লিভিং ঈগল
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ২৮ জানুয়ারি, ২০১৪, ০৬:৩৬:৩৮ সন্ধ্যা
ইসরাইল এর সবচেয়ে বেশি যুদ্ধ বিমান ধ্বংসের রেকর্ডটি কার?
এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেননা অনেকেই কিন্তু তার চাইতে বেশি মানুষ বোধহয় বিশ্বাস করতে পারবেননা এই রেকর্ডটি একজন বাংলাদেশি পাইলটের। অবিশাস্য হলেও সত্য যে আমাদের দেশের ভূলে যাওয়া এই বীর সন্তান হলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন(অবঃ) সাইফুল আযম কাশেম। শুধু এই রেকর্ড ই নয় সাইফুল আযম চারটি ভিন্ন দেশের হয়ে জঙ্গি বিমান চালান একমাত্র ব্যাক্তি এবং বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ২২ জন জীবিত পাইলট এর একজন ও একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে মার্কিন বিমান বাহিনি কর্তৃক সন্মাননা প্রাপ্ত। ”টপগান” পাইলট হিসেবে এই সন্মাননা প্রাপ্ত বীর যোদ্ধা আমাদের মিডিয়াতে অনেকটাই অপরিচিত। গ্রুপ ক্যাপ্টেন সাইফুল আযম এর জন্ম ১৯৪১ সালে পাবনায়। পিতার চাকরির সুত্রে কলকাতাতে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ছিলেন। ১৯৫৫ সালে মেট্রিক পাস করে পশ্চিম পাকিস্তানে যান এবং ১৯৫৮ সালে পাকিন্তান বিমান বাহিনীতে ক্যাডেট হিসাবে যোগদেন ও ১৯৬০ সালে কমিশন পান। এরপর যুক্তরাষ্ট্রে অ্যাডভান্স ফাইটার পাইলট কোর্স সাফল্যের সাথে উত্তির্ন হন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত ঢাকায় কর্মরত ছিলেন। এরপর ১৯৬৬ পর্যন্ত করাচির উপকন্ঠে মেীরিপুর বিমান ঘাঁটিতে ইন্সট্রাকটর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তাকে সাময়িক ভাবে সারাগোধাতে অবস্থিত ১৭ স্কোয়াড্রন এর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট সাইফুল আযম এ সময় এফ-৮৬ স্যাবর জেট বিমান এর পাইলট হিসেবে প্রধানত পদাতিক সহায়ক মিশন পরিচালনা করতেন। ১৯৬৫ সালের ১৯ এ সেপ্টেম্বর বিখ্যাত চাবিন্দা ট্যাংক যুদ্ধে অংশ নেন তিনি এবং বিমান থেকে রকেট ও গোলা বর্ষন করে একাধিক ভারতিয় ট্যাংককে ধ্বংস ও অকার্যকর করেন। এসময় চারটি ভারতিয় ”ন্যাট” জঙ্গি বিমান তাদের উপর আক্রমন করে । সাধারন ভাবে বিমান থেকে ভুমিতে যুদ্ধের উপযোগি অস্ত্র সজ্জিত থাকায় এসময় পাকিস্তানি বিমানগুলির পালিয়ে যাওয়াই স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ফ্লাইট লেফটেনান্ট সাইফুল আযম রুখে দাড়ান এবং বিমান যুদ্ধ বা ডগ ফাইটে একটি ভারতিয় ”ন্যাট” জঙ্গি বিমান ভুপাতিত করেন। এই কৃতিত্বের জন্য তাকে পাকিস্তানে ”সিতারা-ই জুরায়ত” পদকে ভুষিত করা হয়। ১৯৬৭ সালে ফ্লাইট লেফটেনান্ট পদে থাকা অবস্থায় তিনি জর্দান বিমান বাহিনীর প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হন। ইসরাইল এর সাথে যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলে সাইফুল আযম নিজেই স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে জর্দান বিমান বাহিনীর সাথে অপারেশনে নিয়োজিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। তৎকালিন মিশরিয় প্রেসিডেন্ট নাসের জর্দান এর বাদশাহ হুসাইন কে ৫ই জুন মিথ্যা সংবাদ দেন যে ইসরাইলি বিমান বহিনী মিসরিয় বিমানবাহিনীর সাথে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। যদিও প্রকৃত সত্য ছিল ইসরাইলি বিমান বাহিনীর আক্রমনের মুখে মিসরিয় বিমানবাহিনী উডডয়ন এর সুযোগ্ ই পায়নি। এসময় জর্দান এর মফরাক বিমান ঘাঁটিতে রাজকিয় জর্দান বিমান বাহিনীর ১ম স্কোয়ড্রন এর সাথে কর্মরত ছিলেন সাইফুল আযম। ইসরাইলি বিমান আক্রমন এর সংকেত পাওয়ার পরপরই এই স্কোয়াড্রন এর ”হকার হান্টার” বিমানগুলি উড্ডয়ন করে। র্যাংক এর দিক দিয়ে ফ্লাইট লেফটেনান্ট ও বিদেশি হওয়া সত্বেয় এর নেতৃত্ব দেন সাইফুল আযম। মরুঝড় ও মরুভুমির প্রচন্ড চোখ ঝলসানো রোদের মধ্যেও উন্নত রাডার সহায়তা ছাড়াই সাইফুল আযম নেতা হিসেবে আক্রমন কারি ইসরাইলি ফ্রান্সের তৈরি মিষ্টেয়ার বিমানগুলিকে সনাক্ত করেন এবং প্রতি আক্রমন চালান। তিনি একটি মিষ্টেয়ার বিমানকে ভূপাতিত করেন এবং অপর একটি মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় ইসরাইলের সীমানায় পেীছতে সক্ষম হয়। কিন্তু সাইফুল আযম ও তার স্কোয়াড্রন সাফল্য লাভ করলেও অন্যান্য জর্দানি বিমানগুলি ব্যার্থ হয় এবং ইসরাইলি বোমা বর্ষনে বেশিরভাগ জর্দানি বিমান ভুমিতেই ধ্বংস হয়ে যায় ও রানওয়েগুলি ক্ষতি গ্রস্ত হয়। সাইফুল আযম তার সাফল্যের জন্য জর্দানিদের প্রসংশা ও শ্রদ্ধা পান। বাদশাহ হুসাইন নিজেই তার নিজের গাড়িতে করে সাইফুল আযমকে তার মেস এরৎ পেীছিয়ে দেন। জর্দান থেকে আর উড্ড্য়ন সম্ভব না হওয়ায় জর্দানি বিমান বাহিনীর পাইলটরা প্রতিবেশি ইরাকি বিমান বাহিনীতে সহায়তার সিদ্ধান্ত নেয়। সাইফুল আযম আবারও পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার পরিবর্তে ইরাকি বিমান বাহিনীর হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন। এবারও দক্ষতার পরিচয় দিয়ে ইরাকি বিমান বাহিনীর হকার হান্টার বিমান নিয়ে তিনি তৎকালিন সর্বাধুনিক ফ্রান্সের "মিরেজ-৩সি" বিমান ভুপাতিত করেন। তিনি একটি ”ভেটর” বোমারু বিমানও ভুপাতিত করেন। এই বিরত্বের জন্য তাকে জর্দান সরকার ”ওয়াসমা ই ইস্তেকলাল” বা স্বাধিনতা পদক এবং ইরাক কর্তক ”নওয়াত-ই সুজ্জাত” পদকে ভুষিত হন। পাকিস্তানে ফিরে আসার পর তিনি প্রথমে ফাইটার পাইলট হিসেবে কাজ করতে থাকেন ১৯৭১ সালের ২৫ ই মার্চ এর পর তাকে যোদ্ধা অবস্থান থেকে সরিয়ে মাসরুর বিমান ঘাঁটিতে প্রশিক্ষন স্কুলের ফ্লাইট অধিনায়ক হিসেবে নিয়োজিত করা হয়। ২৪ এ আগষ্ট ১৯৭১ সালে বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান কে বিমান নিয়ে পালানর চেষ্টায় সহায়তা করার অভিযোগে তাকে গ্রেফতার করা হয় এবং ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তানে বন্দি ছিলেন। দেশে ফিরে আসার পর তিনি বাংলাদেশ বিমান বাহিনীতে যোগদেন এবং গ্রুপ ক্যপ্টেন পদে উন্নিত হন। দুঃখের বিষয় ১৯৮০ সালে তাকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীথেকে অবসর দেয়া হয়। যেখানে তার সহযোগি পাইলটরা যারা তার সাথে যুদ্ধে তার অধিনে অংশ নিয়েছিলেন তাদের দুই জন এয়ার মার্শাল শার্দাম জর্দান ও শাবান ইরাক বিমানবাহিনীর প্রধান নিয়োজিত হন। পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তার সহযোগি পাইলট আযিম দাউদপোতা পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান ছাড়াও চুক্তি ভিত্তিতে জিম্বাবুয়ে বিমান বাহিনীর প্রধান নিয়োজিত হন। অন্য দিকে এই বীর পাইলট কে বাংলাদেশে নিযুক্ত করা হয় ফিলম ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন বা এফডিসির এমডি! পরে অবশ্য তাকে সিভিল এভিয়েশন এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। সল্প সময় রাজনিতিতে যোগ দিয়ে ১৯৯১ সালে বিএনপি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। বর্তমানে নিজের ছোট একটি ব্যবসা ও ট্রাভেল এজেন্সি পরিচালনা করেই তার দিন কাটছে। ”টপ গান” ও ”লিভিং ঈগল” খেতাব প্রাপ্ত এই বীর বোধহয় মাত্র একবার ২০০৩ সালে টেলিভিশনে উপস্থিত হয়েছিলেন তাও আটটার বাংলা সংবাদে। ইরাক যুদ্ধের সময় মাত্র মিনিট পাচেক এর একটি সাক্ষাতকার দিতে। একই সময় সম্ভবত দৈনিক ইনকিলাবে কিছু লিখেিছলেন। এই নিভৃত্াচারি বীর যোদ্ধা কখনই তার বীরত্বকে ব্যবসার উপকরন করনেনি। তিনি বিশ্বের একমাত্র যোদ্ধা পাইলট যিনি চারটি ভিন্ন দেশের পক্ষে জঙ্গি বিমান চালিয়েছেন। তার জন্য নয় বরং আমাদের নিজেদের জন্যই তার কৃতিত্ব এবং বীরত্বের ইতিহাস সকলের জানা প্রয়োজন।
প্রথম ছবিটি সাইফুল আযম কর্তক জর্দানে ইসরাইলি মিষ্টেয়ার ভুপাতিত করার দৃশ্যের অংকিত দৃশ্যায়ন।
পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ইউনিফর্ম এ গ্রুপ ক্যা্প্টেন সাইফুল আযম।
[img]
ইরাকে ইসরায়েলি মিরেজ বিমান ভুপাতিত করছেন সাইফুল আযম।
বৃটেন কর্তক নির্মিত হকার হান্টার জঙ্গি বিমান। এই মডেলের বিমান ব্যবহার করেই সাইফুল আযম ইসরাইলি বিমান ভূপাতিত করেছিলেন।
তথ্যসুত্র ও কৃতজ্ঞতা:
আবু রুশদ(সম্পাদক,বাংলাদেশ ডিফেন্স জার্নাল)
পাকিস্তান বিমানবাহিনী ও পিএএফ মিউজিয়াম ওয়েব সাইট
উইকিপিডিয়া সহ ইন্টারনেট।
বিষয়: বিবিধ
২৯৮৪ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগ্লো ++++++ পিলাচ
সাইফুল আযম প্রান নিয়ে পালিয়ে জাননি বরং নিজের নিজের জিবন বিপন্ন করে যুদ্ধ করেছেন। যার সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন তিনি ইসরাইল এর মুরুব্বি আমেরিকান এয়ারফোর্স কর্তৃক সন্মানিত হয়েছেন তার যোগ্যতার জন্য। তার প্রতি অসন্মানজনক মন্তব্য করে আপনি নিজেই নিচে নেমেছেন। এই ধরনের মন্তব্য মুছে দেওয়াই ভাল। আমি শুধু অন্যান্য পাঠকদের কাছে প্রমান দেওয়ার জন্য মুছছি না।
ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
মন্তব্য করতে লগইন করুন