গনতন্ত্র ধ্বংসে আওয়ামি লিগের অবদান।
লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৬:২৩:৪৪ সন্ধ্যা
১৯৪৯ সালের ২৩ শে জুন ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হয় আওয়ামি মুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে ছিলেন বিভাগ পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের সভাপতি ও অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রি হুসাইন শহিদ সুহরাওয়ার্দি এবং আসাম মুসলিম লিগ নেতা মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। পাকিস্তানী শাসক মুসলিম লিগের অগনতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং আমলা শ্রেনির কায়েমি স্বার্থবাদ রক্ষার চেষ্টা মুসলিম লিগের মধ্যে বিভেদ সৃস্টি করে। এই অবস্থায় মুলত মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ”আওয়ামি মুসলিম লিগ” নামে এই সংগঠনের উদ্যেশ্য ছিল শাসক মুসলিম লিগের বিপরিতে একটি গন সংগঠন কায়েম করা। যে কোন গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই বিরোধি দল একটি প্রয়োজনিয় অঙ্গ। কিন্তু তৎকালিন পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠি এই ব্যাপারে যে ভুল টি করেছিলেন তারা কংগ্রেস কেই বিরোধি দল মনে করতেন। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে বিভাগপূর্ব ভারতবর্ষে উভয় দলের উদ্দেশ্যই ছিল এক, স্বাধিনতা অর্জন। কিন্তু বেশিরভাগ সদস্যই ভারতে চলে যাওয়ার কারনে এই দল বিরোধি দল হিসেবে কার্যকর থাকার কোনই সুযোগ ছিলনা। এই অবস্থায় মুসলিম লিগের আদর্শ ঠিক রেখেই এই দল গঠন করা হয়। মুসলিম লিগ নিজেদের ভুল এবং সরকারী কর্মচারিদের উদ্দেশ্যমুলক পরামর্শে আওয়ামি মুসলিম লিগ কে প্রতিহত করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। এর একটি উদাহরন পাকিস্তানের অস্থায়ি প্রধানমন্ত্রি আবুল মনসুর আহমদ তার গ্রন্থে দিয়েছেন। ময়মনসিংহে আওয়ামি লিগের সভা পন্ড করার জন্য জিলা ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিস সুপার এর উপস্থিতিতে মুসলিম লিগ কর্মিরা হামলা করে কিন্তু এই সরকারি অফিসার রা তাদের নিবৃত্ত করেননি। কিন্তু তখনও দেশে চলছিল ভারত স্বাধিনতা আইন দ্বারা। যে আইনে সরকারি কর্মচারিরা মুসলিম লিগ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেও তাদের চাকরির কোন ক্ষতি হতোনা। এই ধরনের ব্যবস্থা নাটোরের তৎকালিন এসডিও পি.এ নাজির নিয়েছিলেন বলে তার আত্মজিবনিতে উল্লেখ করেছেন। এই ধরনের ঘটনায় এবং মুসলিম লিগের শাসন ও ব্যবস্থাপনার ভুলে আওয়ামিলিগ খুব দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে যায়। অবশ্য এর নেতাদের প্রায় সকলেই মুসলিম লিগ নেতা হিসেবে পুর্ব থেকেই জনপ্রিয় ছিলেন। একদলিয় ফ্যাসিস্টিক মানসিকতাও আওয়ামি লিগ মুসলিম লিগ থেকেই উত্তরাধিকার সুত্রে লাভ করেছে। এই অবস্থায় ১৯৫২ সালে ভাষা প্রশ্নে সমগ্র পূর্বপাকিস্তান ব্যাপি যে আন্দোলন শুরু হয় মুসলিম লিগ তার ভুল ব্যাখ্যা দেয়। ভাষা আন্দোলন এর সূচনা করেছিলেন মুলত ইসলামপন্থি গনই। তারা নিতিগত ভাবে মুসলিম লিগ বিরোধি ছিলেননা। কিন্তু শাসকদের ভুল পদক্ষেপ এই আন্দোলনকে কম্যুনিষ্ট এবং পাকিস্তান বিরোধিদের ছায়া হতে সাহাজ্য করে। একুশে ফেব্রুয়ারির ঘটনা শাসক মুসলিম লিগের সদস্যদের মধ্যেও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। নিজেদের জনপ্রিয়তা নিয়ে সন্দেহ থাকায় মৃত্য ও অন্যান্য কারনে প্রাদেশিক পরিষদের শুন্য থাকা প্রায় ৩৭ আসনে কোন নির্বাচন দেয়নি সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুর্ন প্রাদেশিক পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন নির্বাচন করতে বাধ্য হয় সরকার। এই অবস্থায় মুসলিম লিগের বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্ট গঠন এর জন্য বিরোধি নেতৃবৃন্দ একমত হন। এই যুক্তফ্রন্টে পরস্পর বিরোধি দর্শন ও কর্মসূচির রাজনৈতিক দল একত্রিত হয়। এই যুক্তফ্রন্টে যোগ দেয় তৎকালে চরম ডানপন্থি আওয়ামি লিগ, বাম পন্থি গনতন্ত্রি দল, ইসলাম পন্থি নিজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী দল এবং মধ্যপন্থি কৃষক-শ্রমিক পার্টি যা বিভাগপুর্ব শেরেবাংলা প্রতিষ্ঠিত কৃষক প্রজা সমিতির উত্তরাধিকারি। এই নির্বাচনে মুসলিম লিগ চরম পরাজয় বরন করে। কিন্তু এই পরাজয়ের কারন যুক্তফ্রন্টের জনপ্রিয়তা বা একুশ দফার প্রতি সমর্থন যতনা ছিল তার চেয়ে বেশি ছিল অপশাসন এর জন্য মুসলিম লিগের অজনপ্রিয়তার কারনে নেগেটিভ ভোট। এই নির্বাচনে মুসলিম লিগ মাত্র নয়টি আসন লাভ করে যেখানে যুক্ত ফ্রন্ট লাভ করে ২২২ টি আসন। যুক্ত ফ্রন্টের ভিতরে আসন সংখ্যার দিক দিয়ে আওয়ামি লিগ ১৪৩, কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি) ৪৮, নেজামে ইসলাম ২২ টি আসন লাভ করে বাকি আসন ছোট দলগুলি লাভ করে। এই ধরনের যুক্ত ফ্রন্টের ক্ষেত্রে ফ্রন্টের ভিতরে যারাই সংখাগরিষ্ঠ থাকুকনা সকল দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে সরকার গঠন করাই সাধারন নিয়ম। কিন্তু আওয়ামি লিগ এই নিতির বিরোধিতা করে এবং নিজেদের একক দলিয় সরকার গঠনের চেষ্টা করে। শেষ পযর্ন্ত শেরেবাংলা একে ফজলুল হক কে প্রধানমন্ত্রি করে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হলেও আওয়ামি লিগের এক তরুন নেতার মন্ত্রিত্ব প্রসঙ্গে প্রধান দুই নেতা শেরেবাংলা ও সুহরাওয়ার্দির মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। উক্ত নেতার নাম না নেয়াই ভাল। আগ্রহী পাঠক নিচে দেয়া সুত্র বই গুলি থেকেই তার নাম অনুমান করে নিতে পারবেন। এই অবস্থায় শেরেবাংলা প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রি হিসেবে শপথ নেন এবং কেবল মাত্র তার নিজ দল থেকে তিনজন মন্ত্রি নিয়ে সরকার গঠন করেন। এই পদক্ষেপ কে আওয়ামি লিগ তাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করলেও প্রকৃত পক্ষে শেরেবাংলা দ্রুত সরকার গঠনের স্বার্থেই এই কাজ করেছিলেন কারন সরকার গঠনে দেরি হওয়ার সুযোগে কেন্দ্রিয় সরকার ও আমলারা এই বিজয় কে নস্যাত করার সুযোগ পেত। এদিকে আওয়ামি লিগের মধ্যেও শহিদ সুহরাওয়ার্দি ও মাওলানা ভাসানীর মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয় যার ফলে আওয়ামি লিগ মন্ত্রিত্বের জন্য নিজেদের প্রার্থি নির্ধারনে দেরি করে। শেষ পর্যন্ত প্রায় এক মাস পর আওয়ামি লিগের প্রার্থিরা মন্ত্রি হিসেবে শপথ নেন কিন্তু শপথ নেওয়ার দিনেই আদমজি জুট মিলে এক ভয়াবহ দাঙ্গার সৃষ্টি হয়। এই অবস্থায় কেন্দ্রিয় মুসলিম লিগ সরকার ও আমলাদের ষড়যন্ত্রে নির্বাচিত সরকার ভেঙ্গে দিয়ে গভর্নরের শাসন জারি করা হয় ঠিক ঈদের দিনের আগের রাত্রে।
এদিকে পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারেও বিরোধ সৃষ্টি হয়। গভর্নর জেনারেল মালিক গোলাম মুহাম্মদ কেন্দ্রিয় গনপরিষদ ও সরকার ভেঙ্গে দেন এবং জনপ্রতিনিধিত্বহিন কনভেনশন এর মাধ্যমে একটি সংবিধান প্রনয়নের চেষ্টা করেন। কিন্তু তৎকালিন কেন্দ্রিয় গনপরিষদের স্পিকার মেীলভি তমিজউদ্দিন খান এর বিরুদ্ধে মামলা করে সিন্ধু হাইকোর্টে জয় লাভ করেন। কিন্তু পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টে ইসলাম বিরোধি প্রধান বিচারপতি মুনির এর চেষ্টায় পরাজিত হন। গভর্নর জেনারেল এর এই অপকর্ম স্রেফ শত্রুতার বসেই আওয়ামি লিগ সমর্থন করে। পাকিস্তান ফেডারেল সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য কনভেনশন বাতিল করে সকল প্রাদেসিক পরিষদ সদস্যদের ভোটে নতুন গনপরিষদ গঠন করার নির্দেশ দেয়। প্রকৃতপক্ষে এই দিনই পাকিস্তানে গনতন্ত্রের মৃত্য হয়। গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ ঢাকায় আসলে তার গলায় মালা দেয়া নিয়ে আওয়ামি লিগ ও কেএসপির রিতিমত প্রতিযোগিতা হয়। এইসময় গভর্নর জেনারেল এর গঠিত তথাকথিত কেবিনেট অভ ট্যালেন্ট এ আইন মন্ত্রি হিসেবে যোগ দেন হুসাইন শহিদ সুহরাওয়ার্দি। মুলত কিছু সরকারী আমলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদি জমিদারদের নিয়ে গঠিত এই সরকারে ”গনতন্ত্রের মানষপুত্র” উপাধিধারির যোগদান ই তার এবং তার দলের প্রকৃত আদর্শকে প্রমান করে। এই সময় গভর্নর জেনারেল গনতন্ত্র বিরোধি বেশ কিছু আইন ও অর্ডিন্যান্স জারি করেন আওয়ামি লিগ ও এর নেতা আইন মন্ত্রি সুহরাওয়ার্দিও সহায়তায়।
এদিকে যুক্তফ্রন্টের প্রাদেশিক নেতা হিসেবে হক সাহেবের উপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে আওয়ামি লিগ। এই প্রস্তাবের পিছনে আওয়ামি লিগের প্রধান দুই নেতা সুহরাওয়ার্দি ও ভাসানির কোন সমর্থন ছিলনা। আবুল মনসুর আহমদ এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও আওয়ামি লিগের ভিতরের স্বার্থবাদি গোষ্ঠির কাছে পরাজিত হন। শেষ পর্যন্ত যুক্তফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। তার আত্মজিবনি ”আমার দেখা রাজনিতির পঞ্চাশ বছর” গ্রন্থে দুঃখের সাথে মন্তব্য করেন যে আওয়ামি লিগ ও কেএসপি উভয় তাদের নিজ নিজ দলের জয় দাবি করলেও কেউই বুঝলোনা আসল জয় হয়েছে গনদুশমন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির। এই অনাস্থা প্রস্তাবের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালিন আওয়ামি লিগের সেক্রেটারি শেখ মুজিবর রহমান। এই প্রশ্নে আওয়ামি লিগও দ্বিধা বিভক্ত হয়ে যায় এবং ৩৯ জন আওয়ামি লিগের প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য যুক্তফ্রন্টের প্রতি তাদের সমর্থন ব্যাক্ত করেন। নৈতিক ও যুক্তির দিক দিয়ে তাদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল কারন যুক্তফ্রন্টের সকল সদস্যই ফ্রন্টের ব্যানার ও ম্যানিফেস্ট এর অধিনে নির্বাচন করেছিলেন। আওয়ামি লিগের ব্যানারে নয়। প্রাদেশিক ক্ষমতার লোভে এই সময় আওয়ামি লিগ জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রতিনিধিত্বের বদলে পাকিস্তানের উভয় অংশের প্যারিটি বা সংখ্যা সাম্য মেনে নেয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের ভোটে কেন্দ্রিয় গনপরিষদে আওয়ামি লিগ বারোটি আসন লাভ করে। এর পর গোলাম মুহাম্মদ সাস্থগত কারনে পদত্যাগ করেন এবং ইস্কান্দার মির্জা গভর্নর জেনারেল হন। ইস্কান্দার মির্যা মুসলিম লিগের সমর্থনে শহিদ সুহরাওয়ার্দিকে প্রধান মন্ত্রি করার কথা দিলে আওয়ামিলিগ তার গভর্নর জেনারেল হওয়ার প্রস্তাব সমর্থন করে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তখন তা বাস্তবায়ন হয়নি। ইতঃমধ্যে পাকিস্তানের জন্য একটি অস্থায়ি শাসনতন্ত্র প্রনয়ন করতে এই পরোক্ষ নির্বাচিত গনপরিষদ সমর্থ হয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসন তন্ত্র বহাল হলে স্বাভাবিক ভাবেই পূর্বপাকিস্তানে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠিত হয়। এই সময় আওয়ামিলিগ হর্সট্রেডিং এর মাধ্যমে কেএসপির ও আওয়ামি লিগ ত্যাগ করা কিছূ সদস্য এর সমর্থনে পুর্ব পাকিস্তানে সরকার হঠন করে। প্রধান মন্ত্রি হন আতাউর রহমান খান।
এই সময় মুসলিম লিগ ভেঙ্গে এর কিছু সদস্য কংগ্রেস এর প্রাক্তন নেতা ডাক্তার খান সাহেব এর নেতৃত্বে প্রাক্তন কংগ্রেস সদস্যদের সাথে মিলে রিপাবলিকান পার্টি গঠন করেন। রিপাবলিকান পার্টির সমর্থনে ও প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্যার উদ্যোগে আওয়ামি লিগ নেতা সুহরাওয়ার্দি প্রধানমন্ত্রি হন এবং আওয়ামি লিগ পাকিস্তানের কেন্দ্রিয় সরকারের নিয়ন্ত্রকের আসনে বসে। কিন্তু প্রকৃপক্ষে আশি আসন বিশিষ্ট কেন্দ্রিয় গনপরিষদে তখন আওয়ামি লিগের আসন ছিল মাত্র বারটি। গনতন্ত্রের স্বাভাবিক নিতি উপেক্ষা করে আওয়ামিলিগ পাকিস্তানের সরকারের নিয়ন্ত্রন নেয়। রিপাবলিকান পার্টির সাথে সরকার গঠনের পর তৎকালিন সরকারের উচিত ছিল সর্বপ্রথম গনভোটের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র অনুমোদন করানো। কিন্তু তার পরিবর্তে সময় ক্ষেপন করে সাধারন সংসদ নির্বাচনের জন্য চেষ্টা শুরু হয়। কিন্তু এ সময় রিপাবলিকান পার্টির সাথে আওয়ামিলিগ এর বিরোধ সৃস্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তান এর সরকার গঠন এর জন্য মুসলিম লিগ-রিপাবলিকান পার্টির বিরোধে আওয়ামি লিগ রিপাবলিকান পার্টিকে