়ি সবাই অস্ত্র ফায়ারিং পজিশনে এনে ক্রলিং করে এগুতে থাকে। এভাবে তারা টার্গেট এর ১০-১২ গজের মধ্যে পেীছে যায়। রাত প্রায় সোয়া তিনটার সময় হঠাৎ আকাশে বিদ্যুত চমকায় এবং সকলেই টার্গেট দেখতে পায়। সেনাদলের উপস্থিতিও প্রতিপক্ষের নিকট প্রকাশ হয়ে যায়। লেঃ মুসফিক তৎক্ষনাৎ গুলির নির্দেশ দেন এবং উভয়পক্ষে গুলি বিনিময় শুরু হয়ে যায়। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই তার বুকে গুলি লাগে এবং তার পাশের সৈনিক চিৎকার করে উঠেন যে স্যারের গুলি লেগেছে। মারাত্মক আহত হলেও দৃঢ় মনোবল ও নেতৃত্বগুনের অধিকারি মুসফিক ফায়ারিং চালিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। পাঁচ মিনিট মত ফায়ারিং চলতে থাকে। প্রতি পক্ষের গুলি বন্ধ হলে তিনি তার দল সহ প্রচন্ড রক্তক্ষরন উপেক্ষা করে টার্গেটে চার্জ করেন । হাবিলদার মেজবার নেতৃত্বে দ্বিতিয় দলটিও পথম টার্গেট দখল এর সাথে সাথে দখল করে নেয়। এসময় আহত অধিনায়ককে শুশ্রুসার জন্য সবাই ব্যাস্ত হয়ে উঠলেও কর্তব্য সচেতন লেঃ মুসফিক তাদের কে এলাকাটি ভালভাবে সার্চ করার এবং প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়ার নির্দেশ দেন। এরপর তিনি রিজার্ভ দলকে উপরে আসার নির্দেশ দেন কিন্তু অন্ধকারে রিজার্ভ দল পথ হারিয়ে ফেলে। এ অবস্থায় তিনি উপরের গ্রুপ থেকে দুই জনকে পাঠিয়ে রিজার্ভ দলকে গাইড করে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেন। হাবিলদার মেজবাহর নেতৃত্বাধিন দলটিও তাদের টার্গেট দখল শেষে উপরে উঠে আসে। রিজার্ভ দল আসার পরই লেঃ মুসফিক শূয়ে পড়েন। এসময়ও তিনি উভয় দলের কাছে সার্চ রিপোর্ট নেন। উপরে দুইটি মৃতদেহ ও দুটি হাতিয়ার এবং নিচে একটি মৃতদেহ এবং হাতিয়ার সহ কাগজপত্র ও আদায় কৃত চাঁদার টাকা পাওয়া যায়। সার্চ শেষে রিজার্ভ পার্টির কাছে থাকা ওয়ারলেস এর মাধ্যমে অভিযানের সাফল্য ও তার আহত হওয়ার খবর রেজিমেন্ট সদরে পেীছান হয় ভোর ৪টার দিকে। ঘটনা জানার পরপরই রেজিমেন্ট ও ব্রিগেড থেকে দ্রুত হেলিকপ্টার প্রেরন এর জন্য প্রয়োজনিয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। এসময় সেকেন্ড লেফটেনান্ট সাইদ এর নেতৃত্বে আরেকটি দল যারা তার দলকে সহায়তা করার জন্য একটুদুরে গংগারাম খালের অপর পারে অবস্থান নিয়েছিল তারা এগিয়ে আসে। রক্তক্ষরনে প্রায় নিস্তেজ হয়ে আসলেও লেঃ মুসফিক ২/লেঃ সাইদ এর দলটি পথ খুজে পেতে ব্যার্থ হলে ট্রেসার সিগনাল এর মাধ্যমে সেই দলটিকে অবস্থানে নিয়ে আসেন। ২/লেঃ সাইদ দ্রুত পুরা এলাকাটি সার্চ করেন এবং উপযুক্ত জায়গায় হেলিপ্যাড নির্মান করে ভোর ছয়টার দিকে সেখানে আহত লেঃ মুসফিক কে নিয়ে আসেন। ড্রেসিং সহ সম্ভাব্য সকল চিকিৎসা দেয়া সত্বেয় অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে হেলিকপ্টারের জন্য অপেক্ষা করতে করতেই শহিদ লেঃ মুসফিক সকাল আটটার দিকে শাহাদাত বরন করেন। তার নেতৃত্ব,দৃঢতা দেশপ্রেম এবং আত্মত্যাগকে স্বিকৃতি দিতে তার অধিনায়ক তাকে বীর উত্তম খেতাবের জন্য সুপারিশ করেন। তৎকালিন ২৪ পদাতিক ডিভিশন এর জিওসি মেজর জেনারেল আবদুস সালাম এবং সেনাবাহিনী প্রধান লেফট্যানান্ট জেনারেল আতিকুর রহমান তা পুর্ন সমর্থন করেন এবং তাকে স্বাধিনতা যুদ্ধের পর একমাত্র ব্যাক্তি হিসেবে বীরউত্তম খেতাবে ভুষিত করা হয়।
দেশের জন্য আত্মউৎসর্গকারি এই বীর যোদ্ধার নাম আজ কতজন জানে? যেখানে এক বিদেশি অভিনেত্রির স্মৃতি রক্ষার দাবিতে মামলা হয় সেখানে লেঃ মুসফিক বীরউত্তম সহ পার্বত্য চট্টগ্রামে আত্মদানকারি অসংখ্য সৈনিককে স্মরন করার জন্য সরকার বা জনগন কি করেছে। তার নামে কেবল মাত্র একটি হল করা হয়েছে আর্টিলারি স্কুল,হালিশহর, চট্টগ্রামে যা সাধারন মানুষের অগম্য। আমাদের কোন শ্রেনীর পাঠ্যবইতেই তার নামটি পর্যন্ত নাই। আর আমাদের প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া আর এগুলিতে গলাবাজি করা বুদ্ধিজিবি গন পারলে বোধহয় তাতেই সন্ত্রাসী বানিয়ে ফেলতেন। যেখানে সরকার নিজ উদ্যোগে পাশের দেশে অস্ত্রপাচারের অভিযোগে সশস্ত্রবাহিনীর সিনিয়র কর্মকর্তাদের মৃত্যুদন্ড দেয় সেখানে এই শহিদদের স্থান কোথায়। লেঃ মুসফিক যে অস্ত্রের গুলিতে শহিদ হয়েছেন কে বা কারা এই অস্ত্র সন্ত্রাসীদের সরবরাহ করেছিল? আজকে যখন মন্ত্রিরা এই হত্যাকারিদের নেতার সাথে এক মঞ্চে ভাষন দেন আর তথাকথিত জনপ্রিয়তম পত্রিকা এই নেতাকে নিয়ে বিশেষ ম্যাগাজিন বের করে তখন লেঃ মুসফিক বা তার ন্যায় আত্মদানকারি সৈনিকদের স্বজনরা কি ভাবেন। মাত্র তেইশ বছরের জীবনে কি পেয়েছেন মুসফিক। নিজের জীবনটাই দিয়ে গেছেন এই দেশের জন্য। অথচ বিনিময়ে আমরা এতই অকৃতজ্ঞ জাতি তাকে বা তার সহযোদ্ধাদের বদলে স্মরন করছি তার হত্যাকারিদের।
শাহদাতের পর লেফট্যানান্ট মুসফিক।
তথ্যসুত্র ও কৃতজ্ঞতা।
# লেঃ আবু রুশদ(অবঃ),সম্পাদক বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল।
# মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম(অবঃ),প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ ও লেখক,রাজনিতিবিদ।
# ইন্টারনেট।
বিষয়: বিবিধ
১৯২১ বার পঠিত, ২০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আজ পার্বত্য চট্টগ্রামে বাংলাভাষীরা অধিকার বঞ্চিত। এমন অধিকারহীন স্বাধীনতার জন্য মুক্তিযুদ্ধ হয়নি।
আমাদের স্বাধিনতা এখন বন্ধুর কাছে বর্গা।
ধন্যবাদ।
আমরা জাতি হিসেবে অকৃতজ্ঞ ও নির্লজ্জ।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
ধন্যবাদ আপু মন্তব্য করার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন