আল্লামা ইকবাল। কিষান-মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল সে মাঠের সব শস্য কনায় আগুন লাগিয়ে দাও।

লিখেছেন লিখেছেন রিদওয়ান কবির সবুজ ০৮ নভেম্বর, ২০১৩, ১০:০৩:৩৩ রাত

জহির রায়হান এর "জীবন থেকে নেয়া" ছায়াছবি টি দেখেননি, টেলিভিশন দেখেন এমন মানুষ বোধহয় পাওয়া যাবে না। ১৯৭০ সালে এই ধরনের একটি দেশাত্মবোধক কিন্তু সামাজিক-পারিবারিক কাহিনী নিয়ে ছবি নির্মান অবশ্যই অত্যন্ত কৃতিত্বের পরিচায়ক। এই ছায়ছবি টি তে একটি গান আছে যেখানে বিপ্লবি নেতা সম্প্রতি মরহুম আনোয়ার হোসেন এর নেতৃত্বে ধর্মঘটি শ্রমিকরা গাইছে "দুনিয়ার যত গরিবি কে আজ জাগিয়ে দাও"। ছবিটির ধারা দেখে এই গানটিকে বামপন্থি কোন গীতিকার এর রচনাই মনে হবে। কিন্তু যে সত্য অনেকই জানেননা এই গানটি মূলত কবি, দার্শনিক, রাজনিতিবিদ, আধুনিক যুগে ইসলামের অন্যতম প্রধান মুজাদ্দিদ আল্লামা ইকবালের "ফরমান এ খুদা" কবিতার ভাবানুবাদ।

অবাক হচ্ছেন কি?

এই কবিতায় ইকবাল উচ্চারন করেছিলেন তার সেই বিপ্লবি অমর পংক্তি

"কিষান মজুর পায়না যে মাঠে শ্রমের ফল

সে মাঠের সব শস্যকনায় আগুন লাগিয়ে দাও।"

এই মহান বিপ্লবি দার্শনিক কবিকে অনেক্ই জেনে বা না জেনে অযথাই পাকিস্তানি কবি কিংবা বাংলাদেশের স্বাধিনতা বিরোধি! বলে দাবি করেন। যদিও ইকবালের ইন্তেকাল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা এমন কি পাকিস্তান প্রস্তাবের ও আগে ১৯৩৮ সালে। আসলে তারা ইকবালকে ঢেকে রাখতে চান কারন তার আদর্শ ছিল একটাই। ইসলাম। মানবতাই ইসলামের মেীল আদর্শ। আর সেই জন্যই ইসলাম ছিল তার কাব্য ও জিবনের আদর্শ ও দর্শন। ইকবাল পাকিস্তানের কবি এই অদ্ভুদ(প্রধানত তথাকথিত বামপন্থিদের চেষ্টায়) আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে স্বাধিনতার পর আমাদের দেশ থেকে ইকবালের নাম মুছে ফেলার এক প্রবনতা সৃষ্টি হয়েছিল। মজার ব্যাপার ১৯৭২-৭৩ সালে ভারতের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়এ ইকবালের নামে চেয়ার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল।

১৭৫৭ সালের পলাশির যুদ্ধের পরবর্তি একশত বছরের মধ্যে এক সময় উপমহাদেশের শাসক মুসলিম জাতি হয়ে উঠে ডব্লিউ.হান্টার এর ভাষায় ভিস্তি আর চাপরাশির জাতে। অন্যদিকে নিজের আত্মপরিচয় সম্পর্কেও তাদের মধ্যে ছিল ভুল ধারনা। হিন্দু এবং ইংরেজ ঐতিহাসিকরা মুসলিমদের ভারতে উপনিবেশিক শক্তি হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন। উনবিংশ শতাব্দি ধরে উপমহাদেশের মুসলিম দের মধ্যে চলে আসা হতাশা ও দিশেহারা ভাবের মধ্যে ১৮৯৯ সালে লাহোরের এক মুশায়রাতে এক তরুন কবির কন্ঠে প্রথম শোনা গেল উর্দুতে "হিমালয়" কবিতায় এক নতুন জাতিয়তাবাদের সুর। যা আত্মপরিচয় নিয়ে সংশয়গ্রস্ত মুসলিম দের মধ্যে ফিরিয়ে এনেছিল আত্মবিশ্বাস।

১৮৭৭ সনের ৯ই নভেম্বর বর্তমান পাকিস্তানের পাঞ্জাবের শিয়ালকোট এ জন্ম হয় আল্লামা ইকবালের। পিতা শেখ নুর মুহাম্মদ ছিলেন একজন পরহেজগার ব্যাক্তি। জিবন ধারনের জন্য দর্জির কাজ করতেন। কিন্তু জ্ঞান ও আচরনের জন্য ছিলেন খ্যাতিমান। ইকবালের মা ইমাম বি ও ছিলেন একজন মহিয়সি মহিলা। ইকবালের পুর্বপুরষরা ছিলেন কাশ্মিরের সুপরো গোত্রভুক্ত ব্রাম্মন। মাত্র তিন পুরুষ আগে তারা ইসলাম গ্রহন করেন।মায়ের তত্বাবধানের লেখাপড়া শুরু করে তিনি প্রথমে স্থানিয় মক্তবে ভাষা ও কুরআন শরিফ শিক্ষা লাভ করেন। আল্লামা ইকবালের পিতার সাথে তৎকালিন শিয়ালকোট শহরের আলেম উলামাদের ভাল সম্পর্ক ছিল।খ্যাতিমান আলেম সৈয়দ মীর হাসান ছিলেন তখন শিয়াল কোটের স্কচ মিশন কলেজের অধ্যাপক। তিনি মেধাবি আল্লামা ইকবাল কে দেখে তার পিতাকে দ্বিনি শিক্ষার সাথে আধুনিক শিক্ষা দেয়া জরুরি বলে বুঝান। সৈয়দ মীর হাসান পরবর্তিতে আল্লামা ইকবালের অভিবাবক এর মত তার জিবন গঠনে সাহাজ্য করেন। সৈয়দ মীর হাসান এর আগ্রহে ইকবাল স্কচমিশন স্কুল এ ভর্তি হন।এখান থেকেই তিনি ম্যাট্রিক ও আইএ পরিক্ষায় উত্তির্ন হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য লাহোরে যান। লাহোর সরকারী কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে বিএ এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এম,এ পাশ করেন। এই সময় তিনি ভারতিয় শিক্ষা ও দর্শনের অন্যতম গবেষক প্রফেসর টিডব্লিউ আর্নল্ড এর সাহচর্য লাভ করেন। স্কুল জিবন থেকেই ইকবালের কাব্য প্রতিভার উন্মেষ হয়। শিক্ষার ন্যায় এ ক্ষেত্রেও সৈয়দ মীর হাসান তার উৎসহাদাতা এবং সহায়ক ছিলেন। এম,এ উত্তির্ন হওয়ার পরপরই অধ্যাপক হিসেবে কর্ম জিবন শুরু হয় তার। ১৯০৫ সালে ইউরোপ যান ইকবাল। ইংল্যন্ড এর কেম্ব্রিজ এবং জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় এ পড়াশুনা ও গবেষনা করেন তিনি। পরবর্তিতে ১৯০৭ সালে মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ইকবাল। পাশাপশি তিনি ব্যারিষ্টার ও হন। ১৯০৮ সালে ইকবাল দেশে ফিরেন এক সম্পুর্ন নতুন কাব্য ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। ইউরোপে গমনের পুর্বে তিনি ছিলেন একজন ভারতিয় জাতিয়তাবাদি। কিন্তু ইউরোপে তথাকথিত পাশ্চাত্য সভ্যতার যে কুৎসিত রুপ তিনি দেখেন তাতে তিনি সেই সভ্যতার প্রতি বিতশ্রদ্ধ হয়ে যান। আসার পথে সিসিলি দ্বিপ দেখে তিনি লিখেন তার নতুন দর্শনের কাব্য যেখানে তিনি ইসলামের মানবতাকেই তার আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেন। দেশে ফিরে স্বাধিন থাকার ইচ্ছায় সরকারি চাকরি ত্যাগ করে ইকবাল ওকালতি শুরু করেন। কিন্তু তার মন উকিলের ন্যায় ছিলনা বলে বেশ কষ্টেই তার বাকি জিবন অতিবাহিত হয়। ইতঃমধ্যে ভারতের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বঙ্গভঙ্গের মত ঘটনা ঘটে গেছে্। এই নিয়ে হিন্দু কায়েমি স্বার্থবাদি নেতৃত্বের আচরন থেকে ইকবালের মনে তথাকথিত জাতিয়তাবাদ সম্পর্কে সকল আকর্ষন ই মুছে যায়। তিনি এই স্বদেশি জাতিয়তাবাদ কে মুর্তিপুজার সমতুল্য বলে মনে করেন। ১৯০৮ সাল থেকে ১৯৩৮ সালে তার মৃত্য পর্যন্ত ইকবাল বিশ্ব মানবতার জন্য ইসলামকেই একমাত্র সঠিক আদর্শ হিসেবে চিন্তা ও প্রচার করে গেছেন। নতুন যে মানবতার বানি তিনি পৃথিবীর সামনে তুলে ধরলেন তা কোন স্থান,কাল,পাত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সে মানবতা সর্বকালের প্রকৃত সত্যের প্রকাশ। যে কবি একদিন লিখে ছিলেন "সারে জাঁহা সে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা" আজ তিনি বললেন "সব দেবতার সেরা সে দেবতা যাহারে কহিছ স্বদেশ ফের,বসন তাহার বনেছে কাফন আবরি বদন ইসলামের"। ১৯১১ সারে ইকবাল লেখেন তার সেই দির্ঘ কাব্য যা সে সময় জ্ঞানহীন তথাকথিত ভারতিয় জাতিয়তাবাদে আচ্ছন্য মুসলিম সমাজ কে নাড়া দেয় প্রচন্ডভাবে। প্রকাশিত হয় "শিকওয়া" ও "জওয়াব-ই- শিকওয়ার" প্রথম অংশ "শিকওয়া"। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় "জওয়াব ই শিকওয়া"। এই কাব্য ইকবাল কে পৃথিবীর প্রতিটি কোনে মুসলিম দের কাছে করে তুলে পরিচিত এবং প্রেরনার উৎস। শিকওয়াতে ইকবাল মুসলিম জাতিকে তার ভুলে যাওয়া ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলেন্। আর "জওয়াব ই শিকওয়া' তে প্রবল আবেগ আর ভালবাসায় প্রকাশ করেন কেন তারা পতিত হয়েছে শাসকের স্থান থেকে শাসিতেরও নিন্মে। প্রবল ভর্ৎসনায় কবি বলেন জাতিগত বন্ধনহীন মানবতা আর নিজের কৃষ্টি ভুলে যাওয়া মুসলিমদের অবস্থা

" অসনে বসনে খ্রিষ্ট তোমরা, হিন্দু তোমরা সভ্যতায়। তুমি মুসলিম যাহারে দেখিয়া ইহুদিও লাজে মরিয়া যায়।

সৈয়দ কেহ,মির্যা কেহ বা আফগান কেহ যে তুমি হও,

সবকিছু তুমি, বলতো এবার,

মুসলিম তুমি হও কি নও।

আরো বলেন তথাকথিত উচ্চ বংশের মুসলিমউদ্দেশ্য করে।

"পিতৃকুলের সমাধি বেচিয়া খায় যারা

তুমি তাদের জ্ঞাতি।

কবর-ব্যবসা করিয়াও তুমি করিছ বড়াই

নাহি কি লাজ?

নিশ্চয় তুমি মুর্তি পেলেও

তাহারি দোকান ফাঁদিবে আজ।

আশরাফ-আতরাফের ভেদাভেদ গ্রস্ত মুসলিম সমাজকে মানবতার দিকে তার এ্ই উদ্দাত্ত আহবান কায়েমি স্বর্থবাদি দের আতংকিত করে তুলে। তারা এমনকি ইকবালের উপর কুফরির ফতোয়া ও আরোপ করে। কিন্তু তার এই আহবান বৃথা হয়নি। অর্ধমৃত মুসলিম সমাজ কে তা জাগিয়ে তুলে নতুন উদ্যমে।

১৯০৮ থেকৈ ১৯৩৮ সালের মধ্যে কবি ও দার্শনিক হিসেবে ইকবালের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। সক্রিয় রাজনিতিতেও অংশগ্রহন করেন তিনি। ১৯৩০ সালে তিনিই প্রথম উত্তর-পশ্চিম ও উত্তর-পুর্ব ভারত এর সংখাগরিষ্ঠ মুসলিম অঞ্চল নিয়ে প্রশাসনিক ইউনিট গঠন এর প্রস্তাব দেন। ১৯৩০ সালে মাওলানা মুহাম্মদ আলির ইন্তেকালের পর যখন মুসলিম স্বাতন্ত্র বোধ এর চিন্তা চাপা পরে যেতে থাকে তখনই ইকবাল মুহাম্মদ আলি জিন্নাহকে এই বিষয়ে চিঠি লিখেন্। আজিবন জাতিয়তাতাবাদি এবং "হিন্দু মুসলিম মিলনের অগ্রদুত" মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ ইকবালের এই চিঠি গুলো থেকেই তার মত পরিবর্তন করেন এবং মুসলিম দের স্বতন্ত্রজাতি হিসেবে মনে করতে শূরু করেন। যদিও ইকবালের দর্শন কোন নির্দিষ্ট স্থান বা গোষ্ঠি ভিত্তিক জাতিয়তাবাদে বিশ্বাসি ছিলনা কিন্তু সকল স্থান,বংশ,বর্ন নির্বিশেষে একমাত্র ইসলামই মানবিক সাম্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে বলে ইকবাল গভিরভাবে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি মুসলিম দের মনে করতেন এক স্বতন্ত্র মিল্লাত যা কোন ভেীগলিক সীমারেখা দ্বারা আবদ্ধ নয়। জিবনের শেষ প্রান্তে এই নিয়ে দারুল উলুম দেওবন্দ এর মুহতামিম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানির সাথে তার বিতর্ক সৃষ্টি হয়। মাওলানা মাদানি কংগ্রেস এর আদর্শ ভারতিয় এক জাতিয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন এবং একে সমর্থন করে বক্তৃতা দেন ও বই লিখেন। কিন্তু ইকবাল মাত্র কয়েকটি চরনে মাওরানা মাদানির ভুল ধরিয়ে দেন।

"বোঝেনি ওই আযমবাসি দ্বিনের মর্ম,বিহবলতা

তাইতো দেওবন্দে হুসাইন আহমদ কন আযব কথা। ওয়াতন থেকে মিল্লাত হয়,এই কথা ফের গান যে তিনি।

বুঝেননি হায়,নবীর মোকাম আল-আরাবীর মান যে তিনি।

নবীর কাছে পেছিয়ে দাও,এই যদি দ্বিনের দাবি, পেীছাতে না পারো যদি সবাই হবে বু লাহাবি।

শেষ জিবনের অসুস্থ শয্যায় শুয়ে তিনি বুঝতে পারেন শ্রিঘ্রই জাতিয়তাবাদের নামে বিশ্বব্যাপি এক রক্তক্ষয়ি সংঘর্ষ দেখাদেবে। তার "ইবলিশ কি মজলিশ ই শুরা" কাব্যে দ্বিতিয় মহাযুদ্ধের ইংগিত দেন তিনি। ২১ এপ্রিল ১৯৩৮ সনে ইকবাল ইন্তেকাল করেন। কিন্তু তার আগেই পুথিবীর সকল মুসলিমকে শুনিয়ে যান নতুন করে জেগে উঠার বানি।

১৯৩৫ সালে তার "বাল-ই-জিব্রিল" গ্রন্থে তিনি সাম্যবাদি ও মানবতা বাদি সেই বিপ্লবি কবিতাটি প্রকাশ করেন। কবি যাকে বলেছেন এটা হলো ফিরিশতাদের জন্য আল্লাহর আদেশ জাতে মানুষ পৃথিবীতে ন্যায়বিচার ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পারে।

ওঠো দুনিয়ার গরীব ভূখারে জাগিয়ে দাও।

ধনিকের দ্বারে ত্রাসের কাঁপন লাগিয়ে দাও।।

করো ঈমানের আগুনে তপ্ত গোলামী খুন

বাজের সমুখে চটকের ভয় ভাঙিয়ে দাও।

ঐ দেখ আসে দুর্গত দীন দুখীর রাজ!

পাপের চিহ্ন মুছে যাও,ধরা রাঙিয়ে দাও।।

কিষান-মজুর পায় না যে মাঠে শ্রমের ফল

সে মাঠের সব শস্য কনায় আগুন লাগিয়ে দাও।

স্রষ্টা আর সৃষ্টির মাঝে কেন আড়াল?

মধ্যবর্তী মোল্লাকে আজ হাঁকিয়ে দাও...

* আগামিকাল ৯ই নভেম্বর ২০১৩ ইকবালের ১৩৫ তম জন্মবার্ষিকি।

** কবিতাংশ গুলি মনিরুদ্দিন ইউসুফ ও ফররুখ আহমদ অনূদিত।

বিষয়: বিবিধ

৩৫৫৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File