অবৈধ সহায়তা করে সরকার গঠন করে। রিপাবলিকান পার্টি পাকিস্তানের সেই শাসনতন্ত্র অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট প্রথার বিরোধি ছিল। কিন্তু সুহরাওয়ার্দি এই প্রথার একজন অতি সমর্থক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত এই ইস্যু সহ কয়েকটি ইস্যুতে রিপাবলিকান পার্টির সাথে বিরোধ হয় এবং রিপাবলিকান পার্টি সমর্থন প্রত্যাহার করলে আওয়ামি লিগ সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয় ও পাকিস্তানের কেন্দ্রে আই,আই চুন্দ্রিগর এর নেতৃত্বে রিপাবলিকান-মুসলিম লিগ মন্ত্রি সভা গঠিত হয়। এদিকে পূর্বপাকিস্তানেও আওয়ামি লিগ অর্ন্তবিরোধে জড়িয়ে পরে। সুহরাওয়ার্দি ছিলেন পুরোপুরি মার্কিন পন্থি এক ব্যাক্তিত্ব । এই সময় ফ্রান্স,ব্রিটেন ও ইসরাইল মিসরে সুয়েজ খাল জাতিয়করনের বিরুদ্ধে সুয়েজ অঞ্চলে আক্রমন করে। সারাবিশ্ব এমনকি ফ্রান্স,ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রেও এই হামলার নিন্দা করে সাধারন মানুষ। কিন্তু মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রি এমনকি এই হামলার নিন্দা জানান থেকেও বিরত থাকে। সুহারওয়ার্দি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। প্রধানত পররাষ্ট্র নিতি এবং পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামি লিগ মন্ত্রিসভার বিভিন্ন অপকর্ম এর প্রতিবাদে মাওলানা ভাসানি আওয়ামি লিগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করেন। যার ফলে প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামি লিগ আবার সংখ্যা লঘিষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বিভিন্ন কেীশলে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভা টিকে থাকে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রি আতাউর রহমান খান এবং আওয়ামি লিগের সেক্রেটারি জেনারেল শেখমুজিবুর রহমানের মধ্যে বিরোধ সৃস্টি হয়। ১৯৫৮ সালের মাঝামাঝি এই নিয়ে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই কয়েকবার পূর্ব পাকিস্তানে মন্ত্রিসভা রদবদল হয় আওয়ামি লিগ ও কেএসপির এর মধ্যে। আওয়ামি লিগ মন্ত্রিসভা কায়েম রাখার জন্য কেন্দ্রিয় সরকারের সহায়তায় শেরেবাংলা একে ফজলুল হক কে গভর্নর পদ থেকে অপসারন করা হয়। সরকার গঠন নিয়ে বিরোধের এক পর্যায়ে প্রাদেশিক পরিষদের বৈঠকে সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষ হয় এবং তাতে আহত হয়ে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলি মারা যান। অন্যদিকে কেন্দ্রিয় মন্ত্রিসভাতে আওয়ামি লিগ যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে। সুহরাওয়ার্দি, আবুল মনসুর আহমদ,আতাউর রহমান খান রা এই সময় কেন্দ্রিয় সরকারে যোগ দেয়ার বিরোধি হলেও শেখ মুজিবুর রহমান সহ কয়েকজন মন্ত্রিত্ব গ্রহন করেন। কিন্তু চার-পাঁচ দিন পর পদত্যাগ করেন। এই অবস্থায় ১৯৫৮ সালের ৭ই অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্যার প্রত্যক্ষ সহায়তায় জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন। পাকিস্তানে গনতন্ত্রের কবর রচিত হয়। আর এই কার্যে আওয়ামি লিগ প্রতক্ষভাবেই সহায়তা করে।
মার্শাল ল এর প্রাথমিক অবস্থা অতিক্রান্ত হলে ১৯৬০ সালের দিকে পুনরায় রাজনিতি চালু হয়। এই সময় বিরোধি সকল রাজনৈতিক দল তথা মুসলিম লিগ,আওয়ামি লিগ, রিপাবলিকান পার্টি,নিযামে ইসলামি,জামায়াতে ইসলামি সহ সকল মার্শাল ল বিরোধি দল একত্রে ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু আওয়ামি লিগ এক পর্যায়ে এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামি লিগ গঠিত হয় নতুন করে। হুসাইন শহিদ সুহরাওয়ার্দি ১৯৬২ সালে ইন্তেকাল করেন। আতাউর রহমান খান পুনর্গঠিত আওয়ামি লিগে যোগ না দিয়ে ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট এই থেকে যান। আবুল মনসুর আহমদ সক্রিয় রাজনিতি থেকে অবসর গ্রহন করেন। শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামিলিগের একক নেতায় পরিনিত হন। আইয়ুব খানের সাথে কিছুটা সমঝোতা করেই এই আওয়ামি লিগ পুর্বপাকিস্তানে তাদের জনপ্রিয়তা বাড়ানর চেষ্টায় থাকে। ইতঃমধ্যে সামরিক শাসনের কুফলে জনগনের মধ্যে সরকার বিরোধিতা প্রচন্ডভাবে দেখা দেয় পাকিস্তানের উভয় অংশে। পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধু প্রদেশের তরুন নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো আইয়ুব খানের মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে পিপলস পার্টি নামে একটি নতুন সেকিউলার দল প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় আগরতলা ষড়যন্ত্র উদঘাটন করে পাকিস্থানের গোয়েন্দা বিভাগ যা মুলত সত্য ছিল। ভারতিয় গোয়েন্দা সংস্থা ”র” সশস্ত্র বাহিনীতে কিছু বাঙ্গালি নিন্ম পদস্থ অফিসারকে দিয়ে বিদ্রোহ ঘটানর চেষ্টা করে। কিন্তু তৎকালিন সরকার এই মামলায় শেখ মুজিবুর রহমান সহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকেও জড়িয়ে ফেলে যারা মুলত এই ঘটনায় প্রত্যক্ষ জড়িত ছিলেননা। এই মামলা অল্প সময়েই মুজিবের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে তুলে। গন আন্দোলনের মুখে আইউব খান পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়হিয়া খান ক্ষমতা নেন। ইয়হিয়া খান দেশে সাধারন নির্বাচনের অঙ্গিকার করেন এবং ১৯৭০ সালে সাধারন নির্বাচনে আওয়ামি লিগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ রাজনৈতিক দলের হাতে ক্ষমতা না দিয়ে সামরিক শক্তি প্রয়োগে এই বিজয় নস্যাৎ করার চেষ্টার পরিনামে বাংলাদেশ স্বাধিন হয়।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই আওয়ামি লিগ এই যুদ্ধকে নিজেদের একক কতৃত্বে নেওয়ার চেষ্টা করে। শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি হলে সে সময় বাংলাদেশের সবার মুরুব্বি এবং বয়োজেষ্ঠ নেতা ছিলেন মাওলানা ভাসানি। কিন্তু আওয়ামি নেতৃবৃন্দ প্রবাসি সরকার গঠনের সময় ন্যাপ সহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধ সমর্থনকারি দলগুলিকে সাথে নেয়নি। এক পর্যায়ে সকল দলের সদস্য নিয়ে একটি নামমাত্র উপদেস্টা পরিষদ গঠন করা হলেও আওয়ামি লিগ বিরোধি প্রধান নেতা মাওলানা ভাসানি কে ভারত সরকার নজরবন্দি করে। এতে আওয়ামি লিগ নেতৃবৃন্দের পুর্ন সমর্থন ছিল। বাংলাদেশ স্বাধিন হওয়ার পর গনতন্ত্রের প্রতি কোন শ্রদ্ধা না দেখিয়ে আওয়ামি লিগ তাদের প্রাক্তন জাতিয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের নিয়ে এবং একটি জনপ্রতিনিধিত্বহিন কমিটি গঠন করে একটি সংবিধান বা শাসনতন্ত্র রচনা করে। ১৯৭৩ সালে এই সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হয়। সেসময় আওয়ামি লিগ তার অপশাসন সত্বেয় জনপ্রিয় ছিল এবং সাধারনভাবেই সেই নির্বাচনে ২০০ এর বেশি আসন লাভ করত বলে তৎকালিন সাংবাদিক ও বিশ্লেষক দের মতামত। কিন্তু ক্ষমতার লোভে আওয়ামি লিগ নির্বাচনে কারচুপি ও শক্তি প্রয়োগ করে ৩০০ এর মধ্যে ২৯৩ টি আসন দখল করে। গনতন্ত্রের নিয়ম অনুযায়ি এই পার্লামেন্ট এর কোন বিরোধি দল কে স্বিকৃতি দেয়া হয়নি। আওয়ামি লিগ বিরোধি একমাত্র উল্লেখযোগ্য নেতা হিসেবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রি আতাউর রহমান খান নির্বাচিত হলেও এবং সকল বিরোধি সদস্য তাকে সমর্থন করলেও আওয়ামি লিগ সরকার তাকে বিরোধি দলিয় নেতা হিসেবে স্বিকৃতি দেয়নি। দেশের পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ এর দিকে যেতে থাকলে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি মাসে গনতন্ত্রের কফিনে সর্বশেষ পেরেক টুকে একদলিয় বাকশাল শাসন কায়েম হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমান আজিবন সর্বক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতি হন। ২৯৩ জন আওয়ামি লিগ সদস্যদের মধ্যে কেবল মাত্র দুই জন বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানি এবং ব্যারিস্টার মাইনুল হোসেন এর বিরোধিতা করেন। কিন্তু এই সর্বক্ষমতা কুক্ষিগত করে গনতন্ত্র হত্যা দেশের বা আওয়ামিলিগের জন্য কোন ভাল ফল বয়ে আনেনি। ১৯৭৫ সালের ১৫ ই আগষ্ট শেখ মুজিব সপরিবারে নিহত হন এবং দেশে পুনরায় সামরিক শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।
শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান দেশে বহুদলিয় গনতন্ত্র পুনরায় চালু করলে আওয়ামি লিগ আবার রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ শুরু করে। শেখ মুজিব এর কন্যা শেখ হাসিনা নির্বাসন থেকে ফিরে এসে দলের নেতৃত্ব গ্রহন করেন। জিয়াউর রহমানের হত্যার পর যে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামি লিগ প্রার্থি হিসেবে ডক্টর কামাল হোসেন অংশ গ্রহন করেন। কিন্তু মাত্র আটমাসের মধ্যে জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত সরকার কে ক্ষমতাচুত্য করে দেশে সামরিক শাসন কায়েম করেন। যে কাজে আওয়ামি লিগের প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। এরশাদের সামরিক শাসন কে বৈধতা দেয়ার নির্বাচনে আওয়ামি লিগ অংশ নেয় এবং এটা এরশাদের শাসন কে আরো শক্তিশালি করতে সাহাজ্য করে। যদিও শেষ পযর্ন্ত না পাওয়ার বেদনা নিয়ে আওয়ামি লিগ এরশাদের সহযোগিতা থেকে সরে আসে। ১৯৯০ সালের শেষে গনঅভ্যুথানে এরশাদের পতন হলে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ এর নেতৃত্বে যে নির্বাচন হয় তাতে আওয়ামি লিগ বিজয়ি হতে ব্যার্থ হয়। আওয়ামি লিগ নেত্রি শেখ হাসিনা এই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে দেশে বিদেশে প্রচারনা চালালেও তাতে সফলতা পাননি। একপর্যায়ে তত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হয় আওয়ামি লিগ এবং তত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। কিন্তু নির্বাচনের আগেই তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিম ক্ষমতা দখলের একটি প্রচেষ্টা নেন এবং আওয়ামি লিগ তাতে পরোক্ষ সমর্থন দেয়। নাসিমের চেষ্টা ব্যার্থ হলেও নির্বাচনে আওয়ামি লিগ সরকার গঠনে সমর্থ হয় কিন্তু তার নিরংকুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিলন্। পরবর্তি নির্বাচনে আওয়ামি লিগ পরাজিত হলে তারা আবারও সেনাবাহিনীকে হস্তক্ষেপ করার উস্কানি দেয়। শেষ পযন্ত ২০০৭ সালে সেনাবাহিনী পরক্ষোভাবে ক্ষমতা দখল করে। ২০০৯ সালে বিদেশি শক্তির প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় আওয়ামি লিগ সরকার গঠন করে এবং সকল গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে।
তথ্য সুত্র:
আমার দেখা রাজনিতির পঞ্চাশ বছর-আবুল মনসুর আহমদ(বিশিষ্ট সাংবাদিক,সাহিত্যিক ও রাজনিতিবিদ, পূর্বপাকিস্তান আওয়ামি লিগের সভাপতি,যুক্তফ্রন্ট সরকারে প্রাদেশিক শিক্ষা মন্ত্রি, এবং সুহরাওয়ার্দি মন্ত্রিসভায় পাকিস্তান কেন্দ্রিয় সরকারের শিল্প ও বানিজ্য মন্ত্রি, এবং কিছূদিনের জন্য অস্থায়ি প্রধান মন্ত্রি)
ওজারতির দুই বছর,স্বৈরাচারের দশ বছর, প্রধানমন্ত্রিত্বেও নয় মাস-আতাউর রহমান খান(পুর্ব পাকিস্তানের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রি, এরশাদ এর সময় সাময়িক বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রি)
দ্য লাস্ট ডেইজ অফ ইউনাইটেড পাকিস্তান- জি.ডব্লিউ চেীধুরি( ইয়াহিয়া খানের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক।)
এক জিবন এক ইতিহাস-সিরাজুর রহমান( সাংবাদিক ও বিবিসি বাংলা বিভাগের প্রধান ,মুক্তিযুদ্ধে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রধান সংগঠক)
জাতিয় রাজনিতি ১৯৪৭-১৯৭৫- অলি আহাদ
( রাজনিতিবিদ,আওয়ামি লিগ ও ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট নেতা)
যখন সময় এলো,বাংলাদেশ ১৯৭৫,বঙ্গবন্ধুঃ যেরকম দেখেছি- সৈয়দ আলি আহসান (কবি,সাহিত্যিক,জাতিয় অধ্যাপক জাহাঙ্গির নগর ও রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য)
কিছু কথা কিছু স্মৃতি-এম সাইফুর রহমান(অর্থমন্ত্রি,বিএনপি সরকার।)
অসমাপ্ত আত্মজীবনি- শেখ মুজিবর রহমান।
বিষয়: বিবিধ
৩৩৭৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন